বিদ্রোহী কবি নজরুল সমাজ ও সংসারের সংস্কার ও অনুশাসনকে অস্বীকার করতেন এবং অন্য যাঁরা এই সামাজিক বেষ্টনীকে লঙ্ঘন করতেন তাঁরাও পেতেন তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন। দুঃখের ভাবনা অনেক কবিরই কবিতায় আত্মপ্রকাশ করে, এমন কি রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, যদিও তাঁকে দুঃখের কবি বলা যায় না। দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্যে একটি পার্থক্য বিদ্যমান। দারিদ্র্যের অর্থনৈতিক অভাববোধ থাকে কিন্তু দুঃখের মধ্যে অন্য ভাবের সুর।

‘দারিদ্র্য’ কবিতাটিতে কবি নজরুল দারিদ্র্যের বন্দনা করেছেন। কিন্তু সেই বন্দনা করতে গিয়ে তিনি নিজে কিভাবে মহান হয়ে উঠেছেন তা বিবৃত করেছেন।

দারিদ্র্য কবিকে যীশুখ্রীস্টের মত সম্মানিত করেছে। খ্রীস্টকে তাঁর স্বজাতীয় ইহুদিদের অভিযোগে কণ্টকমুকুট পরিধান করতে হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত রোমান শাসকদের হাতে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কিন্তু এই মহান আত্মদান খ্রীস্টকে মানবসমাজে চিরন্তন গৌরব দান করেছে। বস্তুত সত্যের জন্য নির্যাতন বরণ বা আত্মত্যাগ ব্যক্তি মানুষকে যে মহত্ত্ব দান করে দারিদ্র্যের নিপীড়নে কবিও তার অংশীদার বলে নিজেকে মনে। করেন। কারণ, কবিরা বিশ্বের সত্যকেই প্রকাশ করার চেষ্টা করেন এবং তা করতে গিয়ে আলোচ্য কবিতার কবিকেও দারিদ্র্য বরণ করতে হয়েছে। জাগতিক অভাব তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু আত্মিক ক্ষেত্রে তিনি যে গৌরব অনুভব করছেন অভাববোধ তার কাছে তুচ্ছ। কাঁটার মুকুটের যন্ত্রণাও যেমন যীশুখ্রীস্টকে সত্য থেকে ভ্রষ্ট করতে পারে নি, দারিদ্র্যের যন্ত্রণাও তেমনি কবিকে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের শক্তি দিয়েছে।

কাব্য রচনার যে ক্ষমতা কবির সহজাত তাঁকেই ব্যবহার করে তিনি অসঙ্কোচে নির্দ্বিধায় সত্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। দারিদ্র্যই তাঁর সকল লজ্জা ও সংকোচ দূর করে দিয়েছে এবং তাঁর কবিত্বশক্তিকে তীক্ষ্ণ শাণিত অস্ত্ররূপে অসত্যের বিরুদ্ধে ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করেছে। দারিদ্র্যের স্পর্শে কবির বীণা ক্ষুরধার তরবারি হয়ে উঠেছে।

দারিদ্র্যের উত্তাপে কবির সকল আনন্দের আয়োজন বিনষ্ট হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে নিঃস্বতা থাকলেও বিনয়ের ছদ্মবেশ থাকে না। দারিদ্র্য চায় প্রকৃত সত্যের স্পষ্ট ও অবাধ প্রকাশ। তাই কবি বলেন—

“বিনয়ের ব্যাভিচার নাহি তব পাশ, 

তুমি চাহ নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ।”

প্রকৃত সত্যকে প্রকাশ করার অনির্বাণ আকাঙ্ক্ষা, চরম অভাবের মধ্যেও মাথা নীচু না করার গৌরব, মৃত্যুকে অবহেলা করে জীবনকে সুন্দর করার অবিরত সংগ্রাম কবির দারিদ্র্য পীড়িত এবং কবির মত অন্যদের মধ্যে অনির্বাণ আত্মশুদ্ধির অগ্নি জ্বালিয়ে রেখেছে। তাই কবি বলেছেন— 

“সঙ্কোচ শরম বলি’ জাননাক’ কিছু, 

উন্নত করিছ শির যারা মাথা নীচু।

মৃত্যু-পথ-যাত্রীদল তোমার ইঙ্গিতে 

গলায় পরিছে ফাঁসি হাসিতে হাসিতে।”

এখানে অভাববোধটি রূপান্তরিত হয়ে গছে স্বাধীনতার অভাববোধে। পরাধীনতার যে দারিদ্র্য তারই নজরুল ইঙ্গিত করেছেন এবং বলেছেন যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার জন্ম স্বাধীনতার অভাব থেকেই।

দরিদ্র মানুষকে মহান বলে প্রতিপন্ন করে কবি দারিদ্র্যকে মহত্ত্ব অর্পণ করেছেন এবং এই দরিদ্র মানবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে কবি নিজেকেও মহান বলে ঘোষণা করেছেন। দুঃখের মধ্যেই মনুষ্যত্বের পূর্ণতা ঘটে, আনন্দের মধ্যে নয়। উৎসবের আনন্দের দিনেও বিরহের করুণ মূর্ছনা কবিচিত্তকে চঞ্চল করে তোলে। কবির কাছে সানাইয়ের সুর আগমনীর বার্তাবহ নয়, তার করুণ রাগিণী সর্বহারার বেদনাবাহী। তাই কবি বলেন—

“আজো শুনি আগমনী গাহিছে সানাই, 

ও যেন কাঁদিছে শুধু—নাই, কিছু নাই।”

দারিদ্র্যই কবিকে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টি দান করেছে। সেই দারিদ্র্য শুধু দৈনন্দিন জীবনে পার্থিব অভাববোধ নয়, সামগ্রিকভাবে তা মানবজীবনে সকল অভাবের বোধ। এমন কি আত্মিক। আর সেই অভাববোধই মানুষকে মনুষ্যত্বের মহিমায় উত্তীর্ণ করে দেয়, তার সৃজন-প্রতিভাকে পরিপুষ্ট ও প্রবর্ধিত করে তোলে। সুতরাং কবির উপলব্ধি এই যে, মনুষ্যত্বের যে মহিমা তিনি উপলব্ধি করেন ও শিল্পকর্মে প্রকাশ করেন, তা দারিদ্র্যেরই দান।