‘বিদ্রোহী’ কবিতা সমালোচনা প্রসঙ্গে কোনো কোনো সমালোচক মন্তব্য করেছেন যে কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় সর্বত্র যে বিদ্রোহী শক্তির জয়গান করেছেন তার সঙ্গে কবিতার ষষ্ঠ স্তবক সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ হয় নি। এ সম্পর্কে তোমার অভিমত আলোচনা করো।
“এই কবিতাটির প্রধান ত্রুটি এই যে এটিতে নানা বিরোধী ভাবের সমাবেশ হওয়ায় কাব্যের ফলশ্রুতি বিঘ্নিত হয়েছে।”- নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে এই মন্তব্য কতখানি প্রযোজ্য, তা আলোচনা করে দেখাও।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আত্ম-জাগরণের মধ্য দিয়ে ভাবতন্ময় কবি সহসা নিজেকে চিনতে পেরেছেন, পেয়েছেন আপন স্বরূপের পরিচয়। এর ফলে তাঁর ক্ষুদ্র আমিত্বের গুটি ভেঙে প্রজাপতি-রূপ ‘বৃহৎ আমি’র যে জাগরণ, সেই জাগরণের প্রচণ্ড উল্লাসবোধই কবিতাটিতে ছড়িয়ে আছে। বৃহতের বুকে জেগে ওঠা কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এই বিদ্রোহ সর্বপ্রকার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। প্রাথমিকভাবে এই বিদ্রোহ খেয়ালী বিধানের বিরুদ্ধে, খেয়ালী ভগবানের সৃষ্ট এই খেয়ালী সৃষ্টির বিরুদ্ধে, এই বিদ্রোহ মানুষের যে কোনোরকম পরাধীনতার বিরুদ্ধে। শুধু রাজনৈতিক পরাধীনতাই নয়, সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় সবক্ষেত্রেই অধীনতার যে বশ্যতা হতাশা ও অবসাদ রয়েছে তার সবকিছুর বিরুদ্ধেই একটা সর্বাত্মক বিদ্রোহের আহ্বান এই কবিতাটিতে ধ্বনিত। তিনি এই জীর্ণ বিশ্ব তথা পৃথিবীকে ভাঙতে চান। কিন্তু শুধু ভাঙ্গার জন্যই ভাঙ্গা নয়। জীর্ণ পুরাতনকে ভেঙে নতুন জগৎ নতুন পৃথিবী, নতুন মানুষ গড়তে চাওয়ার আহ্বানই এই বিদ্রোহী কবির আহ্বান। অশুভের স্থলে শুভকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামী চেতনাই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিদ্রোহ-চেতনা। এই বিদ্রোহের রুদ্র সঙ্গীতই কবিতাটির বিভিন্ন স্তবক স্তম্ভে মূলতঃ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই রুদ্রবীণার সঙ্গীত নির্ঘোষই কবিতার একমাত্র সুর নয়। কবির কথায় এই বিদ্রোহীর ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য। শুধু ধ্বংস নয়। নতুন সৃষ্টি কামনার বন্ধনহারা গঙ্গার ধারাকে ধারণ করে, বিশ্বের বিষ নিজের কণ্ঠে বহন করে পৃথিবীকে তিনি নতুন সৃষ্টিতে ভরিয়ে তুলবেন। তাই সংগ্রামের রণ-তূর্যের সঙ্গে নতুন সৃষ্টির আনন্দ নিয়ে বাঁশীও তিনি বাজাবেন। বিশ্ব-বিধাত্রীর বিদ্রোহী সুত কবি নিজেকে ‘শাসন-ত্রাসন’ এবং ‘অভিশাপ পৃথ্বীর’ বলে পরিচয় দিলেও তিনি যে নৃত্যপাগল এবং চপলা-চপল হিন্দোল’, তিনি যে ‘মুক্ত জীবনানন্দ’ সে কথাও বলেছেন।

এই ভাঙ্গার গান ও গড়ার আনন্দ সঙ্গীত নিয়ে কবি কখনো প্রশান্ত, কখনো অশান্ত হয়ে উঠেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এই দুমুখী ভাবনার সঙ্গে লঘু সুরের রোমান্টিক ভাবনাও একেবারে অলভ্য নয়। তৃতীয় স্তবকে তিনি হাম্বীর, ছায়ানট, হিন্দোল প্রভৃতি লঘু রাগ-রাগিণীর সঙ্গে নিজেকে তুলিত করেছেন। পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি ফিং’ দিয়ে তিনি তিন পাক দোল খেয়েও নিচ্ছেন। নিজের মনের খুশীতে ‘যখন চাহে এ মন যা’ তা করতে বিন্দুমাত্র কসুর করেন নি। পঞ্চম স্তবকে বিদ্রোহবাণীর প্রচণ্ড তাপ সঞ্চারিত হয়েছে, কিন্তু শেষ দুই পংক্তিতে দেখা যায়, তিনি শুধু ‘উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল’ হয়ে উঠতেই চাইছেন না, সেই সঙ্গে হয়ে উঠতে চাইছেন ‘উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল’। এইভাবেই সপ্তম স্তবকে তিনি ‘সিন্ধু উতলা ঘুম-ঘুম’ হয়েও আপন রোষাগ্নির প্রচণ্ডতায় হাবিয়া দোজখের ভয়ঙ্কর আগুনকেও ম্লান করে তোলেন। অষ্টম স্তবকে তিনি জাহান্নামের আগুনে বসেও পুষ্পের হাসি হাসেন। এইভাবে প্রায় অধিকাংশ স্তবকেই বিদ্রোহী রূপের অশান্ত, প্রশান্ত এবং রোমান্টিক—এই ত্রি-ধারাই দেখতে পাওয়া যায়। এই ত্রি-ধারার মূলে রয়েছে কবির সুগভীর মানবপ্রেম। মানুষকে ভালবেসেই তিনি বিশ্বকে ভালোবেসেছেন। মানুষের মধ্যেই খুঁজেছেন মনের মানুষকে। কবির বিদ্রোহ ভাবনার সঙ্গে এই ত্রিধারা যুক্ত হওয়ায় কবির বিদ্রোহী রূপে এসেছে বৈচিত্র্য। নইলে যে কোনো একটি ভাবনার বৃত্তেই তাঁর কল্পনা আবর্তিত হলে তা একমুখী বা একঘেয়েও হয়ে উঠতে পারত।

তবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এই রোমান্টিক চেতনা অন্যান্য স্তবকে কিছু কিছু থাকলেও ষষ্ঠ স্তবকের প্রথমার্ধে তা প্রাধান্য লাভ করেছে। অবশ্য এই কবিতার স্তবক গঠন সম্পর্কে একটা কথা স্মরণ রাখা যেতে পারে যে কবিতাটি মোট বার স্তবকে গঠিত হলেও সবগুলি স্তবকে তার আরম্ভ ও শেষ নিয়ে সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ করা যায় না। ফলে সমালোচকগণ বিভিন্ন ভাবে এর স্তবক চিহ্নিত করেছেন। ষষ্ঠ স্তবক সম্পর্কে এ কথাটা বেশী করে প্রযোজ্য। কারো কারো মতে এই স্তবকটি একত্রিশ পংক্তিতে গঠিত। এবং তাহলে এর প্রথমার্ধ রোমান্টিক। কিন্তু শেষার্ধ বিশেষ করে শেষ আট পংক্তিতে কবির প্রচণ্ডতা খুবই স্পষ্ট। এখানে কবি সুখী ও দুঃখী সকল কালের সব মানুষের সমবয়সী ও সমানধর্মী হয়ে তাদের অংশভাক্ হয়ে উঠতে চাইছেন। তাদের হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগে তাদের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার শুধু অংশীদার নয়, বিশ্বব্যাপী আত্মোপলব্ধির ফলে সবার এই প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, এই আশা-নিরাশাকে নিজেরই স্বরূপের একটা প্রকাশ বলে তিনি মনে করেছেন। তাই কবি মনে করছেন ‘বন্ধহারা কুমারীর বেণী’ও তিনিই, তার নয়নের বহ্নিও তাঁরই প্রকাশ, আবার বিধবার বুকে কুন্দন শ্বাস, হুতাশীর হা-হুতাশ, এও তিনিই। বিশ্বাত্মযোগে আত্ম-উপলব্ধির এই এক রোমান্টিক প্রকাশ।

এ প্রকাশ মধুর, এ প্রকাশ রোমান্টিক এবং ষষ্ঠ স্তবকের দীর্ঘ প্রথম অর্ধে কবি বর্ণিত এইরকম সামগ্রিক রোমান্টিক মনোভাব কবিতার অন্যত্র প্রকাশ পায়নি। কুমারী মেয়ের এলায়িত বেণী, তন্বী তরুণীর নয়নের ক্রোধের অনল, ষোড়শী হৃদয় মথিত উদ্দাম প্রেমের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন করে ভেবেছেন: এখানে কবি রোমাণ্টিক-বিদ্রোহী। আবার নিজেকে উন্মন চিত্তের ঔদাস্য, বিধবার বুকে চাপা ক্রন্দন, হুতাশীর মনের হুতাশ জ্বালা, অনিকেত মানুষের গৃহ হারানোর জ্বালা, অপমানিতের মর্মবেদনার কথা থাকলেও এই বর্ণনার মধ্যেও কবির রোমাণ্টিক আকুতিই প্রধান হয়ে উঠেছে। এর পরের পংক্তি কয়টিতে কবি আবার চূড়ান্তভাবে রোমান্টিক। কুমারী মেয়ের হৃদয় চুরি করা প্রথম স্পর্শের সঙ্গে, তার তনুমনের শিহরণের সঙ্গে, চঞ্চল মেয়ের চপল ভালোবাসার সঙ্গে একাত্ম করে ভাব-বিহ্বল কবির উচ্ছ্বাসময় যে প্রকাশ এই প্রকাশও রোমান্টিক মানসিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন।

অবশ্য সমগ্র ষষ্ঠ স্তবক সম্পর্কে কবির এই রোমান্টিক-মানসিকতার প্রাধান্যের কথা বলা যায় না। এই স্তবকের শেষাংশে কবির মধ্যে রৌদ্ররসের আবার জাগরণ ঘটেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় প্রকাশিত যে উন্মত্ত তাণ্ডব, এই বিশ্বের ধ্বংস ও সৃষ্টির মহাযজ্ঞের যে বিপুল কর্মকাণ্ডের কথা বলা হয়েছে, যে মহাবিদ্রোহ ও বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে প্রাথমিক বিচারে এই দীর্ঘ স্তবকের অনেকখানি জুড়ে প্রকাশিত যে রোমান্টিক ভাবনা, তা সমগ্রের সঙ্গে অন্বিত নয় বলেই মনে হবে। কিন্তু সমগ্র কবিতাটির দিকে একযোগে তাকালে বলা যায় এই স্তবকের প্রথমার্ধের দীর্ঘ রোমান্টিক ভাবনা মূলের সঙ্গে বিশ্লিষ্ট ও সম্পর্কহীন নয়। কারণ, প্রথমত, এই জাতীয় রোমান্টিক হৃদয়বৃত্তির শুধু এই স্তবকেই পাওয়া যায়নি, অন্যান্য স্তবকেও এর কিছু-কিঞ্চিৎ উল্লেখ আমরা পাই। দ্বিতীয়ত, আত্মোপলব্ধির মধ্যে দিয়ে সহসা কবি-মনের যে জাগরণ ঘটেছে, সেই জাগরণজনিত উচ্ছ্বাস সমগ্র কবিতার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। কবি উচ্ছ্বসিত, তাই কবি বলেন, ‘আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা।’ উচ্ছ্বাসের ফলেই তাঁর সমস্ত কথাই প্রবল এবং সব সুরই উচ্চগ্রামে বাঁধা—তা সে ধ্বংসের কথাই হোক বা সৃষ্টির কথা, অথবা আবেগতপ্ত ভাবপ্রবণ হৃদয়কথা। তৃতীয়ত্ব এই কবিতায় সামগ্রিকভাবেই প্রকাশ পেয়েছে কবি-মনের বিশ্বাত্মবোধ তথা সর্বব্যাপী আত্মবোধের কথা। এই ধ্বংস-সৃষ্টি, নিয়ম-অনিয়ম, আশা-হতাশা, প্রেম-ভালোবাসা সবই তো বিশ্ববোধের অঙ্গ। তাই কবি সর্ববোধের স্বঙ্গেই এক হতে চান। সবার মধ্য দিয়েই নিজেকে অনুভব করেন। খণ্ড-ভাবনা, সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধেই কবির এই বিদ্রোহ। এইদিক দিয়ে বিচার করলে এই কবিতার ষষ্ঠ স্তবকে বর্ণিত এই রোমান্টিক চেতনা সঙ্গতিহীন বলে মনে করা যায় না। আর যে কোনো বিদ্রোহী-ভাবনা কোনো বিষয় সম্পর্কে বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন হলেও সেইটাই তো তার একমাত্র পরিচয় নয়, মানুষ হিসেবে তার অন্যান্য দিকও তো রয়েছে; মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলিকেও নিয়ে বিদ্রোহী মানুষের একটা সার্বিক পরিচয়ই কবিতাটির মধ্যে সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। তাই ষষ্ঠ স্তবকের প্রথম অর্ধে এই রোমান্টিক ভাবনা দীর্ঘ হলেও সমগ্রের সঙ্গে বিচারে অসঙ্গত নয়। মোহিতলালের যে ‘আমি’ রচনাটির কথা বলা হয়ে থাকে সেখানেও ‘আমি’র বিদ্রোহী বিধ্বংসী রূপ ও স্রষ্টা রূপের সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক মানসিকতার কথাও বর্ণিত হয়েছে। গীতাতেও ভগবানের বিশ্বরূপ বর্ণনায় বিশ্বের সমস্ত রূপের ও সমস্ত ভাবনারই সংহত প্রকাশ ঘটেছে।

কাজেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ষষ্ঠ স্তবকে রণ-ভূর্যের বাঁশের বাঁশরীর আনন্দ-সঙ্গীত স্পষ্ট ও প্রধান হয়ে উঠলেও এবং কবিতায় রুদ্র সঙ্গীতের এই রোমান্টিক স্বপ্ন-সঙ্গীত আঘাত অসঙ্গত বলে মনে হলেও সামগ্রিকভাবে এই মিষ্টি মধুর রোমান্টিক চিন্তা কবিতাটিতে রসাভাসের সৃষ্টি করে নি।