‘সোনার তরী’ পর্বে কবি সুখ-দুঃখে ঘেরা মানবজীবনের ঘনিষ্ঠ সংসর্গে এসেছেন। ফলে এই পর্বে ধ্বনিত হয়েছে এক গভীর মর্ত্যপ্রীতি। ‘সোনার তরী’র ‘বৈষ্ণুবকবিতা’য় মর্ত্যের মানবীয় প্রেমকেই কবি হৃদয়ের গভীর অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করেছেন। তিনি মর্ত্যকে স্বর্গের সঙ্গে বেঁধেছেন, মানব-মানবীর প্রেমের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের প্রতি প্রেমকে উপলব্ধি করার কথা বলেছেন। মানুষকে মানবজীবনের মধ্য দিয়েই পরম সত্তার পরিচয় পেতে হয়, এ ছাড়া অন্য উপায় নেই। বৈষ্ণব কবিকেও প্রেমের কথা বলতে গিয়ে এই মর্ত্য জীবনের পার্থিব প্রেমলীলার মধ্যে, অপার্থিব প্রেমের অনুভূতি উপলব্ধি করতে হয়েছিল। মর্ত্য-মানবীর প্রেমপূর্ণ মুখ তাঁকে প্রেমাভিভূতা বিরহিণী রাধিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল।’

বহির্জগৎকে আশ্রয় করেই মানুষের মনোজগৎ বিকশিত হয়ে থাকে, প্রত্যেক জ্ঞানই বস্তুর অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল। সেইজন্যই বৈষ্ণুবরা মানবজীবনকে তাঁদের সাধন পদ্ধতিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কৃষ্ণপ্রেমের সাধনা করেছেন পার্থিব মানবপ্রেমের মধ্য দিয়েই।

কোনও বস্তুর সন্ধানে অন্ধকারে যখন দীপালোক জ্বালা হয়, তখন তা শুধু প্রার্থিত বস্তুকেই আলোকিত করে না, তা সমগ্র ঘরকেই আলোকিত করে তোলে। মানবজীবনের প্রেম, যত ক্ষুদ্রই হোক, জগতের সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে, পৃথিবীর প্রেমের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে, ভূমানন্দকে প্রকাশ করে। কবি মানবপ্রেমের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের প্রেমে ব্যাপ্ত হওয়ার কথাই বলেছেন। তাঁর মতে মানবপ্রেমকে অস্বীকার করে ভগবৎপ্রেম লাভ করা যায় না, তাকে অতিক্রম করেই লাভ করতে হয়। ‘পঞ্চভূত’ গ্রন্থের একটি রচনায় রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, “যাহাকে ভালোবাসি তাহার মধ্যেই আমরা অনন্তের পরিচয় পাই। এমন কি, জীবনের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা। প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্য সম্ভোগ। সমস্ত বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে এই গভীর তত্ত্বটি নিহিত রহিয়াছে।”

রবীন্দ্রনাথ স্বর্গ ও দেবতাকে মর্ত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন নি। মানুষের পার্থিব প্রেমকে যথার্থ মূল্য দিতে চান বলেই ‘বৈষুবকবিতা’য় জিজ্ঞাসা করেছেন, বৈষ্ণুব কবি তার পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান, প্রেমলীলা, বিরহ-মিলন, বৃন্দাবন-গাথা—এসব কি শুধুমাত্র দেবতারই? বস্তুত প্রেমের বিচিত্র পর্যায়গুলি মানব-মানবীর পার্থিব প্রেমকেই শুদ্ধ ও মহিমান্বিত করে তোলে। মানবের পার্থিব প্রেমের সেই সেতুটি পার হয়েই বিশ্বের সঙ্গে ভূমানন্দের সঙ্গে মিলন ঘটতে পারে।

যে নিত্য-আনন্দ নিখিল জগতের মূলে বিরাজিত, সেই আনন্দের ক্ষণিক ও আংশিক উপলব্ধি ঘটে পার্থিব মানবীয় প্রেমে। বাস্তব প্রেমের মধ্যেই দেবত্ব নিহিত আছে, প্রেমকে বাস্তবক্ষেত্র থেকে অপসারিত করে অপ্রাকৃতের মধ্যে স্থাপন করে তার অমৃতত্ত্ব অনুভব করা যায় না। বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে অনও বৃন্দাবন বিরাজ করছে এবং তার মধ্যে চিরন্তন হৃদয়ের লীলা চলছে।

বৈষ্ণব কবিতার মধ্যে প্রেমভাবনার যে লোকাতীত মাধুর্য রয়েছে, তার স্পর্শ লাভ করলে মানবের পার্থিব জীবনও মধুময় হয়ে ওঠে। প্রেমিকা মানবী বৈষ্ণব প্রেমসঙ্গীতে আপন প্রেমের ভাষা খুঁজে পায়, তার মুখ প্রেমের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু কবি মনে করেন বৈষ্ণুবকবি যে প্রেমচিত্তকে লোকাতীত ব্যানা দিয়েছেন, তা পার্থিব জীবনের লৌকিক প্রেমানুভব থেকেই আহৃত হয়েছে।

কবি মনে করেন, বৈষ্ণুবকবি রাধাকৃষ্ণের প্রেমের যে চিত্র অঙ্কিত করেছেন তা মর্ত্যজীবনের প্রেমেরই প্রতিরূপ। রাধিকার অশ্রুসিক্ত আঁখি, চিত্তের গভীর ব্যাকুলতা পার্থিব কোনও রমণীর মুখ, আঁখি বা হৃদয়-সঞ্চিত ভালোবাসারই প্রতিফলন।

এই পার্থিব জীবনে মানুষ অন্তরের ভালোবাসা নিবেদন করে প্রিয়জনকে দেবত্বে উন্নীত করে, আবার সেই ভালোবাসারই জোরে দেবতাকে আপনজনে পরিণত করে –

“দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”

এইভাবেই ‘বৈষ্ণুবকবিতা’য় কবি পার্থিব প্রেমকে লোকাতীত প্রেমের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন; কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, লোকজীবনের ভিত্তি না থাকলে লোকাতীত প্রেমে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না।