সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর: মানুষের জ্ঞানের আধার হিসাবে বিজ্ঞানশাস্ত্রসমূহের কথা বলা হয়। মানুষের চিন্তাভাবনার যুগযুগান্তরের ফসল সঞ্চিত আছে বিজ্ঞানশাস্ত্রসমূহের মধ্যে। বিজ্ঞানশাস্ত্রগুলো দুভাগে বিভক্ত : প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (Natural Sciences) এবং সামাজিক বিজ্ঞান ( Social Sciences)। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কাজ হল বস্তু-বিশ্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক আলোচনা এবং পার্থিব উপকরণগুলির স্বরূপ নির্ধারণ। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসাবে পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূবিদ্যা প্রভৃতির নাম করা যায়। অপরদিকে সামাজিক বিজ্ঞানে সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনধারার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ধনবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতির নাম করা যায়। সামাজিক বিজ্ঞানে মানবজীবন ও মানবসমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। সামাজিক বিজ্ঞান মানবীয় বিজ্ঞান (Human Science) হিসাবেও পরিচিত।
সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল অন্যতম একটি সামাজিক বিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার মুখ্য বিষয় হল মানুষ ও রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রই হল সমাজবদ্ধ মানুষের সমাজ-জীবনের এক চরম অভিব্যক্তি। সেইজন্য মানব জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে যত বিজ্ঞান আছে সকলের সঙ্গেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিকট সম্পর্ক বর্তমান। বস্তুত কোন সামাজিক বিজ্ঞানই স্বতন্ত্রভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; একে অপরের পরিপূরক, পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই প্রসঙ্গে সিজউইক (Sidgwick)-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে কোন শাস্ত্র সম্পর্কে সঠিক ও পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে হলে অন্যান্য শাস্ত্রের সঙ্গে সেই শাস্ত্রের সম্পর্ক ভালভাবে অনুধাবন করতে হবে। এও আবার দেখতে হবে, কোন্ শাস্ত্র অন্যান্য শাস্ত্র থেকে কি নিয়েছে এবং তাদের কি দিয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কেও এ কথা পুরোপুরি খাটে।
মানুষ ও মানবসমাজের বহু ও বিভিন্ন দিক নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের আলোচনার পরিধি পরিব্যাপ্ত। সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের সংখ্যা অনেক এবং ক্রমশ বাড়ছে। অর্থবিদ্যা, মনোবিদ্যা, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের পরিবারের মধ্যে অন্যতম এক নবীন সদস্য হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। মুখ্য বিষয় মানুষ ও মানবসমাজ হলেও প্রতিটি সামাজিক বিজ্ঞান স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর কারণ আছে। মানুষের জীবনধারার বহু ও বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে প্রতিটি সামাজিক বিজ্ঞান স্বতন্ত্রভাবে তার আগ্রহের বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানী তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়টির সম্যক বিচার বিবেচনার জন্য ধারণাগত এক স্বতন্ত্র সাহায্য গ্রহণ করেন। প্রতিটি সামাজিক বিজ্ঞানের পৃথক প্রকৃতির নিজস্ব অনুশীলন পদ্ধতি আছে। সামাজিক বিজ্ঞানমাত্রেরই স্বতন্ত্র ও নিজস্ব আগ্রহের এলাকা ও বিষয় আছে, আছে নিজস্ব ধ্যান-ধারণার সমষ্টি এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এসব কথা সাধারণভাবে সত্য। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অনুসন্ধান ও আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার আলোচনার হাতিয়ার স্বরূপ নিজস্ব ধারণা স্থির করে, বিষয়বস্তু আলোচনার পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভাবন করে এবং প্রয়োজনমত তার বিকাশ সাধন করে। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানও এভাবেই তার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ করে।
প্রতিটি সামাজিক বিজ্ঞান মানুষের জীবনধারার বিশেষ ও নির্দিষ্ট একটি দিক নিয়ে কাজ করে। অর্থাৎ মানবজীবনের এক একটা অংশকে নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে এক একটি সামাজিক বিজ্ঞানের। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এ কথাটি সাধারণভাবে প্রযোজ্য। সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবনই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপজীব্য বিষয়। এ প্রসঙ্গে গ্রীক মনীষী অ্যারিস্টটলের একটি উক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই আদিগুরু বলেছেন ‘মানুষ রাজনীতিক জীব’। মানুষের রাজনীতিক জীবনই হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। সাধারণত মানুষেরা রাজনীতিক জীবনধারার মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ও অনুসন্ধানের বিষয়াদি সীমাবদ্ধ থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মানুষের রাজনীতিক জীবনের বিভিন্ন বিষয় ও দিক নিয়ে অনুসন্ধান ও আলোচনা করা হয়। এই সমস্ত বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাষ্ট্র ও সরকার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, রাজনীতিক দল ও স্বার্থগোষ্ঠী, গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র, অধিকার ও স্বাধীনতা, রাজনীতিক সংস্কৃতি, বিরোধ ও বিরোধের মীমাংসা প্রভৃতি সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত বহু ও বিভিন্ন বিষয়।
সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান হল গতিশীল প্রকৃতির। মানুষের রাজনীতিক জীবনের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। তাছাড়া মানুষের রাজনীতিক জীবন বিশেষভাবে গতিশীল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বিশেষভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আধুনিককালে মানুষের রাজনীতিক জীবনের সমস্যাদি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারফলে মানুষের রাজনীতি ক্রিয়াকর্মের পরিধি প্রসারিত হচ্ছে এবং রাজনীতিক চিন্তাভাবনা অধিকতর বিকশিত হচ্ছে। স্বভাবতই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু বিরতিবিহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তুত কোন সামাজিক বিজ্ঞানেই চরম সত্য বলে কোন তত্ত্ব নেই। অন্যতম সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এ কথা সমভাবে প্রযোজ্য। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানও হল একটি গতিশীল সামাজিক বিজ্ঞান। মানুষের সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি পরিমার্জিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। তারফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণার বিবর্তন ঘটেছে ও ঘটছে।
আজ থেকে প্রায় হাজার দুই বছর আগে গ্রীস দেশে সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবন নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এই ঘটনার সঙ্গে প্লেটো ও অ্যারিস্টটল এই দুই গ্রীক দার্শনিকের নাম সংযুক্ত। অতঃপর কালের ও সমাজের পরিবর্তনের ধারায় সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রকৃতি-পরিধি সম্পর্কিত ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন আজও অব্যাহত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, বিষয়বস্তু অনুশীলনের পন্থা-পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত। এ ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের মূলে আছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় সম্পর্কে বিতর্ক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা রাষ্ট্র ও রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি যে সমস্ত সামাজিক ও অ-আনুষ্ঠানিক উপাদান রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয়াদিকে প্রভাবিত করে, সেগুলি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রাধান্য পাবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদিগুরু অ্যারিস্টটলের আলোচনায় বিভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থায় সামাজিক মর্যাদা ও সম্পদের বণ্টনের বিষয় আছে। মার্কস-এঙ্গেলস এবং লেনিন স্তালিন ও মাও সামাজিক শ্রেণী-কাঠামো ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবদ্ধ মানুষের রাজনীতিক জীবন ও তার পরিবর্তনের প্রকৃতি প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। মার্কসবাদী চিন্তাবিদ্রা সমাজের অর্থনীতিক বনিয়াদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনীতিক উপরি-কাঠামোর প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন।
সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার স্বাতন্ত্র্য ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও বিভিন্ন শাখার সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু সমাজতত্ত্ববিদের কথা বলা যায়। তাঁরা তাঁদের সমাজতাত্ত্বিক আলোচনার আনুষঙ্গিক বিষয় হিসাবে রাজনীতিক বিষয়াদির আলোচনার ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে প্যারেটো (Pareto), দ্যুরখাইম (Durkheim), মিচেলস (Michels), ওয়েবার (Weber) প্রমুখ সমাজতত্ত্ববিদদের কথা বলা যায়। ইউরোপের সমাজতত্ত্ববিদরা আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার ধারাকে উজ্জীবিত করেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ প্রভৃতি সমাজবিজ্ঞানীদের আন্তঃসমাজবিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনা ও গবেষণার সামিল হতে দেখা যায়। এই নতুন ধারার আলোচনার নেতৃত্বে আচরণবাদীদের অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। রাজনীতিক অর্থনীতি, রাজনীতিক সমাজতত্ত্ব, রাজনীতিক ইতিহাস প্রভৃতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই নয়া ধারার আলোচনার ঢেউ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজনীতিক আলোচনার উপর থেকে অস্পষ্টতার আবরণ অপসারণ করে স্বচ্ছতা সম্পাদনের চেষ্টা করা হয়। অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত রাজনীতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল; রাজনীতিক ক্রিয়াকলাপ ও আচার-আচরণ; আর্থ-সামাজিক পরিবেশ প্রভৃতি পর্যালোচনা ও অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, প্রক্রিয়া হিসাবে রাজনীতিকে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন আর্থার বেণ্টলে অ্যালমণ্ড, গ্রাহাম ওয়ালাস, রবার্ট ডাল, হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল, জর্জ ক্যাট্লিন, কার্ল ডয়েটস প্রমুখ।
আন্তঃ সমাজবিজ্ঞান কেন্দ্রিক আলোচনার প্রকৃতি ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় উল্লেখযোগ্য
-
(ক) ব্যাপকতর পটভূমিতে রাজনীতিক জীবনকে পর্যালোচনা করা;
-
(খ) সামাজিক প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে রাজনীতিক বিষয়াদির অনুধাবন করা;
-
(গ) কোন একটি শাস্ত্রের একক দৃষ্টিকোন থেকে নয় সামগ্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যার বিচার-বিশ্লেষণ করা;
-
(ঘ) অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতবাদ ও সমীক্ষাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ও সত্যাসত্য নির্ধারণ করা; এবং
-
(ঙ) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের সমীক্ষা, তত্ত্ব ও তথ্য এবং মডেল অনুসরণ করা।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সামগ্রিক বিচারে একটি যথার্থ সমাজবিজ্ঞান। আজকের রাষ্ট্রবিজ্ঞান কেবলমাত্র রাষ্ট্রের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বৃহত্তর সমাজের বিবিধ চাহিদা ও সমস্যাদির পটভূমিতে বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্র অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত। রাজনীতি সমাজের সঙ্গে সম্পর্করহিত কোন ভাবনা নয়। বৃহত্তর সামাজিক সমস্যারই অভিব্যক্তি হল রাজনীতি। এ রকম ধ্যান-ধারণার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে। অধুনা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব, অধিকার ও কর্তব্য, জাতিগঠন, উন্নয়ন প্রভৃতি সব কিছুকেই সমকালীন সমাজ ও পরিবেশ-পরিমণ্ডলের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে আলোচনা করতে হয় এবং সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতির পটভূমিতে বিচার-বিবেচনা করতে হয়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল আলোচনার পরিধিগত ব্যাপকতা এবং প্রকৃতিগত গভীরতা। আচরণবাদীদের অভিমত অনুযায়ী সমাজের যে কোন স্তরে রাজনীতিক কার্যাবলীর উদ্ভব হতে পারে। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমাজে গোষ্ঠীর ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। মার্কসবাদী চিন্তাবিদ্রা সমাজকাঠামোর অংশ হিসাবে এবং সমাজেরই উপরিকাঠামো হিসাবে রাজনীতিকে বিচার-বিবেচনা করেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পূর্ণ সমাজকাঠামোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে সামাজিক সমস্যাদির বিচার-বিবেচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। স্বভাবতই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এলাকায় সমাজবিজ্ঞানের বৃহত্তর ক্ষেত্রের অবদান অধুনা অনস্বীকার্য। লিপসেট্ (S. M. Lipset) তাঁর ‘Politics and Social Sciences’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন; “The Political scientists interested in political development has learned that he can not treat his topic without looking for the conditions of social mobilisation……”
আধুনিককালে রাজনীতির আলোচনা সামাজিক প্রক্রিয়ার আলোচনা হিসাবে পরিগণিত হয়। রাজনীতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া পরস্পরের পরিপূরক। সমাজ ব্যবস্থারই একটি উপকাঠামো হল রাজনীতিক ব্যবস্থা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি পেয়েছে। বিদ্যমান বাস্তব অবস্থা আজকাল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রাধান্য পায়। রাজনীতিক আচরণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবিজ্ঞানের উপাত্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান আদর্শ ও নৈতিক দর্শনের প্রভাব এবং মূল্যবোধযুক্ত সীমিত কাঠামোর ধারণাকে অতিক্রম করে বাস্তববাদী বিশ্লেষণমুখী ও তথ্যনিষ্ঠ হওয়ার পথে অগ্রবর্তী হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ‘বদ্ধ আলোচনা’ নয়, খোলা আলোচনা; রাজনীতিক ব্যবস্থা কোন ‘বদ্ধ ব্যবস্থা, খোলা ব্যবস্থা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অন্যান্য বিজ্ঞানের অবদান
অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান থেকে রাষ্ট্র-বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না: সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার আলোচনায় অধুনা বিশেষীকরণ ঘটেছে। এ কথা ঠিক। কিন্তু কোন সামাজিক বিজ্ঞানই পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। পরস্পরের সঙ্গে কোনো-না-কোনো ধরনের সম্পর্ক বর্তমান এবং বরাবরই ছিল। বরং সাম্প্রতিককালে এই সম্পর্ক অধিকতর সম্প্রসারিত। অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্ন মানবিক সমস্যাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞান পর্যালোচনা করে। সংশ্লিষ্ট সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে নিকট সম্পর্ক গড়ে উঠাই স্বাভাবিক। রাজনীতিক আচরণ ব্যক্তির সামগ্রিক আচরণের অংশমাত্র। মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমগ্র মানবসমাজকে একটি সামগ্রিক সত্তা হিসাবে ধরে নিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়াদির আলোচনা করেছেন। মার্কসবাদীরা সমগ্র সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার সুবাদে আধুনিক কালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিভিন্ন নতুন তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কিত তত্ত্ব যোগাযোগ তত্ত্ব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানকেন্দ্রিক আলোচনার প্রসারের ক্ষেত্রে কয়েকজন আধুনিক রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল, চার্লস মেরিয়াম, ট্যালকট পারসস, রবার্ট মার্টন, বুচানন প্রমুখ। ম্যাকেঞ্জী (W.J. M. Mackenzie) তাঁর The Study of Political Science Today গ্রন্থে অন্যান্য বিজ্ঞান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতানুসারে তা হলে চিন্তার বিকাশ ব্যাহত হবে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সামাজিক বিজ্ঞান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা ও গভীরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশেষীকরণের প্রভাব পড়েছে। এতদ্সত্ত্বেও ভিতরে ও বাইরে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সংহতি সাধনের দাবিকে উপেক্ষা করা যায়নি। এর কারণ হল সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনধারার জটিল জটাজালকে কেন্দ্র করেই সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের কাজকর্ম আবর্তিত হয়।
অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে সুস্পষ্ট শাস্ত্রীয় সীমারেখা টেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার বিকাশ ও অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানেরই একটি অন্যতম শাখা হল এই রাষ্ট্রবিজ্ঞান। শুরুতেই অর্থবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও গভীর। এই সমস্ত সামাজিক বিজ্ঞানের সাহায্য-সহযোগিতা ও অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিকশিত ও সমৃদ্ধশালী হয়েছে।
অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের অবদানে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমৃদ্ধ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাও উদ্দেশ্যমূলক। রাজনীতিক সমস্যাদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। না। এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রয়োজনীয় আলোচনা থাকে। আর এই ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সাহায্য-সহযোগিতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কাছে একান্তভাবে অপরিহার্য। অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের অবদানকে অবহেলা করে রাজনীতিক সমস্যাসমূহের বিচার-বিশ্লেষণ ও সমাধান এক কথায় অসম্ভব। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কাজকর্ম দেশবাসীর মধ্যে কি রকম প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তা জানা দরকার। তা জানার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মনোবিজ্ঞানের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি সামাজিক বিজ্ঞানের সাহায্যও একান্তভাবে অপরিহার্য। সরকারের রাজনীতিক ও অ-রাজনীতিক শাসকরা বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগ করেন। তাঁদের এই সমস্ত সামাজিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত ও জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত থাকা দরকার। অর্থনীতির জ্ঞান ছাড়া দেশের আর্থিক নীতি নির্ধারণ বা দেশের অর্থব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। শ্রমিক সমস্যার মত দেশের বিভিন্ন অর্থনীতি বিষয়ক সমস্যার সমাধানের জন্য অর্থনীতির জ্ঞান থাকা দরকার। ‘গেম থিওরি’ অর্থনীতির বিষয়। এই বিষয়টিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় প্রয়োগ করা হচ্ছে। তেমনি সমাজতত্ত্ব থেকে নেওয়া হয়েছে কার্যবিষয়ক তত্ত্ব বা ‘Action Theory’ এবং নৃতাত্ত্বিক সমাজতত্ত্ব থেকে নেওয়া হয়েছে ‘কাঠামো কার্যগত তত্ত্ব’ বা ‘Structural Functional Theory’। সমাজতত্ত্বের অবদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়ে বর্তমানে রাজনীতিক সমাজতত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিহাস ও ভূগোলের অবদান: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই ইতিহাস ও ভূগোলের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের মধ্যে দীর্ঘকালীন বহু আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক সমস্যা থাকে। এই সমস্ত সমস্যার যথাযথ সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া অনুধাবন করা দরকার। আবার দেশ ও দেশবাসীর রাজনীতিক জীবন ও শাসনব্যবস্থার উপর দেশের ভৌগোলিক অবস্থার ও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ভূগোলের জ্ঞান বিশেষভাবে সাহায্য করে। এই কারণে বর্তমানে ‘Geopolitics’ নামে একটি নতুন বিষয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
সকল সামাজিক বিজ্ঞানেই সামাজিক জীব হিসাবে মানুষই হল মুখ্য উপজীব্য বিষয়। এই কারণে সামাজিক বিজ্ঞানগুলিকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ দেখা যায়। কিন্তু কালক্রমে কেন্দ্রীয় বিষয়, দৃষ্টিভঙ্গি, অনুশীলন পদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদিতে পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য্যমূলক অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে জ্ঞান হল অখণ্ড একটি একক এবং জ্ঞান অবিভাজ্য। স্বভাবতই সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের আলোচনা আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানমূলক হওয়া আবশ্যক। এই কারণে আধুনিককালের সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আলোচনার প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ অধিক। সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যেও অনুরূপ প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে লিপস্টে (S. M. Lipset) তাঁর সম্পাদিত Politics and the Social Sciences শীর্ষক গ্রন্থের মুখবন্ধে মন্তব্য করেছেন:… (There) is almost no form of human behaviour which is not treated, to some extent, by each of the social sciences. Each varies only in its primary area of interest.”
ভৌত বিজ্ঞানের অবদান: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর বিভিন্ন ভৌত বিজ্ঞান ও জৈব বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনীতির পটপরিবর্তন ঘটেছে। আণবিক শক্তির বহুল ব্যবহার, মানবজাতির বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর আণবিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ার আশংকা, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়কে জাতীয় রাজনীতিতে বা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আর কোনক্রমে উপেক্ষা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আণবিক বিজ্ঞানের অবদানকে অবহেলা করা যায় না। এই আণবিক যুগে আণবিক বিজ্ঞানীর সাহায্য-সহযোগিতা রাষ্ট্রের কর্ণধার ও রাজনীতিক নেতাদের কাছে অত্যন্ত জরুরী।
প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাক্ষেত্রের পরিধি অতিমাত্রায় বিস্তৃত। এর বিষয়বস্তু বহু ও বিচিত্র। এই সমস্ত বিষয়ের অর্থবহ আলোচনার জন্য বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞানের সাহায্য-সহযোগিতা একান্তভাবে অপরিহার্য। অনুরূপভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু ভৌত বিজ্ঞানের (Physical Science) অবদানকেও অস্বীকার করা যাবে না।
Leave a comment