জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’ কবিতাটিকে আপাতভাবে একটি প্রেমের কবিতা হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া চলে। কিন্তু জীবনানন্দ যেহেতু জটিলতম সময়ের দুর্বোধ্যতম কবি এবং যেহেতু তাঁর কবিতার বয়ানের মধ্যেই থাকে এক বহুস্তরিক সুর, সেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে কবিতাটিকে প্রেমের কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করাও বিপজ্জনক।

‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি বিশিষ্ট কবিতা ‘সুচেতনা’ এবং ‘সুচেতনা’ কবিতাটি পড়তে গেলে প্রায়শই মনে পড়ে যায় ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিকেই। কেননা অন্তত ‘সুচেতনা’র সূচনাংশে বনলতার কিছু অনুষঙ্গ আছে। ‘বনলতা সেন’ কবিতাতেও পথভ্রান্ত হালভাঙা নাবিক দারুচিনি দ্বীপের শান্ত নির্জনতায় হাজার বছরের পথ হাঁটা শেষ করে শান্তির আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে বনলতার দৃষ্টির ভিতরে। ‘সুচেতনা’ কবিতার সূচনাতেও সেই দারুচিনি দ্বীপ আর নির্জনতার প্রতিবেশ আছে। তবে বনলতা স্থাপিত হয়েছিল নির্জন দারুচিনি দ্বীপে আর সুচেতনা স্বয়ং যেন ‘দূরতর দ্বীপ’, আর সেই স্বপ্নময় দূরতর দ্বীপে আছে দারুচিনি নির্জনতা।

বনলতার মতোই এক স্বপ্ন নায়িকা যেন সুচেতনা। মনে হতেই পারে কবিকল্পিত অন্যান্য নায়িকা-নামগুলি—যেমন বনলতা সেন, শ্যামলী, সবিতা, সুরঞ্জনা—তেমন সুচেতনাও এক নারী-নাম। সেই স্বপ্নময়ী দূরতম অপ্রাপনীয়া কল্প নারীটিকে ঘিরে কবিমানসের উন্মোচন ঘটেছে এ কবিতায়। অতএব ‘সুচেতনা’ কবিতাটিকে প্রেমের কবিতা হিসাবে চিহ্নিত করা যেতেই পারে। বিশেষ করে কবিমনের এই প্রেমাকর্ষণ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রথম স্তবকের শেষ পঙক্তিতে—”তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।”

কিন্তু এই প্রথম স্তবকের পর যেন ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে, ব্যক্তি প্রেমের আবেগময়তাকে অতিক্রম করে ‘সুচেতনা’ কবিতাটি কবির ইতিহাসবোধ ও সমাজচেতনার পরিচয়ই যেন বেশি মেলে ধরেছে। আরো বেশি করে এ কবিতা কবির জীবনদৃষ্টির পরিচায়ক। ফলে নিছক প্রেমের কবিতা বলে চিহ্নিত করলে ‘সুচেতনা’ কবিতার মাত্রাগত বিস্তারটির প্রতি অবিচার করা হয়।

আসলে সম্ভবত ‘সুচেতনা’ কোনো নারী নয়। সমগ্র কবিতাটি পাঠ করার পর মনে হয়, ‘সুচেতনা’ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর সমাজ ও মানবজীবন সম্পর্কে কবির প্রত্যাশা ও স্বপ্নেরই এক ঘনীভূত রূপ। জনৈক আলোচকের মতে—’এখানে ‘সুচেতনা’ কবির ভাবের, আদর্শের বোধির বাহন হয়ে উঠেছে। তবু যদি একে প্রেমের কবিতা ধরা হয়, দেখা যাবে, প্রথম স্তবক ছাড়া কোথাও কবির ব্যক্তিমনের স্পর্শ নেই।”

প্রথম স্তবকেই ‘পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা’ অর্থাৎ সভ্যতার উন্নয়ন প্রয়াসকে ‘সত্য’ বলে স্বীকার করেও ‘শেষ সত্য বলে মানতে পারেননি কবি। কলকাতা নগরীও একদিন ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা’ হবে সভ্যতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির কল্যাণে। তবু কবির যেন মনে হয়, এই সভ্যতার যাবতীয় বাহ্য উন্নয়ন প্রয়াসের মধ্যে মানবিক সুস্থতার লক্ষণ নেই, হৃদয় নেই। সু-চেতনা বলতে যা বোঝায়, আধুনিক সভ্যতা যেন তা থেকে ভ্রষ্ট। সু-চেতনার কাছেই কবির হৃদয় তাই আত্মসমর্পণ করতে চায়, বাহা সম্পদের কাছে নয়।

‘বনলতা সেন’ কবিতায় যেমন ‘হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে কবি ক্লান্ত, তেমনি ‘সুচেতনা’ কবিতাতেও ‘অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে’ কিন্তু রুঢ় বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন কবি। দেখেছেন, মানবকল্যাণের জন্য সভ্যতার পথে অগ্রসর হতে গিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে মানুষের হাত আত্মীয়-পরিজনের রক্তে রক্তাক্ত। যুদ্ধোত্তর পৃথিবী সভ্যতার সেই অসুখগ্রস্ত অমানবিক চেহারাটা নগ্ন করে মেলে ধরেছে কবির সামনে। তবু এই প্রতিকূল বাস্তবের মাঝখানেও মানুষ কেবলই প্রেম খুঁজেছে, পৃথিবীকে ভালোবেসেছে।

হয়তো মানব কল্যাণের জন্য যুগ যুগ ধরে বুদ্ধ বা কনফুশিয়াসের মতো মনীষীদের প্রয়াসও এইসব অমানবিক লোভী মানুষদের বর্বর উল্লাসে ঘৃণায় ক্ষোভে মূক হয়ে যায়। তবু কবি বিশ্বাস করেন, মানুষের শুভ চেতনার কোনো বিনাশ নেই। সেই শুভ চেতনা বা মানব কল্যাণের সু-চেতনার প্রয়াসই পৃথিবীর উত্তরণের একমাত্র পথ—“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে—এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।”

কবি জানেন, হয়তো সেই পাপমুক্ত লোভমুক্ত হিংসামুক্ত পৃথিবীকে পাওয়া যাবে বহু মনীষীর প্রচেষ্টায় ‘ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে’, তবু সেই সু-চেতনা সমৃদ্ধ পৃথিবী একদিন সত্যিই আসবে, সেই স্নিগ্ধ আশা কবির আলোচ্য কবিতার মূল কথা।

মানব জন্মের অনেক তিক্ত রূঢ় অভিজ্ঞতা হয়তো কবিকে ক্লান্ত ক্ষুব্ধ করে, তবু তারই মধ্যে মানব জন্মের দুর্লভ অভিজ্ঞতাকে কবি অশ্রদ্ধা করেননি। বলেছেন—“এ সে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি।” বুঝেছেন, কিছু মানুষের বিচ্যুতি, লোভ, বিকার, বঞ্চনা পৃথিবীকে অসুস্থ করলেও মানুষের শুভচেতনা বা সু-চেতনা বিনাশহীন। কল্যাণের পথে মানুষের এই দীর্ঘ প্রয়াস বা অভিযাত্রা হয়তো সবটুকু সফল নয়, হয়তো প্রত্যাশিত সবকিছু সে অর্জন করতে পারবেও না কোনোদিন। তবু তার শুভচেতনার সমস্ত প্রচেষ্টাই আসলে মহাপৃথিবীর বুকে অনন্ত সূর্যোদয়েরই সাধনা—”শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।”

ফলে ‘সুচেতনা’ কবিতা আসলে কবির জীবনাভিজ্ঞতা ও সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তাঁর সদর্থক জীবনদৃষ্টিরই নির্দেশক। মানুষের সু-চেতনা বা কল্যাণবোধের প্রতি মানবিকতার প্রতি, পারস্পরিক প্রীতি বা প্রেমবোধের প্রতি তাঁর যে মানসিক তীব্র টান, তাকে যদি প্রেমের রূপকে উপস্থাপন করা যায়, অন্তত মানবিক ‘সু-চেতনা’কে যদি সুচেতনা-নাম্নী কোনো প্রেমময়ী নারীর রূপকে ধরা যায়, তাহলে তাকে বৃহত্তর অর্থে প্রেমের কবিতা বলা যেতে পারে।