শুধু কবিতা নয়, যে-কোনো সাহিত্য রচনারই বিষয় বা ভাববস্তুর প্রতিফলন যখন তার শিরোনামে প্রতিফলিত হয়, তখনই আমরা মনে করি, সেই নামকরণ সঙ্গতিপূর্ণ বা সার্থক হয়ে উঠেছে। সেই নামকরণ বা শিরোনাম সাহিত্যবস্তুর চরিত্র নামেই হোক, কোনো ঘটনাকেন্দ্রিকই হোক বা ব্যঞ্জনাধর্মীই হোক, নামকরণের সার্থকতার প্রাথমিক শর্তই হল সাহিত্যকার তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যে মর্মবাণীটি পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে চান, তাকে উদ্ভাসিত করে তোলা বা সেই বার্তাটিকে সংকেতিত করে তোলা। সেদিক থেকে ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটির বক্তব্যটিকে অনুধাবন করলে আমরা এর নামকরণের যাথার্থ্যটিকে কিছুটা বিচার করতে পারবো।

জয় গোস্বামীর ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ কবিতাটি প্রকৃতপক্ষে একটি আখ্যানধর্মী কবিতা। আত্মকথনের ভঙ্গিতে বিন্যস্ত কবিতাটির মধ্যে প্রায় একটি নিটোল ছোটোগল্পের আভাস পাওয়া যায়। কবিতাটির এই ছোটোগল্পোপম আখ্যানের কেন্দ্রে আছে একটি প্রেমবঞ্চিতা নারী। কিশোরকালের প্রণয়ের স্মৃতি ও পরিণত বয়সের বঞ্চনার গ্লানি নিয়ে তার প্রাত্যহিক দিনযাপন। কবিতাটিতে তার কোনো নামের উল্লেখ নেই। আত্মকথনের ভঙ্গিতে লেখা বলেই হয়তো নিজের নাম, নিজের মুখে বলেনি মেয়েটি। শুধু তার সেই পূর্ব প্রণয়ীর উদ্দেশে উচ্চারণের ভঙ্গিতে এ কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে তার স্বগতোক্তি।

স্বভাবতই মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটির কথা। সেখানে সাধারণ মেয়েটি শরৎবাবুর কাছে আত্মকথনের সূত্রে নিজের নাম জানিয়েছিল মালতী। অবশ্যই সেটি তার আসল নাম নয়। বাংলাদেশের এক সাধারণ মেয়ের নাম হিসাবে ওই সাধারণ নামটিকেই তার নাম হিসাবে ধরে নিতে বলেছিল সে। তারও জীবনে এসেছিল প্রেমের বঞ্চনা। নরেশ নামের ছেলেটি অনেক কৃত্রিম কথার মালা গেঁথে প্রেম নিবেদন করেছিল একদিন মালতী নামের সাধারণ মেয়েটিকে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে নরেশ যেন উপলব্ধি করেছিল মালতী তার মেধা ও প্রতিভার উপযুক্ত নয়। বিদেশে উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত সহপাঠিনীদের সঙ্গলাভে ধন্য হয়ে সে মালতীকে আকারে ইঙ্গিতে পত্র মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিল যে, মালতী সাধারণ মেয়ে। বঞ্চনার ইতিবৃত্ত এখানেই শেষ। এরপর রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন মালতীর বঞ্চিত হৃদয়ের প্রতিক্রিয়া। সাধারণত্বের বাস্তবতাকে মালতী কোনোদিনই অতিক্রম করতে পারবে না। তাই সে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিল তাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার জন্য। সেই গল্পের মালতী যেন সাফল্যের সঙ্গে এম. এ. পাশ করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যায়। সেখানে বিদেশের জ্ঞানী-গুণীরা যেন আবিষ্কার করেন মালতীর অসামান্যতা। নরেশ সাধারণ বাঙালি নারীর মধ্যে যে অসাধারণত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি, সেই অসাধারণত্বের আবিষ্কার করবে নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ চোখ—এই ছিল মালতীর বাসনা। এই অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার মধ্য দিয়ে পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল মালতী নামক প্রেমবঞ্চিতা মেয়েটির অন্তরে লুকোনো ক্ষোভ ও বঞ্চনার তীব্র জ্বালা। সেইসঙ্গে নরেশের বঞ্চনার প্রতি একটা নিষ্ফল প্রতিশোধ বাসনাকেও প্রকাশিত হতে দেখি।

কিন্তু জয় গোস্বামীর কবিতার সমাপ্তি কিছুটা পৃথক। অল্প বয়সের জাদু’ তার কবিতার মেয়েটিরও মন ছুঁয়েছিল। শহর থেকে বেড়াতে আসা উজ্জ্বল ও মেধাবী বেণীমাধরের প্রতি বয়ঃসন্ধিকালের মন তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিল। যদিও সেই নবম শ্রেণিতে পড়া ষোলো বছরের মেয়েটির মধ্যে এক সামাজিক বাস্তবতার বোধও লক্ষ করি আমরা। বেণীমাধব ‘লেখাপড়ায় ভালো এবং পাশাপাশি ‘আমার রং কালো’—এই বিচারের মধ্য দিয়েই এই ভালোবাসার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছিল মেয়েটির স্বগতোক্তিতে। তার সঙ্গে ছিল আর্থিক দূরত্বের একটা বোধও—“বেণীমাধব, আমার বাবা দোকানে কাজ করে।”

কিন্তু অল্প বয়সের জাদু সব অসঙ্গতি ভুলে যেতে চায়। অতিক্রম করতে চায় অলঙ্ঘনীয় সব প্রতিকূলতাকে। তাই মেধাগত ও সামাজিক অবস্থানগত হীনমন্যতা সত্ত্বেও মেয়েটির মনে প্রেমের অলি গুঞ্জরণ করে। ভালোবাসে সে বেণীমাধবকে।

এরপরেই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আমরা আবিষ্কার করি বঞ্চিতা মেয়েটিকে। বেণীমাধব আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তার যথাযোগ্য সঙ্গিনীর সন্ধান পেয়ে যায়। কালো মেয়েটি বেণীমাধবের জীবন থেকে অনেক দূরে সরে আসে। পাড়ার সেলাই দিদিমণি হিসাবে সে এখন কোনোক্রমে প্রাত্যহিক অন্ন সংস্থান করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে তার বোনটি ‘চোরাপথের বাঁকে হারিয়ে যায়। একটি দারিদ্র্য লাঞ্ছিত সাধারণ দিনযাপনের গ্লানি ও বঞ্চনার ব্যথা নিয়ে দিন কাটে মেয়েটির সাধারণ মেয়ে মালতীর মতো বঞ্চনার আগুন হয়তো তার মধ্যেও জ্বলে উঠতে চায়। কিন্তু এক ঘনীভূত অবসাদ তাকে গ্রাস করে, মনের আগুন জ্বলে ওঠে না। কেবল নিজেকে নষ্ট ভ্রষ্ট করে দিয়ে সে বেণীমাধবের উপর একটা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। কিন্তু উপাত্ত পঙক্তিটি প্রমাণ করে, প্রাত্যহিকতার চাপে সেই বিধ্বংসী বাসনাও সাধারণ মেয়েটি সাধন করতে পারবে না কোনোদিন।

কিন্তু এই ক্ষোভ বা বঞ্চনার জ্বালা এ কবিতায় প্রধান হয়ে ওঠেনি ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতার মতো। রবীন্দ্রনাথের মালতীর মন থেকে প্রেম বাসনা সম্পূর্ণ তিরোহিত বঞ্চনার তাপে। কিন্তু জয় গোস্বামীর কবিতায় বঞ্চিতা মেয়েটির মনে এখনও প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন তীব্রভাবে লগ্ন হয়ে আছে। তার প্রমাণ কবিতার প্রারম্ভিক পঙক্তিটি—”বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাবো।”

প্রশ্ন উঠতে পারে, কবিতার এই মর্মবস্তুটি, এই অনামা মেয়েটির প্রেমবঞ্চিত জীবনের অশ্রুময় ইতিবৃত্তটির সঙ্গে কবিতাটির শিরোনাম কি সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে? কবিতার নামকরণ কি আদৌ আভাসিত করতে পারে কবিতার আখ্যানমমটিকে? উত্তর, আপাতভাবে একেবারেই না। কেননা, মেয়েটির জীবন ইতিহাসের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে যুক্ত নয় মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়টি। তার বয়ঃসন্ধিকালে যখন সে নবম শ্রেণিতে পড়া সদ্য শাড়ি-পরা ষোলো বছরের কিশোরী, তখন তার প্রেমাকাঙ্ক্ষা ও বেণীমাধবের সঙ্গে পরিচয়ের সূচনা—এইটুকু মাত্র মেয়েটির জীবনের সঙ্গে মালতীবালা স্কুলটির যোগ। কবিতার পরিণামী অধ্যায়ের সঙ্গে আর সেই বিদ্যালয়ের ন্যূনতম যোগটিও নেই।

তাহলে কবিতার এই নামকরণের সার্থকতা কোথায়? আসলে কবিদের দৃষ্টি অনেক সময়েই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্থূল বিষয়কে ভেদ করে চলে যায় বিষয়ের গভীরে। স্কুলের ভিতরেই কবি আবিষ্কার করতে পারেন সুক্ষ্মতর কোনো ব্যঞ্জনা। অথবা আপাত ব্যর্থ বা স্থূল শব্দের আড়ালে কবি নিহিত রাখতে পারেন পাঠকের পূর্ব অভিজ্ঞতাকে উসকে দেবার কোনো চাবিকাঠি। আলোচ্য কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচারের ক্ষেত্রে আমাদের সেইসব দিকগুলোতে অভিনিবেশ দেওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত, জয় তার কবিতায় সাধারণ মেয়েটির কোনো নাম জানাননি আমাদের। কিন্তু তার জীবনের ইতিহাস বাংলাদেশের সাধারণ কালো মেয়েদের বঞ্চিত হবারই ইতিহাস। ফলে এই কবিতাটি পড়তে গেলে স্বভাবতই মনে পড়ে যায় সাধারণ মেয়ে’ কবিতাটির কথা। কবি কি কৌশলে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে কবিতার মালতীর কথাই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন নামকরণের মধ্য দিয়ে। মালতী বলেছিল— “এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,/তারা সবাই সামান্য মেয়ে,/তারা ফরাসি জর্মান জানে না,/কাঁদতে জানে।” মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের মধ্যে সেই অনেক মালতীকেই কি খুঁজতে বা দেখতে চেয়েছেন কবি জয় গোস্বামী? তাই পৃথক করে আর মেয়েটির নাম জানাবার প্রয়োজন হয়নি তাঁর? সেদিক থেকে ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ শিরোনামটি পাঠককে আভাস দেয়, এই কবিতাও আসলে তেমনি এক প্রেমবঞ্চিতা সাধারণ মেয়ের কথা, যার নাম ছিল মালতী।

দ্বিতীয়ত, জয় গোস্বামীর কবিধর্ম সমাজ-বাস্তবতাকে স্বীকার করেও কখনও জীবনের স্বপ্নকে হারান না। এ কবিতাতে তাই বেণীমাধব বঞ্চনা করলেও বঞ্চিতা মেয়েটি কোনো স্পষ্ট অভিযোগ করে না তার প্রতি। বরং মনে হয়, বাস্তবের বেণীমাধব অনেক দূরে সরে গেলেও মেয়েটির হৃদয়ের গভীরে বেণীমাধব হয়ে ওঠে। এক বিমূর্ত প্রেমস্বপ্নের প্রতীক। বাস্তব বড়ো নির্মম। পাড়ার সেলাই দিদিমণি হয়ে প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানি অসহনীয়। তবু তারই মধ্যে মেয়েটির বেঁচে থাকার সম্বল সেই বয়ঃসন্ধিকালের নিষ্পাপ, রোমাঞ্চকর, বাধাবন্ধনহীন স্বপ্নের দিনগুলি। যে দিনগুলি নির্মম বাস্তবের চোরাবালির উপরেও স্বপ্নের জীবন রচনা করতে পারত, জীবনে সেই দিনগুলির উজ্জ্বল মূল্যই হয়তো কবি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ নামকরণে। কেননা, তার প্রেমের স্বপ্ন ও প্রেমের জন্ম সেই বিদ্যালয়ের জীবনেই। সেই মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়ের দিনগুলিই তার মতো সাধারণ মেয়ের জীবনে অক্ষয় পাথেয় হয়ে থাকে স্মৃতিরূপে। তাই কবিতার নামকরণটি পরোক্ষে এক অন্যতর ব্যঞ্জনা সঞ্চারিত করে দিতে পারে পাঠকের মনে। এদিক থেকে দেখলে নামকরণটি সার্থকতার চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করতে পারে।