আত্মপ্রকাশই কবির ধর্ম। ‘নীরব কবিত্ব’ এবং ‘আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস’ অর্থহীন বাক্চাতুরী মাত্র। বক্তার মনোগত ইচ্ছা যদি নিজের মনের মধ্যেই সংগোপনে লুক্কায়িত থাকে, তবে অপরের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়, তার বিচারও সম্ভব নয়। অথচ মনের ভাবের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই এই যে, সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করতে চায়। মনের ভাবকে প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, তাকে দেশ-কালের ব্যবধান অতিক্রম করতে হয় বলে নানাপ্রকার লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং নানা প্রকার উপকরণের সাহায্যে তাকে স্থায়ী রূপ দিতে চিরকাল চেষ্টা করা হয়ে আসছে। সম্রাট অশোক এই উদ্দেশ্যে তাঁর বাণীকে পাথরে খোদাই করে রেখে গেছেন। চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, স্থপতি কিংবা সাহিত্যিক—প্রত্যেকেই নিজের হৃদয়ের ভাবকে অপরের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দিয়ে অমরতা লাভ করতে চান।
এই চিরকালীন অমরতা লাভের জন্য যে উপায় অবলম্বন করা হয়, তা ক্ষণকালীন প্রয়োজনের উপায় থেকে পৃথক্। যেমন আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানোর জন্য ধান-গম-যবের বীজ বুনি, কিন্তু চিরকালের অরণ্যসৃষ্টির জন্য বনস্পতির বীজের সন্ধান করি। আমাদের জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। তাই সাহিত্যে সারবান তথা জ্ঞানের কথাও বলতে হয়। কিন্তু জ্ঞানের জিনিষ একবার জানলেই তা পুরাতন হয়ে যায়, তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। যেমন, আগুন গরম অথবা সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয়— এইসব জ্ঞানের কথা একবার জানাই যথেষ্ট, কিন্তু পূর্বাকাশে সূর্যোদয় দর্শনে মনে যে সৌন্দর্যের ভাব জাগে, তা প্রতিদিন দর্শনেও পুরানো হয় না, বরং তা নিত্য নবীন রূপে আবির্ভূত হয়। প্রকৃত সাহিত্যের অবলম্বন তাই জ্ঞানের বিষয় নয়, ভাবের বিষয়। জ্ঞানের বিষয় বড় স্বল্পস্থায়ী: নোতুন জ্ঞানের উদয়ে পুরাতন জ্ঞান পরিত্যক্ত হয়। কিন্তু ভাবের বিষয় যত পুরাতন হয়, ততই তার গভীরতা বৃদ্ধি হয় এবং তা একটা শাশ্বত সনাতন রূপ লাভ করে।
ভাবের সাহিত্যকে স্থায়িত্বলাভের প্রয়োজনে নানাপ্রকার আভাস-ইঙ্গিত বা ছলাকলার সাহায্য নিতে হয়। জ্ঞানের জিনিসকে যতজন যতরকম ভাবেই প্রকাশ করুন না কেন, তাতে বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না, কিন্তু ভাবের বিষয় আধার-ভেদেও রূপান্তর লাভ করতে পারে। তাই যিনি বিষয়টিকে যত সাজিয়ে গুছিয়ে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারবেন, সাহিত্য জগতে তারই জয়-জয়কার। যে কলাকৌশলের সহায়তায় ভাবের বিষয়কে প্রকাশ করতে হয়, সেই কলা-কৌশল যেন ভাবের দেহ। ভাষা-ব্যবহার, ছন্দ, অলঙ্কার আদির সাহায্যে ভাবের দেহকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়, কারণ দেহের প্রকৃতি ও গঠন অনুযায়ীই তার আশ্রিত ভাব অপরের নিকট আদৃত হতে পারে এবং সেই শক্তি-অনুসারেই সেই ভাব হৃদয়ে ও কালে ব্যাপ্তি লাভ করতে পারে। বস্তুতঃ এই দেহের আধারে ভাবের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই সাহিত্যিকের শক্তি ও ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।
ভাবের বিষয়, রচনার বিষয় কিংবা তত্ত্ব সার্বজনীন—এগুলি নিয়ে যে কেউ লিখতে পারে, একজন না লিখলেও আর একজন লিখবে। এতে লেখকের কোনো নিজস্বতা থাকে না। বাইরের জগৎ বস্তুময়—দশজন আলোক-চিত্রী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একই দৃশ্যের চিত্র গ্রহণ করলে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দুজন চিত্রশিল্পী যদি একই দৃশ্যের দুটি চিত্র অঙ্কন করেন, তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্টভাবেই অনুভূত হবে। কারণ চিত্রশিল্পীরাও সাহিত্যিকদের মতোই বাইরের জগৎকে মনের জারকরসে জারিত করে যে নোতুন জগৎ সৃষ্টি করেন, তাদের চিত্রে আভাসে ইঙ্গিতে সেই কল্পনাময় জগৎই পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কাজেই দুজনের রচনায়, তাদের দৃষ্টিতে সেই পার্থক্য নির্দেশিত হবেই এবং এই চিত্রের মাধ্যমেই শিল্পীদের মনো-জগতের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যাবে—মনের ভাব প্রকাশই চিত্রশিল্পীর উদ্দেশ্য, আর সাহিত্যিকেরও তাই। এই কারণেই, সামনে মরা গাছকে দেখতে পেয়ে বাস্তববাদী কবি সেই গাছের শুষ্কতাকে আভাষিত করবার জন্য কঠোর যুক্তব্যঞ্জনের অনুপ্রাসে তার বর্ণনায় বলেন, ‘শুদ্ধং কাষ্ঠং তিষ্ঠতাগ্রে’ : আর ভাববাদী কবি সেই মরা গাছকেও কোমলতর অনুপ্রাসের ব্যঞ্জনায় কারামণ্ডিত ভাষায় প্রকাশ করেন—’নীরসঃ তরুবরঃ পুরতঃ ভাতি। একই বিষয়ের এই দ্বিবিধ বর্ণনায় বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, কিন্তু বিশিষ্ট রচনাভঙ্গিই উভয় কবির স্বাতন্ত্র্য্যকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। কাজেই রচনার বিষয় কিংবা ভাব নয়, রচনার মধ্য দিয়েই কবি-স্বরূপকে উপলব্ধি করার সুযোগ পাওয়া গেল।
বস্তুতঃ পূর্বে যে কলা-কৌশল বা আভাস-ইঙ্গিতের কথা বলা হয়েছে তার মধ্য দিয়েই কবি সাহিত্যিকদের খুঁজে পাওয়া যায়। ভাব, বিষয় ও তত্ত্বের উপর সকলের নির্বিশেষ অধিকার রয়েছে বলেই ভাবের মধ্যে বা বিষয়ের মধ্যে সাহিত্যিকদের বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হবার অবকাশ পায় না। ভাষা, ছন্দ, অলঙ্কারাদি বিভিন্ন উপকরণের সাহায্যে যে ভাবের আধার কাব্যদেহটি নির্মাণ করা হয় কবি-ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে তার মধ্য দিয়েই। এই কাব্যদেহের গঠন তথা রচনা প্রত্যেকেরই নিজস্ব, একজনের সঙ্গে অপরের মিল নেই। যেমন ‘বর্ষা’কে অবলম্বন করে কত শত কবিই তো কত শত কাব্য রচনা করে গেছেন, তবু এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে কালিদাস কিংবা রবীন্দ্রনাথের কথাই সর্বপ্রথম মনে আসে কেন? নিশ্চয়ই তা বিষয়ের জন্য নয়, তা রচনার জন্যই। এই কারণেই বলা হয় যে, লেখক তাঁর রচনার মধ্যেই যথার্থরূপে বেঁচে থাকেন, ভাবের বা বিষয়ের মধ্যে নয়।
Leave a comment