একটি ক্ষুদ্র সংসার জীবনের বাস্তব ঘটনার বর্ণনা ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাটির সূচনা। এই ক্ষুদ্র ঘটনাজনিত মানুষের সাধারণ অনিবার্য হৃদয়-বেদনা অপূর্ব কল্পনাশক্তির বিস্তারে নিখিলবিশ্বের অন্তরস্থিত সুগভীর বেদনা, পৃথিবী মায়ের বেদনা পীড়িত সন্তানস্নেহের এক সর্বব্যাপী বিষাদ সঙ্গীতে রূপান্তর ঘটেছে।
পূজাবকাশের পর একদিন হেমন্তের দ্বিগ্রহরে কবি প্রবাসে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। দরজায় গাড়ী দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভৃত্যরা জিনিসপত্র বাঁধা ছাঁদা করছে। গৃহিণী বিদেশে প্রয়োজনে লাগতে পারে বলে অজস্র খুঁটিনাটি জিনিস সাজিয়ে রাশিকৃত করে ফেলেছেন। আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় তিনি কাতর। কিন্তু অমঙ্গলের অশ্রু তিনি জোর করে রোধ করে রেখেছেন। বিদায়ের সময় হলে কবি বিদায় গ্রহণ করলেন। বাইরের দরজায় কবির চার বছরের শিশুকন্যা বসেছিল। তার কাছে বিদায় চাইতেই বিষণ্ণ নয়নে চেয়ে স্নান মুখে সে উত্তর দিল, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়।’ যেখানে সে বসেছিল, সেখান থেকে নড়ল না, হাত ধরে বাধাও দিল না। শুধু ঐ দর্পিত একটি বাক্যে নিজের স্নেহের অধিকার ঘোষণা করল। কিন্তু প্রিয়কন্যার এমন প্রবল দাবিও উপেক্ষা করতে হয়, চলে যেতেই হয়।
শিশুকণ্ঠে উচ্চারিত ঐ স্নেহের অহমিকা কবির মনে এক দিব্য উপলব্ধির মত মনে হল। ঐ একটা ধ্বনি তাঁর চেতনায় জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটা সত্যানুভূতি জাগিয়ে তুলল। এখান থেকেই কবিতাটি বাস্তব ঘটনা বর্ণনার স্তর থেকে দার্শনিক উপলব্ধির স্তরে উন্নীত হয়েছে। চলমানতাই বিশ্বের ধর্ম। এ বিশ্বে কিছুই স্থির হয়ে থাকে না। যা কিছু জাত ও জীবিত, সকলেই অনিবার্যভাবে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছে। এই গতিপ্রবাহ অপ্রতিরোধ্য ও অবাধ। কিন্তু বিশ্বজীবনের এই গতিশীলতা যেমন সত্য, তেমনি আবার স্থিতির আকাঙ্ক্ষা সত্য। এই প্রবহমান জীবন-স্রোতের মধ্যেই আমরা ভালবাসার, স্নেহের, প্রেমের বন্ধন রচনা করি। প্রাণের ধনগুলিকে আলিঙ্গনে বেঁধে আমরা চিরন্তন করে রাখতে চাই। কবি সমগ্র বিশ্ব-প্রকৃতিতেই এ প্রেমের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছেন। এই যে ভালোবাসার বন্ধন রচনার আকাঙ্ক্ষা, পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে এ আকাঙ্ক্ষা প্রতিহত হচ্ছে, ভীরু বাসনা করুণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। জীবনপ্রবাহ অবিশ্রাম চলেছে প্রলয়-সমুদ্রের দিকে। কবি অনুভব করেন এ বিশ্বে প্রতিমুহূর্তে এই গতি ও স্থিতির আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বে আর্ত বেদনা জাগছে এবং পৃথিবী পূর্ণ হয়ে উঠছে সেই বেদনার ক্রন্দনে। সকলেই ব্যগ্র বাহু প্রসারিত করে বলছে ‘দিব না দিব না যেতে’, কিন্তু বিশ্বের নিয়মে তাঁরা সকলেই ছুটে চলেছে, কেউ স্থির হয়ে নেই। প্রেমের করুণ আর্তিতে পরিপূর্ণ এ বিশ্বসংসার কবির দৃষ্টিতে বিষাদময়ীরূপে প্রতিভাত হয়েছে। কবির চোখে শেষ পর্যন্ত বিষাদময়ী মাতা বসুন্ধরার সঙ্গে চার বছরের শিশুকন্যাটি এক হয়ে গেছে।
বিদায় মুহূর্তে দেখা শিশুকন্যার সজল নয়ন কাতর মূর্তি কবির চোখে ভেসে উঠেছে। তাঁর স্নেহের প্রবল অধিকারের গর্বিত বাণী উপেক্ষা করে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। শিশুকণ্ঠে উচ্চারিত গর্বিত বাণী কবির মনে জাগিয়ে তুলেছে এক গভীর সত্যোপলব্ধি এবং তারই ফলে দার্শনিকতার স্তরে তাঁর উত্তরণ।
Leave a comment