উদ্ভব: জীববিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব থেকে এই দৃষ্টিভঙ্গীর সৃষ্টি। জীববিজ্ঞানের ধারণা অনুসারে বলা হয় যে, প্রতিটি প্রাণিদেহে একটি বিশেষ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। আর এই ব্যবস্থাটি (System) হল পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াভিত্তিক উপাদানসমূহের যৌগ। মূলতঃ এই ধারণার ভিত্তিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ব্যবস্থাজ্ঞাপক তত্ত্বের (System theory) সৃষ্টি করেন ডেভিড ইস্টন। ব্যবস্থাজ্ঞাপক দৃষ্টিভঙ্গীর উৎপত্তির ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানী লড়হিগ ভন্‌ বার্টালানফাই (Ludwig Von Bertallanfy)-এর অবদান অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এই জীববিজ্ঞানীর ধারণা থেকেই এই দৃষ্টিভঙ্গীর সূত্রপাত ঘটে। তাঁর মতানুসারে ব্যবস্থা হল কতকগুলি উপাদানের সমাবেশ এবং এদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বা ঘাত-প্রতিঘাত বর্তমান। জীববিজ্ঞানের আঙ্গিনায় ব্যবস্থার ধারণার উদ্ভব হয়। কিন্তু সেখান থেকেই বিষয়টি সরাসরি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। জীববিজ্ঞান থেকে ব্যবস্থার ধারণা নৃতত্ত্বের পরিধিতে প্রবেশ করে। এ প্রসঙ্গে ম্যালিনাউস্কি (Malinowski) এবং র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন (Radcliff-Brown) নামে দুজন নৃতত্ত্ববিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁদের মতানুসারে একটি কাঠামো বা ব্যবস্থার মধ্যে বহু উপব্যবস্থা বর্তমান থাকে। নৃতত্ত্ব থেকে ব্যবস্থার ধারণা সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় এই ব্যবস্থাজ্ঞাপক বিশ্লেষণের ধারার প্রয়োগ শুরু করেন দুজন সমাজতত্ত্ববিদ। এঁরা হলেন ট্যালকট পার্সন্স এবং রবার্ট মার্টন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই তত্ত্বের প্রয়োগকর্তা হিসাবে ক্যাপলান (M. Caplan), বোল্ডিং (K. Boulding) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নাম প্রণিধানযোগ্য।

মূল লক্ষ্যসমূহ: ব্যবস্থাজ্ঞাপক বিশ্লেষণ ধারার কতকগুলি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের কথা বলা হয়। 

(১) এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রধান লক্ষ্য হল সমগ্র রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে এক সাধারণ তত্ত্বের অবতারণা। এই সাধারণ তত্ত্বের সাহায্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ব্যাখ্যা করা যাবে এবং রাজনীতিক ব্যবস্থা বিভিন্ন প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কিভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখে তাও বিশ্লেষণ করা যাবে। ইস্টন এই মতবাদ ব্যক্ত করেছেন ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত তাঁর The Political System শীর্ষক গ্রন্থে। ইস্টনের এই পদ্ধতি ‘অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি’ (Empirical method) হিসাবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ইস্টনের অপর দুটি গ্রন্থ A Framework of Political Analysis এবং A System Analysis of Political Life-ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(২) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে অধিকতর ব্যাপক করে তোলাই হল এই বিশ্লেষণধারার অন্যতম উদ্দেশ্য। ইস্টন বলেছেন: “A system analysis promises a more expansive more inclusive and more flexible theoretical structure than is available.”

(৩) ব্যবস্থাজ্ঞাপক বিশ্লেষণধারার আর একটি উদ্দেশ্য হল সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের মধ্যে সংহতি সাধন বা ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি। এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলা হয় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি বদ্ধ ব্যবস্থা (closed system) নয়। বিভিন্ন সামাজিক বিজ্ঞান ও ভৌত বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখার সঙ্গে এর সম্পর্ক বর্তমান। বর্তমান শতাব্দীর পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়ে আচরণবাদীদের মধ্যেও অনুরূপ চিন্তাধারার প্রসার পরিলক্ষিত হয়। সকল বিজ্ঞানের মধ্যেই কিছু সাধারণ বা সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গবেষণার জন্য একটি ব্যাপক ধারণাগত কাঠামো গড়ে তোলা যায়। এই বিশ্লেষণধারা আন্তঃবিজ্ঞানমুখী আলোচনার উপর জোর দেয়।

(৪) রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব সংরক্ষণ এবং তার সমস্যাদির আলোচনা ব্যবস্থাজ্ঞাপক দৃষ্টিভঙ্গী অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। রাজনীতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্যেও কিভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে তার উপরও এই বিশ্লেষণধারার জোর দেওয়া হয়। 

(৫) একটি অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠন করা ব্যবস্থাজ্ঞাপক দৃষ্টিভঙ্গীর একটি মৌলিক লক্ষ্য। অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠনের জন্য বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো দরকার। এই বিশ্লেষণের বিষয়বস্তু হল সার্বজনীন আচরণ। মানুষের আচরণের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনার দ্বারা এই বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো ও অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব গঠনের কথা বলা হয়।

‘ব্যবস্থা’-র ধারণা: ডেভিড ইস্টনের মতানুসারে ব্যবস্থাজ্ঞাপক বিশ্লেষণের ধারা হল একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী। ব্যবস্থাজ্ঞাপক দৃষ্টিভঙ্গীর কেন্দ্রীয় বিষয় হল ‘ব্যবস্থা’। ‘ব্যবস্থা’ বলতে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আবদ্ধ কতকগুলি উপাদান বা অংশের সমন্বয়কে বোঝায়। মর্টন ক্যাপলান-এর অভিমত অনুসারে ব্যবস্থাজ্ঞাপক বিশ্লেষণ হল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পরিবর্তনীয় (variables) বা উপাদানসমূহের সমষ্টি। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল-এর মতানুসারে ‘ব্যবস্থা’ হল বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং ব্যবস্থা ও তার পরিবেশের মধ্যে একটি সীমার অস্তিত্ব। ‘ব্যবস্থা’ এই ধারণার সঙ্গে বিভিন্ন উপাদানের সমাবেশ, উপাদানগুলির পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, প্রতিক্রিয়া, ব্যাপকতা এবং এক নির্দিষ্ট সীমানার প্রশ্ন সংযুক্ত থাকে। ব্যবস্থার উপাদানগুলি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। উপাদানগুলির কোন একটি পরিবর্তিত হলে অন্যগুলিও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এবং সামগ্রিকভাবে ‘ব্যবস্থাও’ তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েল তাঁদের Comparative Politics : A Developmental Approach শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “A system implies the interdependence of parts and a boundary of some kind between it and its enviornment.” তাঁদের আরও অভিমত হল : “When one variable in a system changes in magnitude or in quality, the others are subjected to strains and are transformed, the system changes its patterns of performance.”

রাজনীতিক ব্যবস্থার যৌগিক প্রকৃতি: যে-কোন ব্যবস্থার (system) প্রকৃতি হল যৌগিক। যৌগিক বস্তুর বৈশিষ্ট্য হল 

  • (১) বিভিন্ন অংশের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং 

  • (২) বস্তুটি ও তার পরিবেশের মধ্যে সীমারেখা। 

পারস্পরিক নির্ভরশীলতার জন্য বস্তুটির কোন একটি অংশের পরিবর্তন অন্যান্য অংশগুলিকে বা সামগ্রিকভাবে বস্তুটিকে প্রভাবিত করে। রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে বলা হয় যে, যে-কোন রাষ্ট্রনৈতিক ব্যবস্থা হল সমাজের অন্তর্ভুক্ত এইরকম এক পারস্পরিক নির্ভরশীল ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই বাধ্যতামূলক ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব বণ্টিত হয়। ইস্টন বলেছেন: ‘রাজনীতিক ব্যবস্থা হল এক পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে মূল্যের বাধ্যতামূলক এবং কর্তৃত্বসম্পন্ন বরাদ্দের কাজ সম্পন্ন করা হয়’ (“Political system is that system of interaction in any society through which binding or authoritative allocations are made.”)। সমাজের সকল রাজনীতিক কার্যাবলী এবং রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের গঠন, প্রকৃতি ও কার্যকলাপের সমন্বয়ে রাজনীতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বিয়ার ও উলাম (S. H. Beer & A. B. Ulam) তাঁদের Patterns of Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি বন্দোবস্ত বা ব্যবস্থাই হল রাজনীতিক ব্যবস্থা। অ্যালমণ্ড ও পাওয়েলের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা হল সেই ব্যবস্থা যার মধ্যে সকল রকম মিথষ্ক্রিয়া বর্তমান। এই সব মিথষ্ক্রিয়ার দ্বারা বিধিসম্মত দৈহিক পীড়নের প্রয়োগ বা প্রয়োগের হুমকি প্রভাবিত হয়। তাঁরা বলেছেন: “When we speak of the political system, we include all the interactions which affect the use or threat of use of legitimate physical coercion.” ডাল (Robert Dahl) রাজনীতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং প্রভাবের কর্তৃত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: “A political system as any persistent pattern of human relationships that involves, to a significant extent, control influence, power or authority.” ব্যবস্থাজ্ঞাপক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রবক্তাদের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা হল একটি ‘মুক্ত ব্যবস্থা’। রাজনীতিক ব্যবস্থা তার পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক ব্যবস্থার উপাদান যোগায় সামাজিক সমস্যাদি। তাই ইস্টনের মতানুসারে ব্যবস্থাজ্ঞাপক দৃষ্টিভঙ্গী সমস্যা-কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়ায়।

স্বয়ং-নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিবেদনশীল – বল বলেছেন: “Easton focussed his attention on the system, that is a pattern of related elements that are inter-dependent.” ইস্টনের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা স্বয়ং-নিয়ন্ত্রিত (self-regulated) ও প্রতিবেদনশীল (responding)। এই রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সমাজ-পরিবেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তবে রাজনীতিক ব্যবস্থা পরিবেশগত পরিবর্তনের চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে। তাই রাজনীতিক ব্যবস্থা হল স্বয়ং-নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিবেদনশীল।

রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহ

রাজনীতিক ব্যবস্থার কতকগুলি উপাদানের কথা বলা হয়। এগুলি হল: পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, ব্যাপকতা ও ব্যবস্থার সীমানা। বিয়ার ও উলাম রাজনীতিক ব্যবস্থা আলোচনার ক্ষেত্রে রাজনীতিক সংস্কৃতি, স্বার্থের ধাঁচ, নীতির ধাঁচ ও ক্ষমতার ধাঁচের কথা বলেছেন। রাজনীতিক ব্যবস্থার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন অ্যালমও।

(১) রাজনীতিক ব্যবস্থার সার্বজনীনতা: সকল সমাজেই রাজনীতিক ব্যবস্থা বর্তমান। এমনি জটিলতামুক্ত অতি সাধারণ সমাজব্যবস্থাতেও রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। 

(২) রাজনীতিক কার্যাবলীর সার্বজনীনতা: রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব সংরক্ষণের স্বার্থে নূন্যতম কতকগুলি কাজ করা দরকার। সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই অভিন্ন প্রকৃতির এই সমস্ত কাজকর্ম দেখা যায়। তবে এই কাজগুলি ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতিক কাঠামোতে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করা হয়। 

(৩) রাজনীতিক কাঠামোর সার্বজনীনতা: রাজনীতিক কাঠামো সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই বর্তমান। অ্যালমণ্ডের মতানুসারে রাজনীতিক কাঠামো হল মিথস্ক্রিয়ার (interaction) বৈধ বিধিসম্মত নমুনা। এর মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা সংরক্ষিত হয়। পশ্চিমের শিল্পোন্নত সমাজব্যবস্থার মত তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসর বা উন্নয়নশীল সমাজেও একই ধরনের রাজনীতিক কাঠামো দেখা যায়।

(৪) রাজনীতিক কাঠামোসমূহের বিবিধ কার্যাবলী: আদিম-আধুনিক নির্বিশেষে সকল রাজনীতিক কাঠামোতেই বহুবিধ কার্যাবলী বর্তমান। সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই সরকারের একটি বিভাগকে একাধিক কার্য সম্পাদন করতে হয়। বিচারকার্য সম্পাদনা করা ছাড়াও বিচার বিভাগকে আইন প্রণয়ন করতেও দেখা যায়। 

(৫) রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিতরে মিশ্র সংস্কৃতির অস্তিত্ব: সাংস্কৃতিক বিচারে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাই মিশ্র প্রকৃতির। এ ক্ষেত্রে আদিম ও আধুনিক এমন কোন ভাগ নেই। তবে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।