“সাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের নহে, তাহা রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী’”

প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে এই বিপুল বিশ্ব রূপে-রসে-শব্দে-স্পর্শে-গন্ধে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর হয়ে উঠছে, আর এই বিচিত্র বিশাল জগৎ যখন মানুষের মনের মুকুরে ধরা পড়ছে, তখনই ভাবুক মানুষ, কল্পনা-প্রবণ মানুষ তাকে আপন মনের জারক রসে জারিয়ে নিত্য নোতুন রূপে রূপায়িত করছে। মানুষের অন্তরে এই যে নবীন মনোজগতের সৃষ্টি হচ্ছে, কবি-মানুষ রসই জগৎকে অপরের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দিচ্ছেন এবং তার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করছেন সাহিত্যকে। সাহিত্য তাই কবি-মানুষের কল্পনা-প্রবণ মানুষের অন্তর জীবনের আলেখ্য, সঙ্গীত-মূর্ছনায় যা গতি লাভ করে। অতএব দেখা যায়, বাইরের জগৎ এবং মানব-জীবন এই দুয়ের মিলনে অন্তরে যে মহা ঐক্যতান ধ্বনিত হয়, তারই প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। দর্শন-বিজ্ঞানে যে-সকল তত্ত্ব প্রকাশ করা হয় তাদের সরল সহজ কথায় প্রকাশ করতে হয়, তাকে নিরাবরণ নিরলঙ্কার হলেও চলে। কিন্তু সাহিত্যের মাধ্যমে একজনের হৃদয়কে অপর হৃদয়ের দ্বারে যখন পৌঁছুতে হয়, তখন তাকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলবার জন্য একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। উপমা-রূপকাদি অলঙ্কারই প্রধানতঃ সাহিত্যদেহে প্রসাধনের কাজ করে থাকে। নারীর রূপকে ফুটিয়ে তোলবার জন্য অলঙ্কারের একটা উপযোগিতা অবশ্য স্বীকার্য, কিন্তু তার আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায় যাতে, তা কিন্তু তার লাবণ্য, স্ত্রী ও ধী—যা অলঙ্কারকে অতিক্রম করে যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন অলঙ্কারাদির সাহায্যে অপূর্ব সব চিত্র রচনা করে যায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন অলঙ্কারাদির সাহায্যে অপূর্ব সব চিত্র রচনা করা চলে-যথা, বৈয়ব কবি বলরামদাসের ‘দেখিবারে আখি-পাখি ধায় কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘আমার এ আখি উৎসুক পাখি বঝড়ের অন্ধকারে’ অথবা জীবনানন্দ দাসের ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’—প্রভৃতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে শুধু চোখের রূপ বা সৌন্দর্যই ফুটে ওঠে না, অতিরিক্ত একটা অনির্বচনীয় অনুভূতিরও প্রকাশ ঘটে। অতএব সাহিত্যে একদিকে যেমন চিত্র ফুটে ওঠে, অপরদিকে তেমনি ভাষার মধ্য দিয়েই ভাষাতীতকে প্রকাশের জন্য সঙ্গীতমূর্ছনাও শ্রুত হয়। এই চিত্র এবং সঙ্গীতকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সাহিত্যের প্রধান উপকরণ। এরি সাহায্যে-

‘অন্তর হতে আহরি বচন/আনন্দলোক করি বিরচণ,

গীতরসধারা করি সিঞ্চন/সংসার ধূলি-জালে।

কবি মর্ত্যলোকে অমৃতের বার্তা বহন করে নিয়ে আসেন। অতএব দেখা যায়, সাহিত্যে বহিঃপ্রকৃতি এবং মানব-হৃদয়েরই প্রতিফলন ঘটে নানাভাবে। কবি বাইরের জগৎকে স্বীয় অন্তরে গ্রহণ করে তাকেই নবভাবে প্রকাশ করেন সাহিত্যে।

সাহিত্যের যে ধারাকে আমরা ‘স্বানুভাবাত্মক’ বা ‘মন্ময়’ বলে গ্রহণ করি এবং গীতিকবিতার মাধ্যমেই যার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটে থাকে, সেখানেই বহিঃপ্রকৃতি এবং মানব হৃদয়ের পূর্ণ অধিকার। কিন্তু তার বাইরে রয়েছে যে বৃহত্তর মানব-সংসার, যাদের নিয়ে রচিত হয় রস-সাহিত্যেরই অপর একটি ধারা-গল্প-উপন্যাস-নাটক প্রভৃতি, সেখানে মানব-হৃদয়ের মতোই মানব-চরিত্রও একটি অত্যাবশ্যক উপাদানরূপে পরিগণিত হয়। মানব-চরিত্র বড়ই জটিল; জড়-জগৎ আমাদের ইন্দ্রিয় দ্বারা আয়ত্তগম্য হলেও মানব-চরিত্র তেমন সহজ বস্তু নয়। কোনোরকম ধরা-বাঁধা-ছোঁয়ার মধ্যে তাকে পাওয়া যায় না অথচ বিচিত্র এই মানব-চরিত্রকেও অন্তরলোকের বাইরে এনে প্রতিষ্ঠিত করবার মতো দুরূহ কাজের ভারও পড়ছে ঐ সাহিত্যেরই উপর। মানব-চরিত্র এত বৈচিত্র্যপূর্ণ তাতে এতো স্তর, এতো অংশ, তার লীলা এত সূক্ষ্ম, অভাবনীয় ও আকস্মিক যে, কোনো সাধারণ লেখকের পক্ষে সেই দুর্জেয় মানব-চরিত্রকে হৃদয়-গম্য করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হয়। ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাসাদি মহাপ্রতিভাশালী কবিকূলের পক্ষেই মানব-চরিত্রকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভবপর হয়েছে।

সুতরাং সাহিত্যের বিষয় শুধু মানব-হৃদয় নয়, মানব-চরিত্রও বটে। বাইরের জগৎ আর অন্তরের জগৎ, মানব-হৃদয় আর মানব-চরিত্র—সব মিলে মিশে যে এক বিচিত্র জগৎ সৃষ্টি করে চলছে নিরন্তর, চিত্র ও সঙ্গীতের সাহায্যে কল্পনাপ্রবণ কবি তাকেই সাহিত্যে রূপদান করে থাকেন।

বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে, মানব চরিত্রের মধ্যে—এক কথায় যে সমস্ত বিষয়কে আমরা সাহিত্য রচনার উপাদান-রূপে গ্রহণ করি, তার সর্বত্রই ভগবানের আনন্দ আপনাকে আপনি সৃষ্টি করে চলেছে। তেমনিভাবে মানুষের হৃদয়ও আপনাকে নানাভাবে সৃজন করবার, ব্যক্ত করবার প্রয়াস পাচ্ছে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। ভগবানের সৃষ্টিলীলার প্রকাশের মতোই কবিরও নিয়ত সৃষ্টি-লীলার প্রয়াস—এইজন্যই বলা হয়—’কবিরেব প্রজাপতিঃ’—কবিরা প্রজাপতি ব্রহ্মার ন্যায় স্রষ্টাপুরুষ। এই সৃষ্টিরহস্য বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে, ভগবানের আনন্দ-সৃষ্টি যেমন আপনার মধ্য থেকে আপনি উৎসারিত হচ্ছে, তেমনি তারি প্রতিধ্বনি লক্ষিত হয় মানব-হৃদয়ের আনন্দ সৃষ্টিতে। জগৎ-সৃষ্টির আনন্দগীতের মূর্ছনা আমাদের হৃদয়-তন্ত্রীতে যে অনুকম্পনের সৃষ্টি করে, সাহিত্যের মধ্যে তারই বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বের নিঃশ্বাস মানবের চিত্তবংশীতে যে রাগিণী ধ্বনিত করছে, সেটাই ফুটে উঠছে সাহিত্যে। তাই সাহিত্যকে বিশেষের রচনা বা রচয়িতার রচনা মনে করা সঙ্গত নয়—এটি দৈববাণী। বিশ্বস্রষ্টার সানন্দসৃষ্টির প্রতিঘাতেই আমাদের মনের মধ্যে যে সৃষ্টির আবেগ জন্মগ্রহণ করে, তারই সার্থক রূপায়ণ যখন সাহিত্য, তখন তার মধ্য দিয়ে তো সেই বিধাতাপুরুষের আনন্দধ্বনিই প্রকাশ লাভ-একে আমরা আমাদের অর্থাৎ কোনও ব্যক্তি-মানসের সৃষ্টি বলে কোন অধিকারে গ্রহণ করবো। এ যে ভগবানেরই দান, তাঁরই বাণী বহন করে আসছে যুগ যুগ ধরে বিশ্বের যত সেরা সাহিত্য। কবি রবীন্দ্রনাথ এই সাহিত্যসৃষ্টি তথা দৈববাণী সম্বন্ধে বলেন, “বহিঃসৃষ্টি যেমন তাহার ভালোমন্দ তাহার অসম্পূর্ণতা লইয়া চিরদিন ব্যক্ত হইবার চেষ্টা করিতেছে, এই বাণীও তেমনি দেশে দেশে ভাষায় ভাষায়, আমাদের অন্তর হইতে বাহির হইবার জন্য নিয়ত চেষ্টা করিতেছে।” বিশ্বের তাবৎ সৃষ্টিকার্যে যে সুর ধ্বনিত হচ্ছে তারি প্রতিধ্বনি আমাদের সাহিত্যে। এই দৈববাণী’ তথা দৈবপ্রেরণা বিষয়ে মহামতি প্লাতো তাঁর The Republic গ্রন্থেও প্রায় অনুরূপ মন্তব্যই প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “For all good poets, epic as well as lyric, compose their beautiful poems not by art, but because they inspired and possessed… so the lyric poets are not in their mind when they are composing their beautiful strains.”