সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থের ‘বোধন’ কবিতা থেকে অংশটি উদ্ধৃত।

বাংলার এক মর্মান্তিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতাটি রচিত। ১৩৫০-এর মহামন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষের দারুণ বাস্তবতাই এই কবিতার পটভূমি। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী ও মানবতাবাদী কবি-শিল্পী-কথাকার-নাট্যকার কেউই এই ঐতিহাসিক অভিঘাতকে উপেক্ষা করতে পারেন নি।

১৯৪২-এ জাপান বার্মা অধিকার করলে বাংলায় সে দেশ থেকে চালের আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রামাঞ্চলে ‘পোড়ামাটি নীতি’ একদিকে কৃষককে নিঃস্ব করেছিল। সেইসঙ্গে যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা হিসাবে ব্রিটিশরা সৈন্যদের জন্য প্রচুর পরিমাণ ধানচাল মজুত করার ফলেও দেশে অন্নাভাবে দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক শৈথিল্য প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে মহাজন জোতদার কালোবাজারীরা অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সাধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য বেআইনী মজুত করে কোটি কোটি টাকা মুনাফার জন্য তারা সারা দেশে এক কৃত্রিম অন্নাভাব সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ১৩৫০ বঙ্গাব্দ বা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষ প্রাকৃতিক কারণে ঘটেনি। এই দুর্ভিক্ষ ছিল সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যসৃষ্ট। একদল সাম্রাজ্যলিপ্স্ ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক লুঠেরা এবং একদল অর্থলোভী নৈতিকবোধহীন মুনাফাবাজ অসাধু ব্যবসায়ী এই দুর্ভিক্ষনামক নরমেধযজ্ঞের ছিল প্রধান পুরোহিত।

পঞ্চাশের মন্বন্তর সর্বাপেক্ষা করাল ছায়া ফেলেছিল বাংলার গ্রামীণ জীবনে। বাংলার কৃষি-অর্থনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার আনুষঙ্গিক কারণে সম্পূর্ণই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে দুর্ভিক্ষ যখন স্পষ্ট হয়ে উঠল, তখন তার থাবায় প্রথম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল গ্রাম বাংলা। গ্রামের কৃষিজীবী মানুষ প্রথমে মহাজন বা জোতদারের কাছে তৈজসপত্র, হাল-বলদ এবং জমি-ভিটে বিক্রি করে অন্নসংস্থানের চেষ্টা করল। তারপর উপায়ান্তর না দেখে দলে দলে গঞ্জ ও শহরের স্টেশনচত্বরে, রেলপাড়ে, রাস্তায়, ফাঁকা জমিতে ও ফুটপাথে এসে ভিড় করল। ‘ফ্যান দাও’ আর্তনাদে ভরে উঠল শহরের আকাশ-বাতাস। ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্টের জন্য কুকুরে মানুষে এবং মানুষে মানুষে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মনুষ্যত্বের সাংঘাতিক অবনমন। মানুষ শুধু এই দুর্ভিক্ষে পথের ভিক্ষুকে পরিণত হয়নি, পশুর সঙ্গে মানুষের স্বভাবগত পার্থক্যটাও যেন হারিয়ে গেল। প্রতিদিন শয়ে শয়ে কঙ্কালসার মৃতদেহ শহরের রাজপথের দুপাশে পড়ে রইল। এই মন্বন্তর যেন আক্ষরিকভাবেই শস্যশ্যামল গ্রামবাংলাকে উজাড় করে দিয়ে পরিণত করল নিঃস্তব্ধ শ্মশানে। এই মৃত্যুময় অন্ধকার বিষণ্ণ পটভূমিতেই কবি তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

তৎকালীন বহু কবি, শিল্পী, কথাকার এবং নাট্যকারই পূর্ণ সহানুভূতি ও মানবিক বোধ নিয়ে পঞ্চাশের মন্বন্তরের বাস্তব চিত্রকে তাঁদের সৃষ্টিতে প্রতিফলিত করেছেন। কবি সুকান্তও সংবেদনশীল কবি হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই ব্যতিক্রম নন। কিন্তু সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় দুর্ভিক্ষের বীভৎস মর্মন্তুদ চিত্রাঙ্কনের পরিবর্তে একটি অন্যতর সুর শোনা গেল। এখানেই কবিতাটির স্বাতন্ত্র্য। সুকান্তর ‘বোধন’ কবিতায় দুর্ভিক্ষের বেদনা ও করুণরসের প্রকাশ তেমন স্পষ্ট নয়। বরং তার পরিবর্তে ‘বোধন’ কবিতায় প্রাথমিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে এক বিস্ময়বোধ—’তবু আজও বিস্ময় আমার…”

এ বিস্ময়ের কারণ নিহিত আছে কবির রাজনৈতিক মতাদর্শগত চৈতন্যের ভিতরে। প্রগতিসাহিত্য আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগসূত্রে কবি সুকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন নিশ্চেষ্টভাবে এই বিপর্যয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করলে কোনোদিনই সংকটমুক্তি ঘটবে না। সংকটমুক্তির জন্য চাই সংঘবদ্ধ জনশক্তির জাগরণ ও সক্রিয় প্রতিরোধ।

কিন্তু কবি সুকান্ত বাস্তবে তার বিপরীতাটাই লক্ষ্য করেছিলেন। একদিকে নিঃস্ব, নিজ ভিটে-জমি থেকে উচ্ছিন্ন, অন্নহীন, ভবিষ্যৎহীন গ্রামীণ কৃষিজীবী মানুষেরা শহরে এসেও বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পেল না। বরং শহরের কুটিল ধৃর্ত মানুষের দ্বারা প্রতারিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত হয়ে তারা ক্রমশ অসুস্থ হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু যে সংহতি শক্তি থাকলে এই হতদরিদ্র উচ্ছিন্ন ক্ষুধার্ত জনতা এই মৃত্যুচক্রান্তের যোগ্য জবাব দিতে পারত, সেই সংহতির বদলে তারা শুধু বিচ্ছিন্নভাবে মৃত্যুর প্রহর গুণছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই এই দুর্বিপাককে দুর্ভাগ্য বা কৃতকর্মের ফল বা ভবিতব্য বলে গ্রহণ করেছিল। এককথায় তারা প্রায় অনিবার্য মৃত্যুর কাছেই নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল।

অন্যদিকে শহরের বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তশ্রেণিরও একাংশ শহরাঞ্চলে এই ভিক্ষুকের স্রোতকে অবাঞ্ছিত ও অসুবিধা সৃষ্টিকারী বলে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছিল। শহরের উচ্চবিত্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণি তো এই দুর্যোগের সুযোগকে মুনাফা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ হিসাবেই গ্রহণ করেছিল। ফলে এই ভয়ংকর পরিস্থিতির যারা রচয়িতা, সেইসব রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী, সাম্রাজ্যবাদী প্রভু এবং অসাধু মুনাফাবাজ ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করার, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো সদর্থক চৈতন্য গড়ে উঠল না। কবির বিস্ময় এখানেই। কেননা, কবির মনে হয়েছে, যারা ধূর্ত ও প্রবক, যারা মানুষের মুখের অন্নটুকু কেড়ে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে, তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধও সংগ্রাম গড়ে না তুললে নিজেদের সর্বনাশ ছাড়া কিছুই ঘটে না। কবি বিস্মিত হয়েছেন এই নিশ্চেষ্ট প্রতিরোধহীনতার কারণে। আর কবি চেয়েছেন সেই গণচৈতন্যের উদ্বোধন, যে চেতনা প্রচণ্ড ক্রোধে এই সব ধূর্ত কুচক্রীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিহিংসার সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে।