‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় সমসাময়িক যুগসমস্যার সঙ্গে শিল্পধর্ম রূপায়িত হয়েছে।-আলোচনা করো।
‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রসঙ্গে এমন অভিযোগ করা হয়েছে যে, রচনাটিতে সোজাসুজি সামাজিক সমস্যার কথা বলা হয়েছে বলে কোনো শিল্পসৌন্দর্যের দাবি এর নেই।—আলোচনা করো।
“একেই কি বলে সভ্যতাকে উচ্চশ্রেণীর প্রহসন বলিয়া অভিনন্দিত করা যায় না। ইয়ং বেঙ্গল সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে মদ্যপান করিত ও বেশ্যাসক্ত হইয়াছিল এবং তাহার ফলে ঘরে ঘরে অশান্তির সৃষ্টি হইয়াছিল। এই কথা সোজাসুজি বলার মধ্যে কোনো সাহিত্যিক কৌশলের পরিচয় নাই। জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার নাম করিয়া কতকগুলি যুবক মদ্যপান করিত, বারবিলাসিনীদের সঙ্গে তাহাদের সম্পর্ক ছিল। সেইখান হইতে নায়ক নবকুমার মদোন্মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরিয়া আসিল এবং তাহার স্তম্ভিত পিতা সবাইকে লইয়া পাপ কলিকাতা নগরী ত্যাগ করিয়া তীর্থযাত্রা করিলেন। ইহাই এই প্রহসনের বক্তব্য বিষয়; ইহার কাহিনীতে বা চরিত্রসৃষ্টিতে কোন অভিনবত্ব নাই।”
সমালোচকের উক্ত মূল্যায়ন কিন্তু সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য নয়। সমস্যাটির পূর্ণাঙ্গ কাহিনীরূপ প্রদান সম্ভব হয়নি বলেই সমালোচক সম্ভবত উক্ত মন্তব্য করেছেন। কিন্তু গ্রহসনটির অঙ্কবিভাগ, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি আলোচনা করলে এর শিল্পাসার্থকতার দাবী অগ্রাহ্য করা যেতে পারে না। আলোচ্য প্রহসনটিতে সামাজিক সমস্যার রূপ অঙ্কিত হলেও শিল্পসৌন্দর্যের দাবি নেই এমন কথা বলা যাবে না।
প্রহসনটি দুটি অঙ্কে বিভক্ত এবং প্রত্যেক অঙ্কে দুটি করে গর্ভাঙ্ক অর্থাৎ মোট চারিটি দৃশ্য। প্রথম গর্ভাঙ্কে নবকুমারের গৃহ, দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে সিকদার পাড়ার গলির বর্ণনা, দ্বিতীয় অঙ্কের একটিতে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার বর্ণনা ও আর একটিতে নবকুমারের গৃহ। প্রত্যেকটি গর্ভাঙ্কে স্থানগত সাদৃশ্য আছে এবং অঙ্কবিভাগে স্থানগত ঐক্য রক্ষিত হয়েছে। নাটকে প্রথম অঙ্ক যদি ঘটনার প্রস্তুতি হয়, তবে দ্বিতীয়াঙ্ক তার পরিণতি। এমনকি আলোচ্য প্রহসনে কালগত ঐক্যও অনুপস্থিত নয়। মোট পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যে এ প্রহসনের ঘটনাকাল সীমাবদ্ধ। ঘটনাগত পারম্পর্যও ব্যাহত হয়নি। প্রথমাঙ্কের প্রথম দৃশ্যে প্রতারণা করে পিতার কাছে অনুমতি গ্রহণ জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় গমনের জন্য; দ্বিতীয় দৃশ্যে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার রাজপথে বাবাজীর বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণনা; দ্বিতীয়াঙ্কের প্রথম দৃশ্যে জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার উৎসব এবং দ্বিতীয় দৃশ্যে পানোন্মত্ত নবকুমারের গৃহে প্রত্যাবর্তন। ঘটনাগত ঐক্যের ক্ষেত্রেও প্রহসনটি সংহত।
মনে হয়, প্রহসনটিতে জমাট কাহিনীর অভাববশত সমালোচক উক্ত মন্তব্য করেছেন। কিন্তু প্রহসনে তো জমাট কাহিনী থাকে না। আলোচ্য প্রহসনে একটি বিশেষ যুগের সামাজিক সমস্যার রূপচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সমকালীন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের মদ্যপানাসক্তি, বারবিলাসিনী গমন, ঐতিহ্যের প্রতি অশ্রদ্ধা, গুরুজনদের অমান্য করা এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ নিটোল কাহিনী থাকবে এমন আশা করা যায় না।
‘একেই কি বলে সভ্যতা’ আদ্যস্ত ঘটনাসংঘর্ষে চঞ্চল। প্রথম দৃশ্যে কর্তা কালীনাথ কর্তৃক প্রতারিত; কর্তার আদর্শ ও নবকুমার এবং সঙ্গীসাথীদের জীবনাদর্শের সঙ্গে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব; বৈষ্ণব বাবাজী ও বারবিলাসিনীদের আলাপচারিতা কৌতুকময় হলেও জীবনদৃষ্টির পার্থক্য ও রুচিহীনতায় বৈপরীত্যগত নাটকীয় প্রক্রিয়া প্রকাশিত। এখানে নানাভাবে নাটকীয়তা, ব্যঙ্গরস ও কৌতুকরস সৃষ্টির প্রচেষ্টা আছে। সিকদার পাড়ায় বৈষ্ণব বাবাজীর অবস্থান বেশ কৌতুকপূর্ণ নাটকীয়তার সৃষ্টি করেছে।
সাধারণভাবে গ্রহসনে চরিত্রসৃষ্টিতে সীমাবদ্ধতা থাকে। চরিত্রের আংশিক পরিচয় থাকলেও সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব প্রতিফলিত হয় না। আলোচ্য প্রহসনের চরিত্রগুলি সম্পর্কে এই সাধারণ সূত্র প্রযুক্ত হলেও চরিত্রগুলি কর্মে-কথায় বেশ প্রাণবন্ত ও শিল্পোৎকর্ষে উজ্জ্বল। চরিত্রানুযায়ী সংলাপ সৃষ্টিতে প্রহসনটি বেশ প্রাণবন্ত। নবকুমার, কালীনাথ ও অন্যান্য সঙ্গীসাথীদের জীবনদর্শন ও মতবাদ প্রায় এক। মদ্যপান, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথাকে অস্বীকার, -গুরুজনকে অশ্রদ্ধা, বারবিলাসিনী আসক্তি, নিষিদ্ধ দ্রব্য ভক্ষণ, স্বাধীনতার নামে যথেচ্ছাচার, বাংলা ভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা, ইংরেজি-বাংলা মিশ্রিত কথ্যবুলির ব্যবহার ইত্যাদি গ্রহসনটিকে একসূত্রে গেঁথেছে। চৈতন, শিবু, বলাই, মহেশের ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য কয়েকটি রেখাঙ্কনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নবকুমার ও কালীনাথ চরিত্র-দুটি নাটকের ব্যাপক অংশ জুড়ে আছে এবং কালীনাথের তুলনায় নবকুমার অনেক উজ্জ্বল। কৌশল উদ্ভাবনে, মেজাজে, প্রতারণার কৌশলে নবর সমান্তরাল চরিত্র এখানে নেই। শব্দের কারচুপিতে, ভাবনা ও ভাষার লঘুতায় এবং কৌতুক সৃষ্টিতে কালীনাথের বিশিষ্টতা প্রকাশিত। নবকুমারের জ্ঞানবুদ্ধি উৎসাহ তৎপরতা ইত্যাদি অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় বেশি। নবকুমারের চরিত্রে বিকাশ হয়তো নেই, কিন্তু তার আচার-আচরণ, সংলাপ, দক্ষতা ইত্যাদি অন্যত্র দুর্লভ। কর্তার চরিত্র প্রচলিত মামুলি চরিত্র হলেও বৈষ্ণব ভাবালুতার আধিক্য তার ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ দিককে উদ্ঘাটিত করেছে। বৈষ্ণব বাবাজী ‘তুলসীবনের বাঘ। হাতে মালা জপ করে, আবার বারবিলাসিনীদের দিকেও দৃষ্টিপাত করে এবং উৎকোচ প্রদানে ও গ্রহণে তার দ্বিধা নেই। সে যথার্থই ‘হিপক্রীট’। সিকদার পাড়ার সার্জেন্ট, চৌকিদার, মাতাল, বাবুর্চি, মুটে, বারবিলাসিনী প্রভৃতি সকলের চরিত্রই বেশ জীবন্ত। সংলাপগত ভাষার বিশিষ্টতায় এই অপ্রধান চরিত্রগুলি আরও স্মরণীয় হয়ে উঠেছে। বারবিলাসিনীদের আচরণে মূঢ়তা, নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা, অবক্ষয় ইত্যাদি তাদের সংলাপে প্রকাশিত।
নবকুমারের পরিবারের যৌথজীবনের চিত্রও এখানে যথাযথ ভাবে রূপায়িত। বাড়ির গৃহিণী, নবকুমারের স্ত্রী হরকামিনী, ভগ্নী প্রসন্নময়ী, নৃত্যকালী, কমলা সকলকে নিয়ে যৌথ পরিবারের ছবি আঁকলেও প্রত্যেকের চরিত্রের পার্থক্য কিন্তু পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। গৃহিণীর মধ্যে চিরকালীন মাতৃহৃদয়, হরকামিনীর মধ্যে নারী জীবনের আকাঙ্ক্ষা, প্রসন্নময়ীর ব্যর্থ নারীজীবনের বেদনা সমস্তই প্রকাশিত। তবে হরকামিনীর একটি মাত্র মন্তব্যে সমগ্র সামাজিক সত্যতা যেন আর্তনাদ করে উঠেছে– “তা বই আর কি, ভাই আজকাল কলকেতায় যাঁরা লেখাপড়া শেখেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই কেবল এই জ্ঞানটি ভাল জন্মে। তা ভাই দেখ দেখি, এমন স্বামী থাকলেই বা কি আর না থাকলিই বা কি। ঠাকুরঝি, তোকে বলতে কি ভাই, এইসব দেখে শুনে আমার ইচ্ছে করে যে গলায় দড়ি দে মরি ছি ছি ছি! বেহায়ারা আবার বলে কী, যে আমরা সাহেবদের মতন সভ্য হয়েচি। হা আমার পোড়া কপাল! মদ মাস খ্যেয়ে ঢলাঢলি কল্লেই কি সভ্য হয়? – একেই কি বলে সভ্যতা?”
প্রহসনের আলোচ্য উক্তিতেই প্রহসনটির সমাপ্তি হয় এবং সমগ্র প্রহসনের কেন্দ্রীয় বক্তব্য প্রকাশিত হয়। প্রহসনকার এই শেষ সিদ্ধান্তকে প্রকাশের জন্য যে প্রকরণ পদ্ধতি, উপস্থাপনা রীতি, চরিত্র, পরিবেশ, ঘটনার নাটকীয়তা, সংলাপ, সংহতি, দৃশ্যের আয়োজন ইত্যাদি করেছেন তা প্রহসনটিকে যথার্থ শিল্পগৌরব দান করেছে। সামাজিক সমস্যার উপস্থাপনার জন্য প্রহসনটি প্রচারধর্মিতায় পর্যবসিত হয়ে শিল্পসমৃদ্ধ একটি স্মরণীয় প্রহসনের মর্যাদা লাভ করেছে।
Leave a comment