এই পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে নব নব রূপে প্রাণ সৃষ্টি করে তুলছে। ধরিত্রীর বুক ভরে আছে এই প্রাণসম্পদে। মাতার মত স্নেহ ব্যাকুলতায় বসুন্ধরা তাঁর এই হৃদয়ের ধনগুলি নিবিড় আলিঙ্গনে ধরে রাখতে চান, যেন তাঁর বুকের স্নেহোৎকণ্ঠা, সেই আকাঙ্ক্ষা ‘যেতে নাহি দিব’ এই বাণীরূপে ব্যক্ত হচ্ছে। কিন্তু এই ভালোবাসার বন্ধন শিথিল করতেই হয়। কিছুই চিরকালের জন্য ধরে রাখা যায় না। প্রাণপ্রবাহ সৃজনের মুহূর্ত থেকে মৃত্যুর দিকে ছুটে চলেছে অনিবার্য গতিতে। বিশ্বে নিরন্তর ধ্বনি উঠছে ‘যেতে নাহি দিব’, কিন্তু প্রাণপ্রবাহ চলেছে বিনাশের দিকে। ব্যর্থ ভালোবাসার ক্রন্দনে তাই আকাশ পৃথিবী আচ্ছন্ন। এক সর্বব্যাপী দুঃখ তাই সমগ্র জগৎকে আবৃত করে ফেলেছে।

পুজোর ছুটি শেষ হলে গৃহস্বামী প্রবাস জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যোগী। গৃহস্বামীর যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত গৃহিণী। কাজের ব্যস্ততায় আসন্ন বিচ্ছেদের দুঃখ চাপা দিয়ে তিনি গোছগাছ করেছেন। স্বামীর বিদেশযাত্রার এই আয়োজনের মধ্যেই গৃহিণী হৃদয়ের মমতা উজাড় করে দিয়েছেন। প্রবাসে কখন কি প্রয়োজন পড়ে ভেবে তিনি নানা টুকিটাকি জিনিস জড়ো করে তুলেছেন। গৃহস্বামীর বিদায় গ্রহণকালে গৃহিণীর উদ্বেলিত অশ্রুজল গোপনের চেষ্টায় বেদনার সুর বেজে ওঠে।

এরপরে আসে আর একটি চিত্র। এই পরিবারে আছে আর একটি মানুষ। কাজের ব্যস্ততায় সেই মানুষটির প্রতি, চারবছরের সেই শিশুকন্যাটির প্রতি আজ আর কেউ দৃষ্টি দেবার সময় পায়নি। অন্যদিন এতক্ষণে মায়ের পরিচর্যায় স্নানাহার সাঙ্গ করে সে নিদ্রা দিত। আজ কী ভেবে সে দ্বার প্রান্তে গিয়ে বসে আছে। দরজা দিয়ে বের হবার সময় পিতা কন্যার কাছে বিদায় চাইল। মেয়েটি বিষণ্ণ চোখে পিতার দিকে চাইল। সে উঠল না, দ্বার রোধ করল না। শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ অধিকার ঘোষণা করে বলল, ‘যেতে আমি দিব না তোমায়’। শিশুর সামান্য আবদারের কথার কে আর মূল্য দেয়। যেতে দেব না বললেই যাওয়া বন্ধ হবে—এ কথা আর কে ভাবে? পিতা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান।

পিতা বিদায় নিয়ে পথে বেরিয়েছেন। পথের দু’ধারে শরতের ভরা ফসলের ক্ষেতের উপরে রৌদ্র পড়েছে, আকাশে শুভ্র মেঘ পুঞ্জ পুঞ্জ জমে আছে। প্রকৃতি কেমন নিস্তব্ধ মৌনতায় ভরা। এমন নির্জন নিস্তব্ধ পথে চলতে চলতে প্রবাসযাত্রীর মনে কন্যার সেই উক্তিটি গুঞ্জরিত হচ্ছে। ভাবছেন এতটুকু মেয়ে কোথা থেকে কী শক্তি লাভ করে এমন প্রবল অধিকার ঘোষণা করল। সংসারে চলে যাওয়া কেউ কি রোধ করতে পারে? আমরা হয়তো শুধু ইচ্ছাটুকু প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু যেতে দেব না এমন প্রবল গর্বিত বাণী উচ্চারণ করতে পারি না, সেই গর্ব যে ক্রমাগত চূর্ণ হয়। যাকে ধরে রাখতে চাই, প্রবহমান জীবনের স্রোত তাকে কোথায় নিয়ে যায় কে জানে। কিন্তু এই জাতীয় ভাবনা সাধারণ ভাবুকতার স্তরে নিবদ্ধ, কিন্তু এরপর থেকেই কবিতায় ভিন্নতর সুর জেগেছে। সাধারণ বিচ্ছেদ-বেদনা রূপান্তরিত হয়েছে বিশ্বের অন্তর্নিহিত এক চিরন্তন বেদনায়। অকস্মাৎ কবির দৃষ্টির সম্মুখ থেকে যেন বাস্তবসংসারের, ব্যক্তিগত দুঃখ বেদনা অপসৃত হয়ে আকাশ ও পৃথিবীর প্রতি কবির দৃষ্টি পড়েছে। ব্যক্তিগত দুঃখকে কবি নিখিল বিশ্বে চিরকালের দুঃখ বলে অনুভব করেছেন। এ সংসারে কিছুই ধরে রাখা যায় না। প্রাণপ্রবাহ মৃত্যুর দিকে ছুটে চলেছে অনিবার্য গতিতে। কবির কাছে শিশুকণ্ঠের আতস্বর এবং বসুন্ধরার মর্মবিদারী হাহাকার একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে গেছে।