‘সোনার তরী’ কবিতাটি তত্ত্বাশ্রয়ী কবিতা- আলোচনা করো
‘সোনার তরী’ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের কবিমানসের একটা ভাবময় অবস্থা রূপকের অন্তরালে আত্মগোপন করে রয়েছে। কবির ভাবজীবনের দিক থেকে দেখলে এই কবিতার কৃষক, চাষ, চাষের জমিটুকু, সোনার ধান, অকস্মাৎ আগত নাবিক, তরীতে ফসল তুলে দেওয়া, শেষে নিজে সেখানে স্থান না পাওয়া—এ সমস্ত প্রসঙ্গই মনে হয় অপর একটা ভাবগত উপলব্ধির রূপক। কৃষক স্বয়ং কবি, চাষ কবির কাব্য সৃষ্টির প্রয়াস, কৃষিক্ষেত্র কবির জীবনের বৃত্ত, সোনার ধান কবির সৃষ্ট কাব্য, নাবিক কবির অন্তরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা যিনি তাঁর কাব্যফসলকে বিশ্বজনের কাছে পৌঁছে দেন। বিশ্বসংসার কবির কাব্যকেই সমাদর করে, কাব্যব্যক্তিকে নয়, তাই তরীতে কবিতার স্থান হয় কিন্তু কবির স্থান হয় না।
কাব্যসৃষ্টি কবির একক সাধনা। জীবনের রঙ্গভূমি থেকে দুরে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় ও নির্জনে বসে কবি এতদিন ধরে কবিতার যে ফসল উৎপাদন করেছেন সেই ফসল এখন পরিপক্ক হয়েছে। বাঁকা জল বেষ্টিত ক্ষুদ্র ক্ষেতখানি থেকে সোনার ফসল ওপারে বিশ্বজনের তীরে কে পৌঁছে দেবে। তরণী বেয়ে এক পুরুষকে কবি আসতে দেখলেন। তিনি এসে কবির কাব্য ফসল সমস্তই তরীতে বোঝাই করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কবিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এই নাবিক পুরুষটিই কবি-অন্তরের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তিনি কখনও পুরুষ আবার কখনও নারীরূপে কবির হৃদয়ে আসীন হয়ে তাঁর সমগ্র চৈতন্যকে উদ্বুদ্ধ এবং তাঁকে কাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। ইনিই কবির সঙ্গে বিশ্বসংসারের দৌত্য করেন। পরবর্তীকালে ইনিই কবিচিত্তে জীবনদেবতারূপে পূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠেছেন।
একক ও নিঃসঙ্গভাবে কবি তাঁর কাব্যসাধনা করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর কাব্যক্ষেত্রের চারিদিকে প্রতিকূল সমালোচনার বাঁকা জলরাশি।
‘সোনার তরী’তে কবির স্থান না পাওয়ার কারণ, বিশ্বজন কাব্যেরই ভালোমন্দ বিচার করে, সমাদর করে কিন্তু কবিকে মনে রাখে না। কেউ খোঁজও করে না কত দুঃখের ধন এই কাব্য। কবি, শিল্পীদের বিধিলিপি এরুপই। দুঃখের আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে কবি অপরের জন্য আনন্দের উপকরণ সৃষ্টি করে তোলেন। আলোচ্য কবিতার শেষ অংশে যে বেদনার সুর ধ্বনিত হয় তা কবির ব্যক্তিসত্তার শূন্যতাবোধজনিত। কবি ব্যক্তিজীবন ও কাব্যজীবনের স্বাতন্ত্র্যকেই সত্য বলে মনে করে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই ভেদবোধ লুপ্ত হয়ে একটা সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’র রূপকার্থ উন্মোচন করে স্বয়ং কবিতাটির একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষ তার সারা জীবন ধরে ফসলের কাজ করে। তার জীবন যেন জলবেষ্টিত ক্ষুদ্র একটা ক্ষেতের মত, অব্যক্তের দ্বারা সে যেন বেষ্টিত। এই মানবজীবনের অন্তিম সময় আসন্ন হয়ে এলে ঐ ছোট ক্ষেতটুকু জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলে মানুষ তার জীবনের কাজে নিত্য ফলটুকু সংসারের তরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে। সংসার নিঃশেষে সমস্ত গ্রহণ করলেও ব্যক্তি মানুষের আকুল আবেদন সত্ত্বেও তাকে গ্রহণ করে না। সংসারের তরণীতে ব্যক্তি মানুষের স্থান নেই।
মানুষমাত্রেই তার নিজের কাজ দিয়ে সংসারকে কিছু না কিছু দান করছে এবং সংসার তার কিছুই নষ্ট না করে সব কিছুই গ্রহণ করছে। কিন্তু মানুষ যখন এর সঙ্গে নিজের অহংকে চিরন্তন করে রাখতে চায় তখনই তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মানুষ যে জীবনটাকে ভোগ করে অহংটাকেই তার খাজনা হিসেবে মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসেব মিটিয়ে যেতে হয়।
Leave a comment