সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বোধন’ কবিতায় কবির বিশেষ রাজনৈতিক দর্শন তথা জীবনদর্শনটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বামপন্থী সংগ্রামী চেতনায় প্রাণিত কবি দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যাকারী শোষক ও শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যারা দ্বিধাগ্রস্ত, তাদের বিরুদ্ধেই এই চূড়ান্ত ঘোষণাটি করেছেন।

‘বোধন’ কবিতাটি ১৩৫০-এর মহামন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৩৫০ তথা ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ তৎকালীন কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকার-চিত্রকরদের বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিল। এই কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের অধিকাংশই ছিলেন বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী। সুকান্ত ভট্টাচার্যও বামপন্থী রাজনীতি বা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ফলে স্বভাবতই তাঁর কবিতায় পঞ্চাশের মন্বন্তর তীব্রভাবেই ছায়াপাত ঘটিয়েছে। কিন্তু সুকান্তের ‘বোধন’ কবিতায় নিছক দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্র রচনা করা হয়। নি। দুর্গতির বিস্তৃত চিত্র অঙ্কনের পরিবর্তে ‘বোধন’ কবিতায় এসেছে দুর্ভিক্ষের উৎস সন্ধান করে মানবতার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী অপরাধীদের চিহ্নিতকরণ এবং সেই অপরাধী দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে দুর্গত মানুষের সংঘবদ্ধ শক্তির উদ্বোধন।

কবিতার সূচনায় এবং অভ্যন্তরেও কয়েকটি মাত্র পক্তিতে দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ চিত্র আছে। যেমন—’ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটে’, ‘নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি’, ‘নির্জনতার কালো’ কিংবা ‘মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার/আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল’ ইত্যাদি। এছাড়াও পাই—’শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি বা …..প্রাসাদে মিনারে তুমি যে পেতেছ হাত’ ইত্যাদি। ১৯৪৩-এর এই দুর্ভিক্ষে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শাসক ইংরেজ ও তাদের সহযোগী জোতদার-জমিদার-মহাজন-কালোবাজারীদের মুনাফাসন্ধানী শোষণক্রিয়ার চক্রান্তে লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবী মানুষ হাল-বলদ জমি-ভিটে হারিয়ে শহরের ফুটপাতে ভিক্ষুকে পরিণত হয়। কঙ্কালসার ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড় আছড়ে পড়ে কলকাতা শহরেও। অনাহারে ও রোগগ্রস্ত হয়ে মারা পড়ে বহু মানুষ। অতএব সুকান্তের কবিতায় দুর্ভিক্ষের ভয়ংকর দুর্গতির যে সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্রটুকু পাওয়া যায়, তা সম্পূর্ণভাবেই ইতিহাস-নির্ভর।

কিন্তু এই অসহায় দুর্গতিকে দুর্ভাগ্য হিসাবে শিরোধার্য করে নেওয়া সুকান্তের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন দৈব বা ভাগ্যকে যেমন স্বীকার করেনি, তেমনি জমিদার-জোতদার-মালিক শ্রেণির শোষণকে পরম আনুগত্যে বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করতেও পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক দর্শন শাসক-শোষক-মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণির নিরন্তর সংগ্রামে বিশ্বাসী। সেই সংগ্রাম গান্ধীবাদী কংগ্রেসের অহিংস সত্যাগ্রহও নয়। বরং শ্রমিক-মালিক, কৃষক-মহাজন, সর্বহারা মুনাফা লোভীর সেই সংগ্রাম আসলে সুনিয়ন্ত্রিত চেতনাদীপ্ত সংগ্রাম, যা অনিবার্যভাবে রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠতে পারে। কেননা মালিক বা জোতদার শ্রেণি সর্বহারার সঙ্গত অধিকারকে কখনওই সহজ শান্তিপূর্ণ আবেদনের ভিত্তিতে মেনে নেবে না। অতএব শ্রেণিসংঘর্ষ অনিবার্য-অবধারিত। কবি সুকান্ত কমিউনিস্ট দর্শনসঘাত এই জীবনদৃষ্টির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই বোধন কবিতায় দুর্ভাগ্য ও দুর্গতির কাছে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে মানবতার শত্রু এইসব মালিক-মজুতদার, সাম্রাজ্যবাদী মুনাফাবাজ শাসক ইংরেজ এবং তাদের অনুগ্রহপুষ্ট স্বার্থসর্বস্ব ও মনুষ্যত্বহীন শোষকদের বিরুদ্ধে জনচেতনাকে সংগ্রামী প্রেরণায় জাগ্রত করতে চেয়েছেন। যে মালিক-মজুতদাররা কোটি কোটি মানুষের মুখের গ্রাস লুণ্ঠন করে গোপন ভাণ্ডারে মুনাফার পাহাড় জমিয়েছে, ক্ষুধার অন্ন চুরি করে সারা বাংলায় নামিয়ে এনেছে মন্বন্তরের অন্ধকার, তাদের বিরুদ্ধে শুধু সংগ্রাম নয়, কবি সুকান্ত তাদের এযাবৎকালের ভয়ংকর অপরাধের জন্য চূড়ান্ত ক্ষমাহীন শাস্তি ঘোষণা করেছেন— “স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই” কিংবা “ফসল ফলানো মাটিতে রোপন করব তোকে এবার।”

দুর্গত, মৃত্যুপথযাত্রী, নৈরাশ্যগ্রস্ত লক্ষ-কোটি মানুষকে কবি এরপর ‘যুগসন্ধিকালের চেতনা’-য় উদ্বুদ্ধ করেছেন। এই সংগ্রামের জন্য ‘দুর্দমনীয় শক্তি’র উদ্বোধন চেয়েছেন কবি–“প্রাণে আর মনে দাও শীতের শেষের তুষার গলানো উত্তাপ।”

কিন্তু এখানেও কবিতাটি সমাপ্ত নয়। কবি এরপর সংগ্রামী আদর্শে সংশয়ীদের বিরুদ্ধে ধিক্কার উচ্চারণ করেছেন। কবির জীবনাদর্শ অনুযায়ী এই দুর্গতিমোচনের জন্য চূড়ান্ত শ্রেণি-সংগ্রাম ছাড়া বিকল্প নেই। যারা সমস্ত দেশ ও দেশের মানুষকে তিলে তিলে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে যারা দ্বিধাগ্রস্ত, তাদেরও কবি সুকান্ত দেশদ্রোহী ও মানবতাবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কবি ঘোষণা করেছেন ধূর্ত প্রবঞ্জক মালিক-মজুতদারদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা যদি এত দুর্গতি-ভোগের পরেও মনকে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ না করে, তাহলে বুঝতে হবে, সেই সব দ্বিধাগ্রস্ত সংশয়ী মানুষেরা আসলে গোপনে দেশদ্রোহী দুষ্টচক্রেরই সহায়কশক্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল—

“তা যদি না হয়, বুঝব তুমি তো মানুষ নও, 

গোপনে গোপনে দেশদ্রোহীর পতাকা বও।”

এই দেশদ্রোহী, মানবতার শত্রুদেরও মালিক-মজুতদার এবং শাসক-শোষকদের সঙ্গেই কবি ভারতবাসী হিসাবে অস্বীকার করতে চান। এইসব মানবতার ও ভারতবর্ষের শত্রুদের সংশয়ী আচরণে কবির মনে হয়েছে, যেন ভারতবর্ষের মাটি তাদের অন্নজলে কোনোদিন পুষ্ট করেনি। অতএব ভারতবর্ষে তাদের বাস করার কোনো অধিকারই নেই–

“ভারতবর্ষ মাটি দেয়নিকো, দেয়নি জল,

দেয়নি তোমার মুখেতে অন্ন, বাহুতে বল,

পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত রক্তে, তাই

ভারতবর্ষে আজকে তোমার নেইকো ঠাই।”

সমগ্র ‘বোধন’ কবিতায় তাই সুকান্ত ভট্টাচার্যের বামপন্থী (কমিউনিস্ট) রাজনৈতিক দর্শনসঞ্জাত শ্রেণি সংগ্রামের জীবনভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছে।