‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার আরম্ভ অংশের রসানুগ আলোচনা করো।
‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার বাহ্য অবয়বে স্পষ্ট দুটি স্তর। প্রথম স্তরে, কবির ব্যক্তিজীবনের এক বিশেষ অভিজ্ঞতা, দ্বিতীয় স্তরে সেই বিশেষ অভিজ্ঞতা ক্রমে বিশ্বজগতের চিরন্তন সত্যে উপনীত করেছেন কবি। কবিতাটির মর্মবাণী সেই চিরন্তন সত্যটিকে প্রকাশ করলেও কবিতার প্রথমাংশটি বাস্তবতায়, প্রত্যক্ষতায়, রসময়তায় অসাধারণ এ কথা স্বীকার করতে হবে। কবিতার সূচনা হয়েছে বিদায়ের আয়োজনের বর্ণনায়—’দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি’। বাইরে বিশ্বপ্রকৃতি যখন মধ্যাহ্নের বিশ্রামে মগ্ন, তখন প্রবাসযাত্রীর গৃহে বিদায়ের আয়োজনে সকলের ব্যস্ততার বর্ণনায় বৈপরীত্য প্রকাশে করুণ রস সঞ্চার করে দেয়। বিদেশযাত্রীর গৃহিণীর মমতার যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে হাস্যরসে ঈষৎ সিক্ত হলেও অন্তরালবর্তী অশ্রুর আভাস করুণ রসকেই সমৃদ্ধ করে তোলে। এক সময়ে প্রাচীন আলংকারিক ও রসসমালোচকরা হাস্যের সঙ্গে করুণ রসের বিরোধিতার কথা বলেছিলেন। আসলে কিন্তু দেখা যায়, মানুষ স্বচ্ছন্দে হাসতে হাসতে কাঁদতে পারে। রবীন্দ্রনাথেরই ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতাটিকে দৃষ্টান্ত হিসাবে উপস্থিত করা যায়।
হাস্যের সঙ্গে কারুণ্যের যে কোনও বিরোধ নেই তার প্রমাণ বিদেশী সাহিত্যেও প্রচুর পাওয়া যায়। Dickens of Lawrence হাস্যের সঙ্গে করুণ রসকে মিশিয়েছেন অবলীলাক্রমে। বঙ্কিমচন্দ্র ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’-এ কোকিলের কুহুরব নিয়ে হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেছেন এবং পাঠককেও কাঁদিয়েছেন। ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতাতে রবীন্দ্রনাথও বিদেশযাত্রীর যাত্রার আয়োজনের বিপুলতার বর্ণনায় পাঠককে ‘কিছুক্ষণ’ হাসিয়ে এক বিশ্বজনীন করুণ বেদনায় কাঁদিয়েছেন।
কন্যার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে ‘চলিতে চলিতে পথে’ পিতার হৃদয়ে যে-নিগূঢ় বেদনাময় অনুভব জেগেছিল তার পরিচয় দাও।
প্রবাসযাত্রী পিতাকে শিশুকন্যা বলেছিল, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’। সে নিষেধ উপেক্ষা করেই পিতা কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু শিশুকণ্ঠে উচ্চারিত ঐ বাণী কবির চিত্তে এক গভীর সুর বাজিয়ে তুলল। কন্যার উক্তিটি তাঁর মনে হল বিশ্বের মর্মগত বেদনারই অভিব্যক্তি।
চলমানতাই বিশ্বের ধর্ম, এখানে কিছুই স্থির হয়ে থাকে না। এ পৃথিবীতে যা কিছু জাত জীবিত, অনিবার্যভাবে তা চলেছে মৃত্যুর দিকে। এ গতিপ্রবাহ অপ্রতিরোধ্যও। বিশ্বজীবনের এই গতিশীলতা যেমন সত্য, তেমনি আবার স্থিতির আকাঙ্ক্ষাও সত্য। এই প্রবহমান জীবনস্রোতের মধ্যে ভালোবাসার, স্নেহের, প্রেমের বন্ধন রচিত হয়। মানুষ প্রিয়জনকে আলিঙ্গনে বেঁধে চিরন্তন করতে চায়। শুধু মানবজীবনে নয়, কবি সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতিতেই এই প্রেমের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছেন। মৃত্তিকাও বুকের তৃণতরুলতাগুলো ধরে রাখতে চায় চিরকালের মত। এই যে ভালোবাসার বন্ধন রচনার আকাঙ্ক্ষা, পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে এই আকাঙ্ক্ষা প্রতিহত হচ্ছে, ভীরু বাসনা করুণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। জীবনপ্রবাহ অবিশ্রাম চলেছে প্রলয়সমুদ্রের দিকে, তার থামবার সময় নেই, পিছনে তাকাবার সময় নেই। কবি অনুভব করেন, এ বিশ্বে প্রতিমুহূর্তে এই গতি ও স্থিতির আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বে আর্ত বেদনা জাগছে। বিশ্বতট বা পৃথিবী পূর্ণ হয়ে উঠেছে সেই বেদনার ক্রন্দনে। সকলেই ব্যাকুল ব্যগ্র বাহু প্রসারিত করে বলেছে ‘দিব না দিব না যেতে’, কিন্তু বিশ্বের নিয়মে তারা সকলেই ছুটে চলেছে, কেউ স্থির হয়ে নেই।
কবির দৃষ্টিতে তাই জগতে প্রতিমুহূর্তে স্থিতি ও গতির দ্বন্দ্ব চলেছে। এই দ্বন্দ্বে যে বেদনা জাগে, সে বেদনায় বিশ্ব আবিষ্ট। কবির হৃদয়েও বেদনা সঞ্চারিত। তিনি অনুভব করেছেন, ধূলিকণা থেকে মানুষের জীবন পর্যন্ত ভালোবাসার বন্ধন রচিত হয়ে আছে। এ বন্ধনকে অক্ষয় করে রাখার আকাঙ্ক্ষাই সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু কোন বন্ধনই চিরন্তন নয়। আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতার বেদনা কবিচিত্তকে অভিভূত করে।
Leave a comment