আধুনিক হিন্দী সাহিত্যে ‘নিরালা’-র বিশিষ্ট স্থান ও তাঁর বিশিষ্ট কবিপরিচয়টি বিবৃত করো।

আধুনিক হিন্দী সাহিত্যের এক অন্যতম প্রধান কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা। ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রের মধ্য দিয়ে হিন্দী সাহিত্যে যে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিল, তা ক্রমবিকশিত হয়েছে দ্বিবেদী যুগের মধ্য দিয়ে ছায়াবাদ যুগে। দ্বিবেদী যুগের বর্ণনাপ্রধান উপদেশাত্মক নিষ্প্রাণ কাব্যধারার প্রতিক্রিয়াতেই ছায়াবাদের উদ্ভব। হিন্দী সাহিত্যের আধুনিক পর্বের এই ছায়াবাদ যুগের বিশিষ্ট কবিগণের মধ্যে অন্যতম কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা। ছায়াবাদ যুগের সাহিত্যিক লক্ষ্মণ সর্বাপেক্ষা স্পষ্টভাবে এবং সার্বিকভাবে রূপায়িত হয়েছে ‘নিরালা’-র কাব্য তথা সমগ্র সাহিত্যসৃষ্টির মধ্য দিয়ে, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।

সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার জন্ম ও শৈশবশিক্ষা পশ্চিমবঙ্গে। মেদিনীপুরের তদানীন্তন মহিষাদলে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে নিরালার জন্ম। প্রাথমিক শিক্ষা বাংলা ভাষা-মাধ্যমেই। স্বচেষ্টায় সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু ও ইংরাজি চর্চা করেছিলেন তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে নিরালার বিবাহ হয় মনোহরা দেবীর সঙ্গে। হিন্দীসাহিত্যে গভীরভাবে আত্মনিয়োগের ক্ষেত্রে নিরালার জীবনে তাঁর স্ত্রীর উৎসাহ ও প্রেরণা অসাধারণ।

শৈশবেই মাতৃহীন হওয়ায় এবং পিতা রামসহায় ত্রিপাঠীর কঠোর অনুশাসনের জন্য বাল্যকাল থেকেই নিরালা অন্তর্মুখী হয়ে ওঠেন এবং সেইসঙ্গে কিছুটা বিদ্রোহীও। এই অন্তর্মুখীনতা, অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, প্রতিবাদী বা বিদ্রোহী সত্তা, অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যেও মানবতাবাদী সত্তার অপরাজেয়তা নিরালার সাহিত্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে মহত্ত্ব দান করেছে।

মহিষাদল রাজপরিবারের নিশ্চিত্ত আনুকূল্য ও প্রদত্ত চাকুরী অবহেলায় পরিত্যাগ করে স্বভাব-স্বতন্ত্র নিরালা কোলকাতায় এসে রামকৃষ্ণ আশ্রম থেকে প্রকাশিত ‘সমন্বয়’ পত্রিকায় যোগ দেন এবং পরে ১৯২৩ নাগাদ ‘মতবালা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। পরে উত্তরপ্রদেশের গড়কোলা থেকে কিছুদিন ‘সুধা’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। ‘মতবালা’ পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর হিন্দী সাহিত্য প্রতিভার প্রাথমিক প্রকাশ ঘটে।

প্রথম যৌবনে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কাব্যচর্চার সূত্রপাত ঘটলেও নিরালার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পরিমল’ প্রকাশিত হয়েছিল বহু পরে ১৯২৯-এ। তবে প্রধানত কবি হলেও নিরালার সাহিত্য-সাধনা গল্প, উপন্যাস, লঘু নক্‌শাধর্মী রচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, অনুবাদ ইত্যাদি বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত।

সূর্যকান্ত ত্রিপাঠীর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পরিমল’, ‘গীতিকা’, ‘অনামিকা’, ‘রাম কী শক্তিপূজা’, ‘তুলসীদাস’, ‘কুকুরমুত্তা’, ‘অণিমা’, ‘বেলা’, ‘নয়ে পত্তে’, ‘অর্চনা’, ‘আরাধনা’, ‘গীতগুঞ্জ’ এবং ‘সান্ধ্যকাকলী’। এ ছাড়াও আছে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলিয়াঁ’ এবং কিছু অনুবাদ কবিতা।

১৯২৯-এ ‘পরিমল’ এবং তারপরে প্রকাশিত ‘গীতিকা’ কাব্যগ্রন্থেই নিরালার সুসংস্কৃত হৃদয়বৃত্তি, সৌন্দর্যবোধ, আবেগপ্রবণতা, অধ্যাত্মবোধ, সমাজচেতনা ও সেইসঙ্গে প্রতিবাদী মানসের পরিচয় পাওয়া যাবে। ছায়াবাদী যুগের সৌন্দর্যবোধ, শিল্পচেতনা, মানবতাবাদী দৃষ্টি, রোমান্টিকতার ছায়া নিরালার প্রাথমিক পর্বের এই কাব্যগ্রন্থদুটির মধ্যেই স্পষ্ট।‘পরিমল’ কাব্যগ্রন্থের ‘জুহি কি কলি’, ‘পঞ্চবটী’, ‘ভিক্ষুক’, ‘বিধবা’ প্রভৃতি অসাধারণ কবিতাগুলির মধ্যে একদিকে যেমন প্রেম-সৌন্দর্য-করুণার ধারা প্রবাহিত, তেমনি অন্যদিকে গভীর অধ্যাত্মবাদী রহস্যব্যগুনা ও দার্শনিক গভীরতাও প্রকাশিত।

নিরালার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘অনামিকা’। এই কাব্যগ্রন্থেই নিরালার পরবর্তী কাব্যধারা ও পরিণত কবিমানসের পূর্বাভাস চিহ্নিত। প্রিয় কন্যা সরোজের মৃত্যুতে শোকাহত পিতৃপ্রাণের বেদনা-নির্ঝর প্রবাহিত হয়েছিল যে ‘সরোজস্মৃতি’ নামক শোককাব্যে, তা সংকলিত হয়েছে ‘অনামিকা কাব্যগ্রন্থেই। এ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হল ‘তোড়তা পাথর’, ‘দান’, ‘বনবেলা’ ইত্যাদি। নিরালার পরবর্তী প্রবন্ধাত্মক কাব্যধারার সূচনাও ঘটেছে ‘অনামিকা’-তেই।

সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার কাব্যধারার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও ক্রান্তিকারী দুটি রচনা ‘তুলসীদাস’ এবং ‘রাম কী শক্তিপূজা’। গভীর সমাজচিত্তন, সংস্কৃতিবোধ, ঐতিহ্যচেতনা, আধ্যাত্মিক ভক্তি ও মানবিক শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি পাণ্ডিত্য ও গভীর দার্শনিকতার প্রকাশ ঘটেছে যুগান্তকারী এই দুটি কাব্যগ্রন্থে। দুটিকেই বলা যেতে পারে প্রবন্ধাত্মক কাব্য।

‘তুলসীদাস’ কাব্যে কবি যেন তুলসীদাসের মনোজগৎ মন্থন করে তাঁর ভক্তি ও জীবনদর্শনকে নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অসাধারণ চিত্রণ ঘটেছে এই প্রবন্ধাত্মক কাব্যটিতে। ‘তুলসীদাস’ কাব্য যেন এক মহাকাব্যোচিত ব্যাপ্তি, গাম্ভীর্য ও উদাত্ততা লাভ করেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির সেই উন্নত ঐতিহ্যকে পুনর্বার জাগ্রত করার আহ্বানমন্ত্র ধ্বনিত হয়েছে ‘তুলসীদাস’ কাব্যে

“জাগো জাগো, আয়া প্রভাত,

বীতী, উয়হ বীর্তী অন্ধরাত।”

নিরালার অপর এক যুগান্তকারী প্রবন্ধাত্মক কাব্য ‘রাম কী শক্তিপূজা’। ব্যর্থতা-সার্থকতা, জয়-পরাজয়ের অহংকার কিংবা গ্লানিকে সমাহিত করে এক গভীর বলিষ্ঠ জীবনের দর্শন প্রকাশিত হয়েছে ‘রাম কী শক্তিপূজা’-তে। পৌরুষের এক তাপরাজেয় মহিমা ধ্বনিত হয়েছে এই কাব্যে।

‘অর্চনা, ‘আরাধনা’ এবং ‘গীতগুঞ্জ’ কাব্যগ্রন্থে নিরালায় ভক্তিবিনম্র কবিপ্রাণের, আত্মনিবেদনাত্মক ভক্তহৃদয়ের প্রকাশ ঘটেছে। এই তিনটি কাব্যগ্রন্থকে বলা যেতে পারে নিরালার ভক্তিগীতের সংকলন। আধ্যাত্মিকতা, করুণা, শান্তিকামিতার সঙ্গে অসামান্য প্রকৃতি-চিত্রণও এই কাব্যত্রয়ীর সম্পদ।

আবার এই ভক্তিপ্রবণতার ও আত্মনিবেদিত শান্তরসের বিপরীতে সামাজিক অসাম্য, অনাচার, শোষণ, অনৈতিকতার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ ও ব্যঙ্গাত্মক আঘাত প্রবণতার পরিচয় মিলবে ‘কুকুরমুত্তা’ কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থে পুঁজিবাদ ও পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সমাজ-সচেতন প্রগতিবাদী কবির ব্যঙ্গশাণিত স্বর শোনা যাবে

“আবে, সুন বে গুলাব,

ভুল মত গর পাই খুসবু রঙ্গে আব!

খুন চুসা খাদ কা তুনে অশিষ্ট 

ডাল পর ইতরা রহা ক্যাপিটালিস্ট।”

‘নয়ে পত্তে’ কাব্যগ্রন্থেও এই তির্যক ব্যঙ্গাত্মক স্বর শোনা যাবে। কবির দৃষ্টি এখানে বস্তুবাদী এবং অবশ্যই প্রগতিবাদী। যদিও এই প্রগতিবাদের পরিচয় ‘অনামিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘তোড়তী পাথর’ থেকেই পাওয়া যাবে। তবে ‘কুকুরমুত্তা’ বা বিশেষভাবে ‘নয়ে পত্তে’ কাব্যগ্রন্থে সেই প্রগতিবাদী স্বর আরও স্পষ্ট। ভাষার দিক থেকেও নিরালার কাব্যধারায় নিয়ে পত্তে’ উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, এখানে হিন্দীর সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে উর্দু শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। কাব্যভাষা হয়ে উঠেছে অনেক বেশি গদ্যের নিকটবর্তী।

নিরালা উর্দু গজলকে হিন্দী কাব্যে প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন ‘বেলা’ কাব্যগ্রন্থে। এমনকি বহু লোকগীতিকেও আত্মস্থ করে কাব্য নির্মাণ করা হয়েছে ‘বেলা’তে। হিন্দী-উর্দু ভাষার সংমিশ্রণ প্রথম শুরু হয়েছিল এই কাব্যগ্রন্থেই।

তবে সমগ্র জীবনব্যাপী বহু মৃত্যুর আঘাত, আর্থিক ও অন্য প্রতিকূলতা কবিজীবনকে যে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সেই বেদনার গাঢ় ছায়া যেন সঞ্চারিত হয়েছে ‘সান্ধ্যকাকলী’ কাব্যগ্রন্থে। জীবনের অন্তিমে মৃত্যুকে সহজভাবে বরণ করার জন্য যেন এবার প্রস্তুত কবি—

“আগ সারী ফুক চুকী হ্যায়,

রাগিনী উয়হ ৱুক চুকী হ্যায়,

স্মরণ মেঁ হ্যায় আজ জীবন, 

মৃত্যু কী হ্যায় রেখ নীলী।”

সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা প্রধানত কবি হলেও পত্রিকা সম্পাদনাকালে পত্রিকার প্রয়োজনে এবং বিশেষভাবে আর্থিক প্রয়োজনে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁকে কলম চালাতে হয়েছে। আর এই সূত্রেই আমরা পেয়েছি নিরালা রচিত বেশ কয়েকটি গল্প, উপন্যাস স্কেচধর্মী রচনা, নিবন্ধ, জীবনচরিত ইত্যাদি।

নিরালার উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অপ্সরা’, ‘অলকা’, ‘প্রভাবতী’, ‘উচ্ছৃঙ্খল’, ‘নিরুপমা’, ‘চোরী কী পকড়’ ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পসংগ্রহ—’লিলী’, ‘সখী’, ‘চতুরী চমার’, ‘মুকুল কী বীবী’ ইত্যাদি। নিরালার স্কেচধর্মী রচনা ‘কুল্লীভাট’, ‘বিপ্লেসুর বকরীহা’ ইত্যাদি। গদ্য প্রবন্ধের গ্রন্থ ‘চাবুক’, ‘প্রবন্ধ পদ্ম’, ‘প্রবন্ধ প্রতিমা’, ‘প্রবন্ধ পরিচয়’, ‘কবি কানন’ ইত্যাদি। নিরালা রচিত বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ‘রাণা প্রতাপ’, ‘ভীম’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘ধ্রুব’, ‘শকুন্তলা’ প্রভৃতি। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকটি উপন্যাস, মহাভারত, রামকৃষ্ণের বাণী, বিবেকানন্দের ভাষণ, গোবিন্দদাসের পদাবলী এমনকি বাৎস্যায়নের কামসূত্রের হিন্দী অনুবাদও করেছিলেন নিরালা।

গল্প এবং উপন্যাসগুলির মধ্যেও নিরালা সমসাময়িক দেশ-কাল তথা সমাজের বিভিন্ন অপূর্ণতা, বেদনা, বঞ্চনা, অসাম্যের দিক তুলে ধরেছেন। উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘নিরুপমা’কেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে যদিও স্বীকার করা হয়, তবু এ কথা স্বীকার করা দরকার যে নিরালার সাহিত্য প্রতিভা গদ্য কাহিনীক্ষেত্রে সম্যক উৎকর্ষ লাভ করেনি।

স্কেচধর্মী রচনাগুলির মধ্যে সহজভাবে বিচিত্র বিষয়ের রেখাচিত্র অঙ্কন করেছেন নিরালা। কোনো সুগভীর তত্ত্ব বা দর্শন প্রকাশের পরিবর্তে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অনুভবকে অনায়াস ভাষাবয়নে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর হাস্যপ্রিয়তা ও ব্যঙ্গপ্রবণতাটিও এই স্কেচধর্মী রচনাগুলির মধ্যে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলির মধ্যে সাহিত্য-বিষয়ক চিত্তনেরই প্রাধান্য। বিভিন্ন ভাষার, এমনকি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠের অভিজ্ঞতাও তাঁর সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধগুলিতে ছায়াপাত করেছে।

সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা হিন্দী সাহিত্যাকাশে তাঁর বিচিত্রবিস্তারী প্রতিভা এবং বৈচিত্র্য-সমন্বিত কবিমানসের জন্য এক মহত্ত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করেছেন। ড. বিশ্বম্ভরনাথ উপাধ্যায় এজন্য মন্তব্য করেছেন, “বৈচিত্র্য নিরালাজী কী মুখ্য পচান হ্যায়।” (“বৈচিত্র্যই নিরালার প্রধান পরিচয়’)। তাঁর প্রতিভায় কবির কল্পনা, শিল্পীর সৌন্দর্যধ্যান, শক্তিমানের সাহসী বক্ষপট, দার্শনিকের গভীর চিত্তন, ভক্তের আত্মনিবেদন এবং সমাজকর্মীর সামাজিক সচেতনতার সমন্বয় ঘটেছিল।

নিরালা দ্বিবেদী যুগের বিবৃতিধর্মী নীরস কাব্যধারার বিপরীতে কাব্যশ্রীমণ্ডিত ছায়াবাদী কাব্যের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। ছায়াবাদী কাব্যধারা বস্তুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল নিরালার প্রতিভাস্পর্শেই। তবে তাঁকে শুধু ছায়াবাদী কবি হিসাবে চিহ্নিত করাও বোধহয় ঠিক হবে না। তিনি একাধারে ছায়াবাদী, প্রয়োগবাদী, প্রগতিবাদী কবি। তিনি প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে বিশ্বাসী, আবার সমসাময়িক জীবনধারা সম্পর্কে সচেতন। তিনি প্রেম ও প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় সিদ্ধহস্ত, আবার শাণিত ব্যঙ্গের উচ্চারণেও অকুণ্ঠ। তিনি উদার অদ্বৈতবাদী দর্শনে বিশ্বাসী, ভক্তিপ্রাণ, আত্মনিবেদিত, আবার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈষম্য অসাম্য বঞ্চনা শোষণের বিরুদ্ধে প্রগতিবাদী সাম্যবাদের ঘোষণায় উচ্চকণ্ঠ।

নিরালার কবিতায় প্রকৃতি নিছক বর্ণনারূপেই আসেনি। বরং প্রকৃতি ভারতীয় ঐতিহ্যানুসারে এক চিৎশক্তি হিসাবেই নিরালার কাব্যে ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতির চিরচলমানতা যেন কবিকে নৈরাশ্যের মধ্যেও পুনর্জাগরণের মন্ত্র দান করেছে

“ক্ষণ-ক্ষণ মেঁ পরিবর্তিত হোতে রহে প্রকৃতিপট, 

গয়া দিন, আয়ী রাত, গয়ী রাত, খুলা দিন

এ্যায়সে হী সংসার মেঁ বীতে দিন, পক্ষ মাস

বর্ষ কিতনে হী হজার

জাগো ফির এক বার।”

তাঁর ভক্তিবিনম্র হৃদয় রামকৃয়-প্রচারিত অদ্বৈতসাধনাকে সহজভাবেই বরণ করে নিয়েছিল। তাঁর কাব্যে জীবনের সর্বক্ষেত্র, জয়-পরাজয়ের সর্ব অনুভব ও অবস্থায় সেই পরমচৈতন্যের স্বীকৃতি স্থির বিশ্বাসের সঙ্গে ধ্বনিত

“জীবন কী বিজয়, সব পরাজয় 

চির অতীত আশা সুখ, সব ভয়

সব মেঁ তুম, তুম মেঁ সব তন্ময়।”

সংগীত ও কাব্য সম্মিলিত হয়েছিল নিরালার কাব্যে। জ্ঞান ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর বন্দনাগীতে সেই কাব্য ও সংগীতের যুগলবন্দী শোনা যাবে—

“বর দে বীণাবাদিনী, বর দে।”

মানবতাবাদী কবিহৃদয় পার্থিব বেদনায় পীড়িত হয়ে নিরালার কাব্যে করুণানির্ঝর প্রবাহিত করেছে। ভারতীয় সমাজের এক করুণ দিক এবং কবিহৃদয়ের করুণা একযোগে প্রকাশিত তাঁর ‘বিধবা’ কবিতায়—

“উয়হ্ ক্রুর কাল তাণ্ডব কী স্মৃতি-রেখা সী 

উয়হ টুটে তরু সে ছুটী লতা-সী দীন,

দলিত ভারত কী বিধবা হ্যায়।”

নিরালার কবিমানসের সর্বাপেক্ষা মহৎ দিক তাঁর অপরাজেয় পুরুষকার। তিনি চির বিদ্রোহী। করুণার দ্বারা তিনি প্রাণধারণ করতে চাননি। কোনো ব্যাপারে আপস করাও ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। তাই প্রতিষ্ঠিত অর্থবান পিতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও, মহিষাদল রাজপরিবারের আনুকূল্য সত্ত্বেও তিনি আত্মনির্ভরতার বন্ধুর পথেই তাঁর সাহিত্য সাধনা চালিয়ে গেছেন। দারিদ্র্য এবং বহু উপেক্ষা-অনাদর-আঘাত তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তবু নৈরাশ্য তাঁকে কখনও গ্রাস করতে পারেনি অথবা জীবন তাঁর কাছে নিরর্থক হয়ে ওঠেনি। এক অপরিসীম স্থৈর্য্য এবং অপরাজেয় পৌরুষের দ্বারাই তিনি সাহিত্যসেবার মধ্য দিয়ে জীবনকে আকণ্ঠ পান করেছেন। ‘তোড়তী পথর’ কবিতার একটি অংশকে তাঁর এই অপরাজেয় জীবনবোধের মূল বাণী হিসাবে উদ্ধৃত করা চলে—

“দেখা মুঝে উস্ দৃষ্টি সে/জো মার খা রোই নহী।”