তাত্ত্বিক বিপ্লব: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগত ও আইনগত আলোচনা এবং বিভিন্ন কার্যাবলীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। বস্তুত বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সাবেকী রাজনীতিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে এক তাত্ত্বিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। চলে আসা আনুষ্ঠানিক ও বর্ণনামূলক বিশ্লেষণধারা বর্জন করে আন্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানের সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার এক আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটে। ইস্টন (David Easton) একে ‘তাত্ত্বিক বিপ্লব’ (theoretical revolution) হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সংহতি সাধন। এর লক্ষ্য ছিল আত্তঃ-সামাজিক বিজ্ঞানের সহযোগিতা (inter-disciplinary approach)। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ভৌত বিজ্ঞান ও অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা ও অগ্রগতিকে প্রয়োগ করা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে নতুন পন্থা-পদ্ধতি সৃষ্টি করা। এই নতুন বিশ্লেষণের-ধারা অনুসারে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গঠন করে সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের কথা বলা হয়। এই নতুন বিশ্লেষণ ধারায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুকে বিন্যস্ত ও পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা করা হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক আলোচনায় গণিত ও পরিসংখ্যানের কলাকৌশলের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

রাজনীতির চর্চায় চিরায়ত বিশ্লেষণ ধারার তত্ত্বগত ও পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতাগুলিকে অতিক্রম করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রয়োজন পূরণের জন্যই রাজনীতি চর্চার শেষে তাত্ত্বিক বিপ্লব ঘটে। এর উদ্দেশ্য হল রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ও প্রসার। রাজনীতি চর্চার এই ধারা আধুনিককালের গবেষণা ও আলোচনা পদ্ধতির অনুগামী। এই বিশ্লেষণ-ধারার গতি প্রকৃতি, ধ্যান-ধারণা, প্রবণতা ও প্রয়োগ পদ্ধতি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। তাই রাজনীতির এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। আবার রাজনীতির এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান শতাব্দীর নতুন চিন্তা ভাবনা, গবেষণা ও অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। এই কারণে রাজনীতি চর্চার এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবেও পরিচিত। জোহারী এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “…normati vism should be replaced by empiricism. Modern approaches are, therefore, marked by empirical investigation of the relevant data,” তা ছাড়া সাম্প্রতিককালে রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক কার্যাবলী এবং আচার-আচরণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (Behavioural Approach) হিসাবেও অভিহিত করা হয়।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত: এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব ঘটেছে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে। কিন্তু এই ধারা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে। আধুনিককালের মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার সঠিক স্বরূপ অনুসন্ধান করা যায় না। তাই বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিভিন্ন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বাস্তবধর্মী আলোচনার জন্য সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের রাজনীতিক আচার-আচরণ এবং রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর এর প্রভাব প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এই শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতির সাহায্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বাস্তববাদী আলোচনা সম্ভব।

অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল লক্ষ্য হল জ্ঞানার্জন; জ্ঞানার্জন, অর্থাৎ ঘটনার অনুধাবন। এই জ্ঞান যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণের দ্বারা ও অভিজ্ঞতার দ্বারা সমর্থিত। এই জ্ঞান হল বাস্তবধর্মী এবং তাই বিজ্ঞানসম্মত। এই জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়ায় মূল্যবিচারের কোন জায়গা নেই। যে কোন রাজনীতিক ঘটনা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত প্রমাণযোগ্য। এই সিদ্ধান্তের সত্যতা বা নির্ভুলতা পরীক্ষণযোগ্য। সমাজজীবনে সংঘটিত ঘটনাসমূহ প্রত্যক্ষ করা যায় এবং পরীক্ষা করে দেখা যায়। মূল্যবিচার কিন্তু পুরোপুরি আত্মবাদী। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মূল্যবিচার পরীক্ষণযোগ্য নয়। সমস্যার দ্বারা মূল্যবিচার পরিমাপযোগ্য নয়। মূল্যের সত্যতা নির্ধারণ বা বিজ্ঞানসম্মতভাবে তা প্রমাণ সম্ভবপর বিবেচিত হয় না। অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রাজনীতিক আচরণ ও ঘটনাসমূহ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথ্যাদি সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি সাধারণ সূত্র নির্ধারণ করতে পারেন। এই সমস্ত সাধারণ সূত্র বা সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণযোগ্য বা পরীক্ষণযোগ্য।

অভিজ্ঞতাবাদীদের মতানুসারে রাজনীতিক তত্ত্ব তথ্যভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ ও পরীক্ষণযোগ্য হওয়া দরকার। রাজনীতিক তত্ত্বের কাজ হল বিদ্যমান অবস্থা প্রত্যক্ষ ও পর্যালোচনা করা। ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তারজন্য প্রাথমিক তথ্যাদি সংগ্রহ বিজ্ঞানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাজনীতিক ঘটনাসমূহের তথ্যভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ দেয়। অতঃপর সাধারণ সূত্রের উদাহরণ হিসাবে সেগুলিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিক হল এ রকম সাধারণ ব্যাখ্যামূলক বিভিন্ন সূত্র গড়ে তোলা। বস্তুত অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্দেশ্য হল বাস্তব ঘটনাবলীর অনুশীলন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করা। অনুশীলন ও বিশ্লেষণের এই প্রক্রিয়ায় পরিহার করা হয় ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, ভাল-মন্দ, পছন্দ-অপছন্দ প্রভৃতি বিচার-বিবেচনাকে। এই রাজনীতিক উপাদানসমূহের মধ্যে উপযুক্ত বস্তুনিষ্ঠ সম্পর্ক নির্ধারণ করা যায় এবং রাজনীতিক ক্ষেত্র সম্পর্কে বিভিন্ন সাধারণ সূত্র গড়ে তোলা যায়। এই সমস্ত সাধারণ সূত্র সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়।

মুখ্য প্রবক্তা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের প্রবক্তা ও সদর্থকের সংখ্যা কম নয়। এঁদের মধ্যে কয়েকটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হলেন গ্রাহাম ওয়ালাস, আরথার বেণ্টলি, চার্লস মেরিয়াম, গাব্রিয়েল অ্যালমণ্ড, সিডনী ভার্বা, ডেভিড ট্রুম্যান, ভি. ও. কী, হাবার্ট সাইমন, জেমস্ কোলম্যান, জর্জ ক্যাট্‌ক্লিন, জি. বি. পাওয়েল, হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল, লুসিয়ান পাই, ডেভিড ইস্টন প্রমুখ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়াদির বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার ক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক বা সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে উপরিউক্ত অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

অভিজ্ঞতাবাদী রাজনীতিক চিন্তাবিদদের উদ্দেশ্য হল পর্যবেক্ষণযোগ্য রাজনীতিক আচরণ ও ঘটনাসমূহকে চিহ্নিত করা এবং তাদের নিয়মমাফিকতা নির্ধারণ করা। তারপর সাধারণ সূত্রাকারে সেগুলিকে ব্যক্ত করা। অভিজ্ঞতাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সাধারণ সূত্রাদির মাধ্যমে রাজনীতিক ঘটনাসমূহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়; ঘটনার গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে আগাম অনুমান করা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এই প্রক্রিয়ার সুবাদে বিজ্ঞানের মর্যাদা পেতে পারে। রবার্ট ডাল-এর মতানুসারে জাগতিক অধিকাংশ ঘটনাই নিয়মমাফিক সংঘটিত হয়। অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণের অনুমান অনুযায়ী এই বিশ্বসংসার অরাজকতাপূর্ণ নয়; এখানে নিয়মের শৃঙ্খলা বর্তমান। সংশ্লিষ্ট বিধি-নিয়মের কিছু কিছু সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব। প্রামাণিক তথ্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়ে থাকে যে, আগামী দিনের অনুরূপ অবস্থায় অভিন্ন নিয়ম কার্যকর হওয়া সম্ভব।

সাধারণ তত্ত্বগঠনের উপর জোর: অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আদর্শ ও মূল্যবোধকে পুরোপুরি বাতিল করার কথা বলা হয়। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এই শাস্ত্রটিকে বাস্তববাদী ও প্রাসঙ্গিক করে তোলার পক্ষপাতী। এই কারণে তাঁরা কল্পনাভিত্তিক বা অনুমান-নির্ভর আলোচনাকে বাতিল করার কথা বলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার জন্য অভিজ্ঞতাবাদীরা একটি সার্বজনীন বা সাধারণ তত্ত্ব (General Theory) গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত উপাদান-উপকরণ ও তথ্যাদি সংগ্রহ এবং সংগৃহীত উপকরণ ও তথ্যাদির বিন্যাস ও বিচার-বিশ্লেষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

হেতুবাদী তত্ত্ব: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার স্বার্থে একটি সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তোলাই হল। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য। অভিজ্ঞতাবাদীদের রাজনীতিক জ্ঞানকে অধিকতর সমৃদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা দরকার। তারজন্য একটি সার্বজনীন তত্ত্ব গড়ে তোলা অপরিহার্য। সংঘবদ্ধ জ্ঞানতত্ত্ব গঠন ব্যতিরেকে বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য জ্ঞান লাভ করা দুরূহ ব্যাপার। ইস্টন তাঁর The Political System গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে জ্ঞান মাত্রেই তত্ত্বভিত্তিক। এই কারণে রাজনীতিক জীবন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য তত্ত্ব গঠন অপরিহার্য। ডেভিড ইস্টনের কথায় এই তত্ত্ব হবে সর্বজনীন জ্ঞানের সর্বোচ্চ মান। অনুমানভিত্তিক বা কল্পনা-নির্ভর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনীতিক জীবনের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় না। রাজনীতিক জীবনের বিশ্বাসযোগ্য বা বাস্তব অবস্থা প্রতিপন্ন করার জন্য প্রয়োজন হল মানুষের আচরণ সম্পর্কিত তথ্যাদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। এই কারণে অনেকে অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বকে হেতুবাদী তত্ত্ব হিসাবে অভিহিত করার পক্ষপাতী। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী একমাত্র সঠিক তথ্যই রাজনীতিক বাস্তবতাকে প্রতিপন্ন করতে পারে। তাই তাঁরা প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহ, সংকলন ও বিচার-বিশ্লেষণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। অভিজ্ঞতাবাদীরা বাস্তব জীবন থেকে সংগৃহীত তথ্যাদির ভিত্তিতে গবেষণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব তত্ত্ব গড়ে তোলার পক্ষপাতী।

আরোহণমূলক পদ্ধতি: অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সকল বিজ্ঞানের মধ্যেকার সীমারেখাকে, বিশেষতঃ প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের ভিতরকার সীমারেখাকে বাতিল করার কথা বলেন। তাঁদের মতানুসারে আন্তঃ-সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক একটি পটভূমি গড়ে তোলা দরকার। এবং এর জন্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার উপর তাঁরা জোর দেন। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক বিষয়াদির গবেষণা, বিচার-বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরোহণমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করেন।

মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকার অস্বীকৃত: অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধহীন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুমানভিত্তিক বা কাল্পনিক নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা হল অভিজ্ঞতাবাদী তথ্যাদি সংগ্রহ, সংকলন, এবং সেগুলির বিন্যাস ও বিচার-বিশ্লেষণ। ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার এ ক্ষেত্রে অস্বীকৃত। সতর্কতার সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণার উপরই এ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়। রাজনীতিক আলোচনা ও তত্ত্ব গঠনের ক্ষেত্রে মূল্যবোধের ধারণার প্রয়োগকে অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্বীকার করা হয়েছে। অভিজ্ঞতাবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী মূল্যবোধ বা অগ্রাধিকারের ধারণা পূর্বনির্ধারিত ধ্যান-ধারণার দ্বারা রাজনীতিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাবের কারণে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও আলোচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজনীতিক বিষয়াদির গবেষণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত রাজনীতিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকার অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ, সংকলন ও বিশ্লেষণ অনুচিত। কারণ সে ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তববাদী তত্ত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অভিমত অনুযায়ী রাজনীতিক গবেষণা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারের দ্বারা যদি প্রভাবিত হয়, তা হলে বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব গঠন করা যাবে না। সে রকম ক্ষেত্রে যে তত্ত্ব গঠিত হবে তা হবে বাস্তবতা বর্জিত। এই কারণে অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বে মূল্যবোধের ধারণা ও অগ্রাধিকারকে অস্বীকার করা হয়।

বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্যসূচক দিকগুলি উল্লেখ করা দরকার। এই বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

  • অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বর্ণনামূলক আলোচনার পরিবর্তে একটি সাধারণ বা সর্বজনীন তত্ত্ব গঠনের উপর জোর দেন।

  • অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে আরোহণমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।

  • অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক তত্ত্বের উৎস হিসাবে ব্যক্তির আচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করার পক্ষপাতী। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের কার্যকলাপ ও বাস্তব আচরণের ভিত্তির উপর জোর দেওয়া হয়। 

  • কাল্পনিক রাজনীতিক বিশ্লেষণ ও অনুমান-নির্ভর তত্ত্বকে অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অস্বীকার করা হয়।

  • ভৌত বিজ্ঞানের গবেষণার ব্যাপক তাত্ত্বিক ভিত্তির পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে বৈজ্ঞানিক সত্ত্বাযুক্ত করে তোলার ব্যাপারে অভিজ্ঞতাবাদীদের আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়। 

  • অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ ও অভিজ্ঞতাকে প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। এই কারণে এই তত্ত্ব হল আন্তঃ সামাজিকবিজ্ঞানমূলক। 

  • অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব হল মূল্যবোধহীন বা মূল্যবোধবর্জিত এক তত্ত্ব।

সমালোচনা (Criticism): অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব সমালোচকদের হাত এড়িয়ে যেতে পারে নি। এই মতবাদেরও বিবিধ সীমাবদ্ধতা বর্তমান। সমালোচকরা এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে বিবিধ যুক্তির অবতারণা করেন। এক্ষেত্রে কতকগুলি যুক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(১) রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিমূর্তভাবে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন। কেবলমাত্র কতকগুলি কলাকৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণকেই বিজ্ঞানমনস্কতা বলে না; ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্ক নির্ধারণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের স্বচ্ছতা, যুক্তিনিষ্ঠা, বিষয়মুখিতা প্রভৃতি হল বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচায়ক।

(২) অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বে তথ্য সংগ্রহ, সংকলন ও বিন্যাসের উপর এবং বিষয়মুখিতার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তারফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্যই বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

(৩) সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব হল বিমূর্ত প্রকৃতির। কারণ এই তত্ত্বের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ও সমৃদ্ধি সাধন, রাজনীতিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন প্রভৃতির কারণ সম্যকভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায় না। 

(৪) অভিজ্ঞতাবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভৌত বিজ্ঞানের উপায় পদ্ধতি অনুসরণের ব্যাপারে অতিমাত্রায় আন্তরিক। কিন্তু এই পথে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সফল ও সার্থক কলে তোলা সম্ভব কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।

(৫) অভিজ্ঞতাবাদীরা সকল মূল্যবোধ সম্পর্কে অভিন্ন ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু সকল মূল্যবোধ সমজাতীয় নয়, তা হতেও পারে না। বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় বিদ্যমান মূল্যবোধের মধ্যে ব্যবধানের বিষয়টি বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। গণতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধ স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধ পৃথক প্রকৃতির।

(৬) অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বে মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারকে বাতিল করার কথা বলা হয়। কিন্তু সমালোচকদের মতানুসারে মূল্যবোধের বিবেচনা ব্যতিরেকে রাজনীতিক তত্ত্বের আলোচনা এক রকম অসম্ভব। রাজনীতিক তত্ত্বমাত্রেই কোন-না-কোনভাবে মূল্যবোধের ধারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়। সামাজিক ও রাজনীতিক ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ মূল্যবোধের ধারণাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। কারণ ব্যক্তিমাত্রেই মূল্যবোধ ও অগ্রাধিকারের ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করে। অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই পশ্চিমী উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই আদর্শ ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। আদর্শ রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে এই মূল্যবোধ তাঁদের প্রভাবিত করেছে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতাবাদীরাই মূল্যবোধের প্রভাবকে অতিক্রম করতে পারেন নি।

(৭) বাস্তব জীবনে ঘটনা ও মূল্য ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র করা সম্ভব হয় না। সুতরাং মূল্যনিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞান গড়ে তোলার উদ্যোগ অর্থহীন। ওয়েবার-এর মতানুসারে রাজনীতির অনুশীলনের মধ্যেই মূল্যের অস্তিত্ব বর্তমান। লিও স্ট্রাউস-এর অভিমত অনুযায়ী তথ্যভিত্তিক সূত্রাদির প্রমাণিকতা নির্ধারণের ব্যাপারে সকল রাজনীতিক তত্ত্বের মধ্যে মূল্যায়ন বর্তমান থাকে। সমাজবিজ্ঞানী বার্নার্ড ক্রিক-এর মতানুসারে রাজনীতিতে নৈতিক ও সচেতন উদ্দেশ্য থাকে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনীতিক ধ্যান-ধারণাসমূহ বাস্তবায়িত হয়। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্যের প্রতীক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। ডেরেক ফিলিপস্-এর অভিমত অনুযায়ী মূল্যবোধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকের অনুসন্ধানের বিষয় নির্ধারণকে প্রভাবিত করে এবং তথ্যাদির উৎস নির্বাচন ও অনুশীলনের পদ্ধতিকে প্রভাবিত করে। 

(৮) সমালোচকদের মতানুসারে রাজনীতির অনুশীলন থেকে মূল্যবোধের অবসান অভিপ্রেত নয়। রাজনীতি অনুশীলন সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সম্ভাব্য কল্যাণ সাধন করা দরকার। সুতরাং সে ক্ষেত্রে মূল্যবোধ থাকবেই। নোবেলজয়ী সমাজবিজ্ঞানী গান্নার মিরডাল মূল্যমানের উপর প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। লিও স্ট্রাউসের মতানুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞান মূল্য-নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার ভান করলে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার সমর্থক হিসাবে অধঃপতিত হওয়ার আশংকা থাকবে।

(৯) সমালোচকরা অভিজ্ঞতাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পুঁজিবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে অভিযুক্ত করেছেন। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল্যবোধ বর্তমানে হীনবল হয়ে পড়েছে। অভিজ্ঞতাবাদীরাই এই ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। 

(১০) সমালোচকদের অনেকের আরও অভিযোগ হল যে, মার্কিন সমাজব্যবস্থা মূল্যবোধহীনতার প্রতীক। এই মূল্যবোধহীন মার্কিন সমাজব্যবস্থারই ফসল হল এই অভিজ্ঞতাবাদী ধ্যান-ধারণা। 

(১১) মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের তীব্র বিরূপ সমালোচনা করেছেন। এই তত্ত্ব মানবসমাজের রূপান্তর ও ক্রমবিবর্তনের ধারণার পরিবর্তে রক্ষণশীলতা বা স্থিতাবস্থার ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে রাজনীতিক তত্ত্বমাত্রেই কোন-না-কোন মতাদর্শ ও মূল্যবোধের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। সমাজ নিরপেক্ষ ও মূল্যবোধহীন তত্ত্ব বাস্তবে অসম্ভব।

মূল্যায়ন: অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এ কথা অনস্বীকার্য। বহু বিরূপ সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রাজনীতিক চিন্তাজগতে অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অস্বীকার করা যায়। না। এই তত্ত্ব রাজনীতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নৃতনত্বের সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিক বিষয়াদির বিচার বিবেচনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাবাদ অভিনবত্বের আমদানি করে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। এই তত্ত্ব মানুষের বাস্তব জীবন ধারা থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করে। সংগৃহীত তথ্যাদিকে সংকলন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। গবেষণামূলক এই প্রক্রিয়া-পদ্ধতি অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বকে অধিকতর বাস্তবসম্পন্ন করে তুলেছে। অধিকাংশ চিন্তাবিদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন; কিন্তু রাজনীতিক ক্ষেত্রে মূল্যবোধের গুরুত্বকে স্বীকার করবেন। রাজনীতির গবেষণামূল্যকে তথ্য হিসাবে বিচার করতে হবে। তবে ব্যক্তিগত মূল্যবোধকে তিনি পরিহার করে চলার চেষ্টা করবেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথ্য ও মূল্যের মধ্যে পার্থক্য এবং পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের ব্যাপারে যত্নবান হবেন।