‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় নজরুল তাঁর কাব্য রচনার যে কৈফিয়ৎ দিয়েছেন তার মধ্য থেকেই তাঁর কাব্যাদর্শ সম্পর্কে ধারণা করতে অসুবিধে হয় না।”—এই মন্তব্যটির সার্থকতা বিচার করো।
‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কবি নজরুল ইসলামের স্বতন্ত্র কাবাদর্শের অকুণ্ঠ ঘোষণা করেছেন। কবিতাটি বিশ্লেষণ করে এই নিজস্ব কাব্যপন্থার স্বরূপ বিবৃত করো।
‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি একাধারে কবি নজরুলের জীবন দর্শন, সমকালীন সমাজ অবস্থা ও রাজনৈতিক হতাশার পরিচায়ক—এই উক্তিটির সমীচীনতা বিচার করো।
‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় কবি কার কাছে কিসের কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন? কৈফিয়তের সূত্রে তিনি যা বলেছেন, তা কবির জীবন দর্শনের এক শ্রেষ্ঠ দলিল হয়ে উঠেছে একথা বলার যৌক্তিকতা আলোচনা করো।
কৈফিয়ৎ বা জবাবদিহি করে অভিযুক্ত বা আসামী। আপনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের জবাবদিহি করতে গিয়ে কবি নিজেকেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কবির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এবং অভিযোগ অনেকের। সাহিত্যিক, ধর্মনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক—সমাজের সর্বস্তরের অনেক মানুষই তাদের নানান অভিযোগের ডালি নিয়ে কবির কাছে হাজির হয়েছেন। তাদের অভিযোগ, তাদের কারো সঙ্গেই কবির সম্পূর্ণ মতের মিল হয় না। কবি কারো সঙ্গেই নিজেকে সম্পূর্ণ মিলিয়ে চলতে পারেন না। পরস্পর বিরোধী দোষগুণ নিয়েই কবির চরিত্র গড়ে উঠেছে। কবি সম্বন্ধে এই নানান ধরনের অভিযোগেরই কৈফিয়ৎ বা উত্তরদানের প্রচেষ্টা রয়েছে কবিকৃত ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায়।
চোদ্দটি স্তবকে গঠিত এই দীর্ঘ কবিতার প্রথম স্তবকে কবি তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত অভিযোগগুলি নিজেই তুলে ধরেছেন। প্রথমেই বলেছেন তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি প্রসঙ্গে অন্যান্য সাহিত্যিক ও সাহিত্য-বন্ধুদের অভিযোগগুলির কথা। তাঁদের অভিযোগ, কবির কবিতায় সাহিত্যের শাশ্বত মূল্য খুঁজে পাওয়া যায়। । সত্য ও সুন্দরের উপাসক কবি নন, তাই উন্নত ভাব ও কল্পনা নিয়ে চিরকালীন সাহিত্য তিনি সৃষ্টি করতে পারেন নি। এই সমালোচকগণের মতে নজরুল সমসাময়িককালের ঘটনা নিয়ে বর্তমানের হুজুগেই মেতে আছেন। কবি-বন্ধুদের আরো ধারণা নজরুলের মধ্যে উচ্চতর প্রতিভার সম্ভাবনা ছিল, আগে তিনি উচ্চ ভাবনা-সমৃদ্ধ কবিতা রচনা করতে পারতেন। কিন্তু রাজনীতির আবর্জনা ঘেটেই, পলিটিক্সে জড়িয়ে গিয়েই কবির প্রতিভা ক্রমেই নষ্ট হতে বসেছে। ভাবসমৃদ্ধ রচনা সৃষ্টির জন্য যে পড়াশোনা করা প্রয়োজন, সে অবসরও নজরুলের নেই। কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে বিয়ে করে দাম্পত্য জীবনে অত্যধিক জড়িয়ে পড়াই হয়েছে তাঁর উচ্চতর সাহিত্যসৃষ্টির সবচেয়ে প্রতিবন্ধক। কবির প্রথমদিকের সাহিত্যগুরু একবার বলেছিলেন, কবিতায় সত্য সুন্দরের শাশ্বতবাণীর বদলে বিদ্রোহের বাণী প্রচার করে যেন তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছতে শুরু করেছেন। তাঁর মতে এ-কাজ কবির কাজ নয়। কবির প্রতি অভিযোগের পাল্লা ভারী করতে ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদকও কারো থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। তৎকালীন সাহিত্যিক ও সাহিত্যসেবীদের মনের প্রত্যাশা কবিকে দিয়ে পূরণ হয় নি। তাই তাঁদের অভিযোগেরও শেষ নেই।
ধর্মনৈতিক ক্ষেত্রেও কবির আচরণ সবাইকে তুষ্ট করতে পারেনি। কবি মুসলমান হয়েও হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছেন তাই হিন্দু বন্ধুরা তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ। অপরদিকে মৌলবী ও মোল্লাদেরও ক্ষোভ রয়েছে তাঁর প্রতি। কারণ মুসলমান হয়েও তিনি হিন্দু দেবদেবীকে নিয়ে কবিতা লেখেন। কাজেই মৌলবী-মোল্লাদের মতে নজরুল কাফের, তাঁকে জাতিচ্যুত করাই উচিত। আবার কবিতায় ফার্সী শব্দের বহুল প্রয়োগ দেখে হিন্দুরা তাঁকে একজন সাধারণ পাতি মুসলমান বলেই মনে করে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনে ব্রতী মানুষেরা কবিকে তাদের পক্ষীয় লোক বলে মনে করে না। কারণ তাদের মতে কবির কবিতায় রয়েছে বিপ্লবীদের মন তুষ্ট করা বিপ্লবের বাণী। আবার বিপ্লবীদের মতে কবি গান্ধীজীর আন্দোলনের প্রতীক চরকাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তাই তিনি যথার্থ বিপ্লবীও নন। সংস্কার-মুক্ত কবি গোঁড়া ধর্মধ্বজীদের চোখে নাস্তিক, আবার পাতিরাম সদৃশ স্বল্প ধর্মধ্বজীদের চোখে তিনি কনফুসিয়াসকল্প ধর্মপ্রবক্তা। স্বরাজপন্থীদের চোখে তিনি নৈরাজ্যবাদী, অন্যদিকে, নৈরাজ্যবাদীরাও তাঁকে পথের কাঁটা বা শত্রু বলেই মনে করে।
সামাজিক ক্ষেত্রেও তিনি কোথাও বিশেষ কক্ষে পান নি। পুরুষ মানুষ ভাবে কবি বড় নারী-প্রেমিক, নারীরা মনে করে কবি নারী বিদ্বেষী। বিলেতী বিদ্যে কবির নেই বলে বিলেত-প্রবাসী বন্ধুরাও কবিকে পাত্তা দেয় না। তাই নজরুল-ভক্তরা কবিকে নতুন কালের কবি-সূর্য বলে অভিনন্দন জানালেও তিনি বর্তমানের হুজুগের কবি হয়েই রইলেন।
কবি সম্পর্কে বিভিন্ন স্তরে মানুষের এই যে অভিযোগ, সেই অভিযোগের কথা তিনি নিজেই তুলে ধরেছেন এবং কৈফিয়তের মধ্য দিয়ে তার উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। কবি-কৃত এই মধ্যেই একদিকে যেমন তাঁর বক্তব্য খুব স্পষ্ট হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে কবির মনের গুহায়িত বেদনাও ধরা পড়েছে। ধরা পড়েছে তাঁর নিজস্ব কাব্য রচনার আদর্শ।
কবি বলেন, নিজের অন্তরের জ্বালা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি যে কি লেখেন তা তিনি নিজেই বোঝেন না। দেশের অসহায় মানুষের ওপর প্রবল অত্যাচারের প্রতিবাদ একা সক্রিয়ভাবে করতে পারেন না বলেই প্রতিবাদী লেখকের বৃত্তিই তিনি নিয়েছেন। আর এতে তাঁর প্রতি কোন পক্ষই তুষ্ট নয়। অবশ্য, কবি জানেন, বুদ্ধিমানের মতো একটু সমঝে চলতে পারলে কবির সবদিক দিয়েই সুবিধে হত। তিনি মনকেও অনেক বোঝাতে চেয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ তিনি কিছুতেই বাগ মানাতে পারেন না। নিজের আখের গুছিয়ে নেবার সুযোগ কবি পেয়েছিলেন। দেশের মানুষের কাছে তিনি প্রায় অর্ধেক নেতা হয়ে উঠেছিলেন। মেকী দেশপ্রেমীদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারলে তিনি পুরো নেতাই হয়ে উঠতে পারতেন। নিজের বৈষয়িক সমৃদ্ধি অর্জনও অসম্ভব ছিল না। কিন্তু কবি তা পারেন নি। কবির বিবেকবোধ সর্বৈব সহানুভূতি ও মানবতাবাদ কবির সেই মসৃণ চলার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে।
জনজাগরণের কামনা নিয়ে মনের ক্ষোভে চারণ কবির মত তিনি পথে পথে ঘুরে বেড়ান। তিনি দেখেন, ছদ্ম-দেশপ্রেমীতে দেশ ছেয়ে গেছে। দেশের স্বাধীনতা বা স্বরাজ আনবার কথা বলে এইসব স্বার্থান্ধ দেশপ্রেমীরা চাঁদার নাম করে দেশের নিঃসম্বল মানুষের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে তাদের প্রতারিত করছে। তাদের গ্রাস থেকে শিশুর ক্ষুধার অন্ন বাদ যাচ্ছে না। ক্ষুধাতুর শিশুর জননী কিন্তু স্বরাজের বৃথা আশ্বাস দিয়ে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছে। স্বরাজ সাধনার এই প্রচেষ্টাকে কবি হাস্যকর বলেই মনে করেন। কবি মনে করেন তারা চাইছে স্বরাজ, কিন্তু পাচ্ছে বেগুন পোড়া। কারণ বাঘের মত হিংস্র স্বভাব যে ব্রিটিশ রাজশক্তি অসহায় ভারতবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মায়ের কোল থেকে ছেলে কেড়ে নিয়ে তার রক্ত শুষে নিচ্ছে তাদের প্রতিনিবৃত্ত করতে অহিংসার বাণী একেবারেই ব্যর্থ।
শোষক ব্রিটিশ সরকার এবং মেকী দেশপ্রেমীদের চাপে পড়ে দেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত, মৃতপ্রায়। অত্যাচার আর ক্ষুধার দ্বি-মুখী আক্রমণে দেশের মানুষ অবিরত বিপর্যস্ত হচ্ছে। দেশের এই দুর্দিনে দেশের সাধারণ মানুষের এই চরম দুর্দশা দেখে কবি নিরব থাকতে পারেন না। কবির বুকের বিষ-জ্বালাই কবিকে লেখনী ধারণে বাধ্য করে। এই মানসিকতার ফলে তিনি মহৎ ভাব ও কল্পনা নিয়ে কাব্যে সুন্দরের আরাধনাও করতে পারেন না। তাই ‘ভবিষ্যতের নবী’ তিনি আর হতে পারলেন না। তিনি হলেন তাঁর কালে সাধারণ মানুষের কবি, তাদের ব্যথা ও বেদনার কবি, সমকালীন ভাবনার কবি, ‘বর্তমানের কবি’ এবং সেই অর্থে ‘হুজুগের কবি’।
কবি তাঁর মনের মর্মবেদনা এই দীর্ঘ কবিতাটির শেষ দুই স্তবকে উজাড় করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে প্রকাশ করেছেন তাঁর ক্রোধ ও অভিশাপ। সর্বহারা মানুষের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কবি কামনা করেছেন তাঁর হৃদয় নিহ্বান রক্তাক্ত লেখায় যেন এই শোষক শ্রেণির সর্বনাশের ঘণ্টা প্রতিধ্বনিত হয়, যেন লেখা হয় তাদের সর্বনাশের ইতিকথা। তাহলে হুজুগের কবি হয়েও তিনি নিজেকে সার্থক বলেই মনে করবেন। সমগ্র কবিতাটির মধ্যেই মানব-দরদী ও মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামী নজরুলের উত্তপ্ত হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সবল কবি-কণ্ঠের নির্ভীক উচ্চারণ। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় নিজেকে আসামীরূপে দাঁড় করিয়ে শেষে জাতির সামনে সমগ্র অত্যাচারী শাসক-শোষক কুলকেই কবি আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এবং শেষ অভিশাপ বর্ষণের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর শেষ বিচারের রায়টিও দিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন ‘বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে নিয়ে বড় কথা বড় ভাব আসে নাক মাথায়। তাই অমর কাব্য লেখার দায় অন্যান্য লেখকদের দিয়ে দেশব্যাপী প্রবল অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতেই ‘রক্ত লেখা’য় তাঁর কাব্য লেখার ব্রত তিনি গ্রহণ করেছেন। তিনি বলছেন—
‘প্রার্থনা করো-যারা কেঁড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।
Leave a comment