প্রহসন ঘটনাপ্রধান বলে চরিত্রের কোনো বিবর্তনরেখা অঙ্কিত হয় না। এখানে ঘটনাই প্রধান এবং চরিত্রগুলি টাইপধর্মী। ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র প্রধান চরিত্র নবকুমার, তাকে কেন্দ্র করেই প্রহসনের কাহিনী আবর্তিত এবং পরিণতিও তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই তৎকালীন নব্যবঙ্গ সমাজের অন্যতম প্রতিনিধি। এ প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশী তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে নরনারী’ গ্রন্থে বলেছেন— “একেই কি বলে সভ্যতার নায়ক নববাবু একটা শ্রেণীরূপের প্রতিনিধি। এমনকি নববাবু যে-কোনো ব্যক্তির নাম নয়, ইংরাজি-পড়া নতুন নববাবুর দল বা ইয়ংবেঙ্গল, তাহা তৎকালীন লোকেরাও বুঝিয়াছিলেন।”

অবশ্য সমালোচকের উক্ত বক্তব্য সমগ্রত সমর্থনীয় নয়। নবকুমার কলেজে পড়া তরুণ নবযুবক; সে পাশ্চাত্য ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত। সে অন্যান্য অনেকের মত হিন্দুসমাজের নানা কুসংস্কার থেকে মুক্তি পেতে চায়। সে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চায়। সে পুত্তলিকা দেখে হাঁটু নোয়াতে চায় না; সামাজিক সংস্কারই তার একমাত্র কাম্য। তারই জন্য সে গড়ে তুলেছে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’। নবকুমার মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার দেখতে চেয়েছে এবং বিধবা-বিবাহ আন্দোলনও তার পরিচিত। মধুসূদন- সমকালীন বাংলাদেশে যে প্রগতিশীল সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলন নবকুমারের বিদ্যোৎসাহিতা ও সমাজসংস্কার আন্দোলন তার দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু প্রহসনে নবকুমারের ভূমিকা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সে ভোগবিলাসী, স্ফূর্তিতে নিমজ্জিত, বারাঙ্গনাসঙ্গ কামনায় উৎসুক এবং মদ্যপায়ী। সে ইন্দ্রিয়সুখে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবার জন্য সে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে চায়। তার কাছে পূর্ণ স্বাধীনতার অর্থ মদ্যপান, বারবিলাসিনী গমন, খেমটা নাচ উপভোগ ও নিষিদ্ধ খাদ্যভক্ষণ। তার এবং তার সঙ্গীসাথীদের ভাষা বিশুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজি নয়; জগাখিচুড়ি। তাদের কেউই স্বদেশি ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধার ধারে না। তারা জীবন উপভোগ বলতে বোঝে স্বেচ্ছাচার। নবকুমার এবং তার সঙ্গীরা প্রমত্ত ভোগবাসনাকে মহত্ত্ব প্রদানের জন্য ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র প্রতিষ্ঠা করেছে যার অন্তরালে আসলে নানা কুকর্ম চলে; আর এই কুকর্মের অর্থ যোগায় স্বয়ং নবকুমার।

‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’য় যে অনুষ্ঠান হয় সিকদার পাড়ার গলিতে সেখানে নবকুমার পিতৃঅর্জিত টাকা প্রদান করে। সেখানে শুধুই বারবিলাসিনীদের নৃত্যগীত, মদ্যপান, খেমটা নাচ উপভোগ ইত্যাদি। তারপর রাত্রে মাতাল হয়ে ফিরে এসে নবকুমার ইংরাজি কায়দায় ভগ্নীকে চুম্বন করে। পিতার সম্মুখেই সে ব্র্যাণ্ডির জন্য চাকরকে বলে; পিতার বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করে। নবকুমারের পিতা ভক্ত বৈষ্ণব বৃন্দাবন থেকে প্রত্যাগমন করায় সে বেশ অসুবিধায় পড়েছে। সে পিতাকে সমীহ করে, ভয় করে, প্রকাশ্যে তাকে উপেক্ষা করার সাহস তার নেই। বাইরে বেরনো তার মুস্কিল হয়ে পড়ে। পিতা তাকে সন্দেহ করে তার সহচর বৈষ্ণববাবাজীকে তাদের ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’র খোঁজে পাঠান। পিতার অসাক্ষাতে সে বন্ধুকে মদ খাওয়ায়, পান খাইয়ে মদের গন্ধ ঢাকতে বলে। সে পিতার দুর্বলতা কোথায় জানে। তাই শ্রীমদ্ভাগবদগীতা বা জয়দেবের নাম উল্লেখ করতে শিখিয়ে দেয়। কালীনাথ যখন বৈষ্ণবাবাজীকে কাটলেট চপ ইত্যাদি খাওয়াবার কথা বলে তখন সে বুদ্ধি ও চাতুর্যের দ্বারা উৎকোচ দিয়ে বাবাজীর মুখ বন্ধ করতে চায়।

নবকুমার ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ মধ্যমণি; তার বন্ধুরা তার সমালোচনা করলেও নেতৃত্ব স্বীকার করে নেয়। সে বাসর্বস্ব ভোগবাদী চরিত্রহীন যুবক হলেও তার নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা আছে। ‘নবকুমারের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, বুদ্ধির প্রাচুর্য ও বাস্তবতাবোধের পরিচয় মেলে পিতৃপ্রেরিত চর বৈষ্ণবগোঁসাইয়ের হাতে ধরা পড়ার পর। নবকুমার চরিত্রের দুটি পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে সে ভদ্র, বিনয়ী, পিতৃভক্ত, সদ্বংশজাত সন্তানের মতই তার আচরণ। মদ্যপানকে সে ঘৃণিত কাজ বলে মনে করে না, কিন্তু গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত। আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ থেকে ফেরার পর সে অসংযত, বাচাল, অপরিণামদর্শী ও বাস্তবতা বোধহীন চরিত্র।’ পিতৃশিক্ষা তার জীবনে কার্যকরী হয়নি বলে পিতা তাকে ‘কুলাঙ্গার’ বলেছেন। নবকুমারের মধ্য দিয়ে ইংরাজি শিক্ষার অসারতাও প্রমাণিত হয়েছে। একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে নবকুমার চরিত্র এক অসংগতির নামাবলী। “আধুনিক নগরজীবী সভ্যতার এই অন্তঃসারশূন্যতা ও বৈপরীত্যই নবচরিত্রের মধ্য দিয়ে নাট্যকার ফুটিয়ে তুলেছেন। নবকুমারের চরিত্রে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, সংকট নেই – নব একদিকে ব্যক্তিচরিত্র, অন্যদিকে শ্রেণীর প্রতিনিধি।”

নবকুমার চরিত্রের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে অশোককুমার মিশ্র তাঁর ‘বাংলা প্রহসনের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন– 

(১) “নবকুমার কেবলমাত্র ইয়ংবেঙ্গলের শ্রেণী প্রতিনিধি নয়, তার মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ স্পষ্ট।”

(২) “ইয়ংবেঙ্গলদের ব্যঙ্গ করা নয়, অত্যাধিক মদ্যপানের বিরোধিতা করাই নাট্যকারের অভিপ্রেত ছিল। সে কারণেই নাটকের মধ্যে বার বার মদ্যপানের কথা আছে। ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ দৃশ্যে বারাঙ্গনা উপস্থিত থাকলেও মদ্যপানের চিত্রই সেখানে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত করা হয়েছে। কর্তামশায় নবকুমারকে নির্লজ্জ বলে ধিক্কার দিলে সে বলেছে, ‘ড্যাম লজ্জা, মদ ল্যাও।’ এবং নাটকের পরিসমাপ্তিতে বিষাদের করুণ সুর যখন উচ্ছ্বসিত, হাস্যতরঙ্গের অভ্যন্তরে ফল্গুস্রোতে বহমান তখন নবর স্ত্রী বলেছে, ‘মদ মাস খ্যেয়ে ঢলাঢলি কল্পেই কি সভ্য হয়”?

কোনো কোনো সমালোচক নবকুমার চরিত্রের মধ্যে মধুসূদনের আত্মপ্রতিফলন লক্ষ্য করেছেন। যেমন ক্ষেত্র গুপ্ত তাঁর ‘নাট্যকার মধুসূদন’ গ্রন্থে বলেছেন—“নবকুমার চরিত্রের মধ্যে স্বয়ং কবির আত্মপ্রতিফলন ঘটেছে এরূপ মনে করা অযৌক্তিক নয়। নবকুমারের চরিত্রের অনেকগুলি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মধুসূদনের সাদৃশ্য আছে। নবকুমারের বেশ্যাসক্তি মধুসূদনের নেই। আর মধুসূদনের প্রতিভার উজ্জ্বল দীপ্তি থেকে নবকুমার একেবারে বঞ্চিত। তবে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার নেতৃত্বপদ লাভ করার মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে নবকুমার সাধারণের কিছু ঊর্ধ্বে। যদিও মধুসূদনের ন্যায় অত্যুচ্চ প্রতিভার সঙ্গে তার তুলনাই চলে না। নবকুমারের চরিত্রে শ্রেণি স্বভাব যতটা প্রকট, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ততটা নয়। শ্রেণির পরিচয়ে মধুসূদনের ব্যক্তিত্বের সমগ্রতা ধরা অসম্ভব। তবুও নবকুমারের মধ্য দিয়ে যে ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক জীবনাদর্শের প্রতি তিরস্কার বাণী উদ্যত করেছেন কবি, তিনি নিজে ছিলেন তার এক প্রধান প্রতিনিধি। নবকুমারের মাধ্যমে তার আত্মতিরস্করণ ঘটেছে।”