আমরা যে সাহিত্য পাঠ করে পরম আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠি, তা কোনো বিশ্ব-জগৎ-নিরপেক্ষ কবি-পরিকল্পনার সৃষ্ট মায়ার জগৎ নয়। এটি বস্তুতঃ সাবয়ব বিশ্বজগতেরই এক প্রতিরূপ, যার প্রতিফলন ঘটেছে কবির মনোজগতে। এই পরিদৃশ্যমান বহির্জগৎ আমাদের মনের মুকুরে ছায়া ফেলে; কেউ কেউ প্রকৃতি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েই তাকে ভুলে যায়, আবার কারো মনের উপর ছায়া দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। যাঁরা কল্পনাপ্রবণ মানুষ, যাঁরা শিল্পী, তাঁরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সেই বহিঃপ্রকৃতিকে আপনার মনোজগতে নোতুনভাবে রূপায়িত করেন এবং তাকেই শিল্প-সাহিত্যে প্রকাশ করে থাকেন। অতএব শিল্প-সাহিত্যের বিষয় যে প্রকৃতি, অথবা ধরে নেওয়া যাক্, মানব চরিত্র, তা কোনো ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব নয়; এই প্রকৃতি বা মানব-চরিত্রের উপর সর্বজনের সমান অধিকার, অতএব রচনার বিষয়বস্তু সার্বজনীন তথা সাধারণেরই হয়ে থাকে। এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রকৃতি কিংবা মানব-চরিত্রকে সাহিত্যের একটি বিষয়রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু অপর যে কোনও বিষয়, ভাব বা তত্ত্ব—যাকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচিত হয়ে থাকে, তার কোনটাই লেখকের নিজস্ব নয়। অতএব সাহিত্যের বিষয় বা ভাবের জন্য কোনো সাহিত্যিককে কৃতিত্বের অধিকারী বলা যায় না, তিনি যথার্থ কৃতিত্বের অধিকারী বলে স্বীকৃত হয়ে থাকেন সেই বিষয় বা ভাবকে প্রকাশের জন্য। লেখকের নিজস্বতার পরিচয় পাওয়া যায়, তাঁর প্রতিভার কিংবা অনন্যতার চিহ্ন মুদ্রিত হয় যে উপায়ের সাহায্যে তিনি ভাবকে প্রকাশ করেন, তা থেকেই। রবীন্দ্রনাথ একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে দিঘি বলতে জল এবং খনন করা—উভয়কেই বুঝিয়ে থাকে। যদিও এর মধ্যে প্রয়োজনের সামগ্রী হলো জল এবং জলের জন্যই দিঘিটি খোঁড়া হয়েছে, কিন্তু এই জলের জন্য দিঘির খননকর্তার কোনো কৃতিত্ব নেই। জল মানুষের সৃষ্টি নয়, জল চিরন্তন, কিন্তু কোনো কীর্তিমান মানুষ সর্বসাধারণের ভোগের জন্য দিঘিকে খনন করে সেই জলকে অপরের নিকট সহজলভ্য করে দিলেন। অর্থাৎ যে জল পূর্বেও ছিল খনন-কর্তা তাকে সর্বসাধারণের নিকট পৌঁছে দিয়েই কৃতিত্বের ভাগী হলেন, সাহিত্যের ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। বিষয়, ভাব বা তত্ত্ব—এটিই বরাবরই ছিল এটি সর্বসাধারণেরই অধিকারভুক্ত: লেখক শুধু তাকে নোতুনভাবে আবিষ্কার করে তাদের নিকট সহজলভ্য করে পৌঁছে দিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ভাব সেইরূপ মনুষ্য সাধারণের, কিন্তু তাহাকে বিশেষ মূর্তিতে সর্বলোকের বিশেষ আনন্দের সামগ্রী করিয়া তুলিবার উপায় রচনাই লেখকের কীর্তি।”

সাহিত্যের স্রষ্টা বাস্তব জীবন বা বহির্জগৎ থেকেই তাঁর সাহিত্যের উপকরণ গ্রহণ করে থাকেন। প্রাচীন আলঙ্কারিকগণ মনে করেন যে বিভাব-অনুভাব আদির সহায়তা গ্রহণ করে কবি বা সাহিত্যিক এই বস্তুজগৎকে নিজের অন্তরে ভাবের জগতে রূপান্তরিত করেন। কবি এক অপরূপ প্রক্রিয়ায় তাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের মনের জারক রসে জারিত করে তাকে বাইরের জগতে সাহিত্যের আকারে প্রকাশ করেন। অতএব যা এতকাল বহির্জগতের তথা বস্তুজগতের বিষয়রূপে ছিল সর্বসাধারণের বিষয়, কবি তাকে মনোজগতে আত্মস্থ করে নিজস্ব বিষয় করে নিলেন। এই প্রক্রিয়ায় কবি কল্পনা, অনুভূতি এবং মননের সাহায্য নিয়ে থাকেন। এবং তারপর যখন ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কারাদি এবং বিবিধ কলা-কৌশলের সহায়তায় সেই আত্মগত ভাবকে আবার সাহিত্যরূপে প্রকাশ করেন, তখনই তা সর্বসাধারণের হয়ে দাঁড়ায়। এই সাহিত্যের মধ্য দিয়ে এক ব্যক্তি মানুষের হৃদয় অপর হৃদয়ের মধ্যে অমরতার প্রার্থনা করে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ আর একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে ব্যাপারটিকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। জলে-স্থলে-আকাশে-বাতাসে সর্বত্র অঙ্গার বা কার্বন বর্তমান রয়েছে, এটাকে সাধারণভাবে সাধারণের বিষয় বলে গণ্য করা চলে। কিন্তু গাছপালা তাদের নিগূঢ় শক্তির প্রভাবে এই সাধারণ অঙ্গারকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিজস্ব করে নেয় এবং সেই উপায়েই আবার তাকে সর্বসাধারণের ভোগের দ্রব্যে পরিণত করে। সেই অঙ্গার যে শুধু আমাদের আহার্য বস্তু রূপে অথবা উত্তাপরূপে ব্যবহৃত হয়, তা নয়, রবীন্দ্রনাথের কথায়, “তাহা হইতে সৌন্দর্য ছায়া স্বাস্থ্য বিকীর্ণ হইতে থাকে।” সাহিত্যের কাজও অনুরূপভাবে সর্বসাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করে সেই উপায়েই তাকে পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করে তোলা। তবে জ্ঞানের বিষয় যাকে সত্য বলে অভিহিত করা হয়, তা ব্যক্তি-নিরপেক্ষ বলে তার উপর বিচিত্র হৃদয়ের নোতুন নোতুন রঙের ছায়াপাতের সম্ভাবনা নেই, তাই জ্ঞানের বিষয়কে সাহিত্য বলা চলে না।