কবির উপলব্ধ অনুভূতি প্রকাশের জন্যে যে ভাষাচিত্র রচিত হয় তার সৌন্দর্য প্রাথমিকভাবে পাঠককে অবশ্য মুগ্ধ করে। কবির বলবার যা থাকে তিনি ভাষার শিল্পরূপে প্রকাশ করেন। কবিতার আপাত সৌন্দর্য যদি কোন পাঠককে আকর্ষণ করে এবং অপর কোন তাৎপর্য তাঁর কাছে প্রতিভাত না হয়, তাহলে তিনি কবিতার রূপ উপভোগ করতে পারবেন না এমন কথা বলে চলে না। আসলে সার্থক সাহিত্যসৃষ্টি সকল শ্রেণীর সকল প্রবণতার পাঠককেই তৃপ্ত করে। ‘সোনার তরী’ কবিতাটি সম্পর্কেও এ কথা সত্য। যদি কেউ এ কবিতাকে কোন তত্ত্বের রূপক হিসাবে না দেখে আপাত অর্থে গ্রহণ করেন তিনি নিশ্চয়ই এর রস আস্বাদন করতে পারবেন।

‘সোনার তরী’ কবিতার ছটি স্তবকে নিবিড় বর্ষাপ্রকৃতির পটভূমি এবং একজন নিঃসঙ্গ মানুষের বিচ্ছিন্নতার বেদনা গীতিরসে আপ্লুত ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। জমিদারি পর্যবেক্ষণ সূত্রে এইসময় রবীন্দ্রনাথকে সুদীর্ঘকাল পদ্মাবিধৌত পল্লীবাংলার প্রকৃতিসান্নিধ্যে কাটাতে হয়েছে। ফলে বর্ষাগ্লাবিত পদ্মার প্রত্যক্ষ রূপ কবি এ সময় চর্মচক্ষেই দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে কবি স্বয়ং লিখেছেন—“যে দিন বর্ষার অপরাহ্ণে খরস্রোতা পদ্মার উপর দিয়ে কাটা ধানে ডিঙি নৌকা বোঝাই করে মগ্নপ্রায় চর থেকে চাষীরা এপারে চলে আসছে…..সেইদিনেই ‘সোনার তরী’ কাব্যের সঞ্চার হয়েছিল মনে…..।” এ কবিতায়, সবকিছু ছেড়ে দিলেও বর্ষার-চারুচিত্রটি ভোলা যায় না। নদীর তীরে বর্ষা নেমেছে, পরপারে গ্রামখানি মেঘে ঢেকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। চাষী তার ধান কেটে আঁটি বেঁধে রেখেছে। পরপারে তাকে যেতেই হবে, বিলম্ব করা চলবে না। নাবিক এল, সোনার ধান তুলে নিয়ে গেল, চাষী তরীতে ঠাই পেল না। তারই সোনার ধানে তরণী পূর্ণ হয়ে গেছে। শ্রাবণ মেঘ আচ্ছন্ন আকাশের নীচে কৃষক একাকী পড়ে রইল, কবে তার এই নির্বাসন শেষ হবে কেউ জানে না।

এই সাধারণ শব্দচিত্রে কবি সঙ্গীত যোজনা করলেন। প্রথম অংশেই মেঘের গর্জন, নদীর খরস্রোতে কি সুন্দরভাবে শব্দসংগীত ধরা পড়েছে, “ভরা নদী ক্ষুরধার খরপরশা” যেন নদীর তীব্র স্রোতকে মূর্ত করে তুলেছে। ‘তরুছায়া মসীমাখা’য় যে দূরত্ব ও অস্পষ্ট রহস্য তা যে কোনও পাঠক অনুধাবন করতে পারে।‘ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দুধারে”—কথাও যেন ভেঙে ভেঙে চলেছে। “আর আছে? আর নাই, দিয়াছি ভরে” ইত্যাদি অংশের সংলাপ কবিতাটাতে একটা নাটকীয় ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছে। সর্বশেষ অংশে মেঘের নিষ্ফল আবর্তন যেন এক গতিশূন্য ভাষার রূপ পেয়েছে। শব্দচিত্র ও শব্দসঙ্গীতে যে গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়েছে, অর্ধপরিচিত নাবিকের আগমনে যে রহস্যময়তা ঘনীভূত হয়েছে এবং সর্বোপরি যে করুণরস পরিবেশিত হয়েছে তা যে কোনও পাঠকেরই উপভোগ্য। এই রস উপভোগের জন্য কবিতাটির কোন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কৃষকের অন্তহীন নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের কারুণ্য মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে সজল বর্ষার চিত্ররূপগুলির সংমিশ্রণে। এই স্বাদটুকুর জন্য কবিতাটি চিরদিনের জন্য পাঠকের মনে গাঁথা হয়ে যায়।

কিন্তু যে কোন মহৎ কবিতায় বিচ্ছিন্নভাবে রসাবেদন থাকলেও তাঁর সমগ্র সৃষ্টির পটভূমিতে রেখে কোন বিশেষ কবিতাকে বিচার করলে কবির ভাবজীবনের ব্যাপকতার সহানুভূতির আভাস পাওয়া যায়। কবিকে বুঝতে হলে এই দৃষ্টিতে রচনার বিচার বাঞ্ছনীয়। ‘সোনার তরী’ কবিতাটিকে কোন তত্ত্বের রূপক হিসেবে না দেখে আপাত অর্থে গ্রহণ করলেও এর রসাস্বাদন সম্ভব; কিন্তু রবীন্দ্রমানসের বিবর্তনধারার পরিপ্রেক্ষিতে এ কবিতার তাৎপর্য উপলব্ধি করবার চেষ্টা করলে কবিতাটির আবেদন যে ব্যাপকতর ও গভীরতর হয়, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।