আইনগত দৃষ্টিভঙ্গীর মূল বিবেচ্য বিষয়: আইনগত দৃষ্টিকোণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। আইনানুগ কাঠামোর মধ্যেই এই দৃষ্টিভঙ্গি সকল আলোচনাকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়। আইনের দ্বারা গঠিত এবং স্বীকৃত সংস্থার মাধ্যমে রাজনীতিক জীবনের পর্যালোচনা করাই এই দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষ্য। আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি হল প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক (institutional) ও বর্ণনামূলক (descriptive)। আইনানুগ কোন প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোন বিষয়ের প্রতি ঐ ধারায় গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির মূল লক্ষ্য হল রাষ্ট্র ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইনগত প্রকৃতি, শাসনব্যবস্থার আইনগত ভিত্তি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সাংবিধানিক আইন ও সাধারণ আইনের ভিত্তিতে গঠিত প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের গঠন কাঠামো, ক্ষমতা ও কার্যাবলী এবং সরকারী কাঠামো ও আইনানুগ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক এই সমস্ত বিষয়ের আলোচনার উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংবিধান ও আইনের পটভূমিতে সরকারের বিভিন্ন কাঠামোর ক্ষমতা, কার্যাবলী ও কার্যপ্রক্রিয়ার উপর জোর দেওয়া হয়। আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির উপযুক্ত উদাহরণ হিসাবে জেনিংস (Ivor Jennings)-এর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ক্যাবিনেট সম্পর্কিত রচনাসমূহের কথা বলা হয়।

ইউরোপীয় দেশগুলিতে আইন ও রাজনীতির অধ্যয়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের একজন রাজনীতির ছাত্র আইনগত প্রতিষ্ঠানসমূহের আলোচনায় তার বেশীর ভাগ শক্তিকে ব্যয় করত। এবং ডাইসি-র Law of the Constitution পাঠ্যতালিকার প্রথম দিকে স্থান পেত।

যে-কোন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে অপরিহার্যভাবে আইন-বিভাগ, বিচার-বিভাগ, শাসন-বিভাগ, আমলাতন্ত্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান বর্তমান থাকে। মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মানুষের জীবনধারার রাজনীতিক দিকটি এবং রাষ্ট্রীয় কার্যপ্রক্রিয়া পর্যালোচনার স্বার্থে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অপরিহার্য। আইনানুগামী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া এই আলোচনা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে না। আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের এক্তিয়ার, কার্যাবলী ও ভূমিকা সম্পর্কে অনুপুঙ্খ আলোচনা করা হয়।

সমগ্র ইউরোপে এই আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই প্রাধান্য বজায় ছিল। ইংল্যাণ্ডের বিভিন্ন চিন্তাবিদ্ আইনের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এই শ্রেণীর লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পোলক (Pollock), মেইন (Henry Maine) , মেইটল্যান্ড (Maitland), ডাইসি (Dicey) প্রমুখ। ফ্রান্সে আইনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও বহুত্ববাদের আলোচনা পরিলক্ষিত হয়। যাজকীয়, রোমক ও জার্মান আইনের সাহায্যে জার্মানীতে জাতি, রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য সম্পর্কিত ধারণাসমূহ আলোচনার ধারা প্রচলিত ছিল। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতে আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্য ছিল।

সমালোচনা (Criticism): বর্তমানে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। আইন ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলি ত্রুটি বর্তমান।

(১) আইন ও সংবিধান সংক্রান্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে কোন সমাজের রাজনীতি সামগ্রিক প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে কেবলমাত্র দেশের আইনানুমোদিত রাজনীতির চরিত্র উপলব্ধি করা যায়। এই কারণে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি অসম্পূর্ণ ও সংকীর্ণ। আগেকার দিনে সরকারের তিনটি বিভাগ এবং নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হত। তাই তখন আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর ছিল। কিন্তু বর্তমানে আইনানুগ কাঠামোর বাইরে বহু ও বিভিন্ন বিষয়ে ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারা রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়। এই সবের মধ্যে রাজনীতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও পেশাদারী গোষ্ঠী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর কথা উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রনীতির উপর এদের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গিতে এ সব বিষয়ে আলোচনা করা হয় না। এই কারণে রাজনীতিক জীবনের সামগ্রিক পরিচয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে আইনানুগ কাঠামোর বাইরে যেতে হয়।

(২) আইন ও সংবিধান স্বয়ম্ভু নয়। এদের উৎপত্তি হয়ে থাকে আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা থেকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনীতির বিশ্লেষণের সময় এই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার বিবেচনা উপেক্ষিত থাকে। আইনের উৎপত্তি ও প্রকৃতি যে সমস্ত শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয় আলোচ্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের বিচার-বিবেচনা করা হয় না।

(৩) বলা হয় যে দেশের আইন ও সংবিধান বিশেষ ধরনের উৎপাদন ও শ্রেণী-সম্পর্ককে বজায় রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু আইন সর্বজনীন ভাষায় বিবৃত হয়ে থাকে। ফলে, আইন ও সংবিধানের আইনগত বিশ্লেষণের থেকে রাষ্ট্রের এই শ্রেণীচরিত্রের উপলব্ধি সম্ভব নয়। 

(৪) আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক ও রাজনীতিক পরিবর্তন ও তার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। যে-কোন সমাজেই নির্দিষ্ট ধরনের আইনের এক কাঠামো গড়ে উঠে। এর কারণ কি তার ব্যাখ্যা আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গিতে পাওয়া যায় না।

(৫) রোমক আইনের প্রাধান্য এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সার্বভৌমিকতা এই দুটি বিষয় আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির দুটি উল্লেখযোগ্য উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এ দুটি বিষয়ই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এই কারণে বর্তমানে আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি তার প্রাসঙ্গিকতা বহুলাংশে হারিয়ে ফেলেছে। 

(৬) বিংশ শতাব্দীর আধুনিক সমাজব্যবস্থায় আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গিটি বহুলাংশে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। তার ফলে ভিত্তি উপরিকাঠামো সমেত সমগ্র সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তিত অবস্থায় আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে সমকালীন রাষ্ট্রনীতির প্রকৃতি পর্যালোচনা অসম্ভব।

মূল্যায়ন (Evaluation): সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে আইনের সম্পর্ক বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় তাই আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আইনের প্রভাব একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এখনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।