রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের সামগ্রিক পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির কতকগুলি সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়।

(১) বাস্তববাদী নয়: এই বিশ্লেষণ ধারায় রাজনীতিক বিষয়াদি ও সমস্যাগুলিকে বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করা হয় না। পূর্বনির্ধারিত অনুমান ও কাল্পনিক চিন্তার ভিত্তিতে রাজনীতির আলোচনা করা হয়। কেবলমাত্র নৈতিক মানদণ্ডে রাজনীতিক সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়। সুতরাং‌ এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তববাদী নয়। 

(২) অসম্পূর্ণ: এই দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক বিষয় যেমন, জনমত, রাজনীতিক দল, রাজনীতিক সংস্কৃতি, স্বার্থগোষ্ঠী, ভোট সম্পর্কিত আচরণ প্রভৃতি এই দৃষ্টিভঙ্গির আওতায় আসে না। সুতরাং এই দৃষ্টিভঙ্গি অসম্পূর্ণ।

(৩) বিজ্ঞানসম্মত নয়: এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবসমাজের ভিতরকার সামাজিক ও আর্থিক শক্তিকে মোটেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক (institutional) এবং বর্ণনামূলক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই এই আলোচনা বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হয় না।

(৪) প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক: ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক। এ ধরনের আলোচনায় কেবল উন্নত রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানসমূহই স্থান পেয়েছে। অনুন্নত দেশগুলির রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে।

(৫) আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানমূলক আলোচনাকে অবহেলা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হলে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা সম্বন্ধে আলোচনা করা দরকার। কারণ কোন সামাজিক বিজ্ঞানই স্বতন্ত্রভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানমূলক আলোচনাকে এড়িয়ে চলে। 

(৬) সংকীর্ণ: ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি জাতীয় রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সংকীর্ণ আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির আলোচনাকে এখানে কার্যতঃ উপেক্ষা করা হয়। এই কারণে এই দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট।

(৭) ব্যক্তি ও ব্যাক্তিগত আচরণকে উপেক্ষা: এই দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত আচার-আচরণের বিচার-বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণকারীরা নিজেদের আবদ্ধ রাখে।

(৮) ঐতিহ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থার চাহিদা ও গতি-প্রকৃতি ধরা পড়ে না। অনুভব ও অন্তর্দৃষ্টির অভাব হেতু পরিবর্তনশীল সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন করা যায় না।

মূল্যায়ন: বিষয়বস্তু অতি সরলীকরণ পরম্পরাগত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসাবে বিবেচিত হয়।

বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে দার্শনিক, ঐতিহাসিক বা আইনগত সমালোচনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এখনও আইন, শাসন ও বিচার-বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সংগঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সংক্রান্ত বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস্, মেকিয়াভেলী প্রমুখ চিন্তাবিদদের বিশ্লেষণ ধারার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। আগামী দিনের রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রেও এই সমস্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অবদানের আবেদনকে অস্বীকার করা যাবে না। তা ছাড়া বর্ণনাত্মক ও প্রতিষ্ঠানগত পদ্ধতির মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রভাব বর্তমান। বল বলেছেন: “The strongest legacy that philosophy, history and law have bequeathed to the study of politics is in the field of descriptive and institutional approaches.” বলের আরও অভিমত হল: “The classical political theorists are still important even in regard to the nature of the questions they posed and certainly ignorance concerning them would isolate any student of politics from much of the communication that pass between Political Scientists.”