মহাদেবী বর্মার কবিতা সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতাও নয়, নির্ভেজাল রোম্যান্টিসিজমও নয়, যথার্থ বিচারে তাঁর কবিতায় ঝংকৃত হয়েছে ধ্বস্তু সময়েরই যন্ত্রণা – “নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব? কবিতা অনুসরণে আলোচনা করো।

হিন্দি কাব্যক্ষেত্রে ছায়াবাদ পর্বের উল্লেখযোগ্য চারজন কবিজ্যোতিষ্ক— জয়শঙ্কর প্রসাদ, সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা, সুমিত্রানন্দন পত্ত এবং মহাদেবী বর্মা। এদের মধ্যে মহাদেবী বর্মার কাব্যেই সর্বাধিক প্রকাশিত হয়েছে ছায়াবাদী রোম্যান্টিক বিরহচেতনা। হিন্দি সাহিত্যের ছায়াবাদ যুগ বহুলাংশে রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিক চেতনার দ্বারা প্রভাবিত ও উজ্জীবিত। এই রবীন্দ্রপ্রভাব আবার সর্বাধিক নিরালা ও মহাদেবীর কাব্যে। কিন্তু মহাদেবী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচেতনা ও কাব্যভাবনায় যেভাবে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ, ভক্তিতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব ও জীবনদেবতার কাছে আত্মসমর্পণকে গ্রহণ করেছেন, সেটি অন্যত্র সুলভ নয়।

মহাদেবীর কাব্যের প্রধান সুর বেদনার। বিরহসাধনার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রার্থিতকে লাভ করার অভিসারিকা মহাদেবী বর্মা। তাই কোনো কোনো কাব্যআলোচক মহাদেবীকে মীরাবাঈ-এর সঙ্গে তুলনা করেন। শ্রীইন্দ্ৰনাথ মদান মহাদেবী সম্পর্কে মূল্যায়ন করে লিখেছেন – “ভক্তিকালে যে স্থান মীরার প্রাপ্য ছিল, ছায়াবাদ যুগে তা মহাদেবীর প্রাপনীয় বলে লোকে তাঁকে ‘আধুনিক যুগের মীরা ও বলে থাকে। যেখানে দুঃখ যন্ত্রণা ও বেদনা-পীড়ার সম্বন্ধ, ততদূর পর্যন্ত মীরা ও মহাদেবীর বিশেষ পার্থক্য নেই।” অর্থাৎ এদিক থেকে মহাদেবীর কবিতায় পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা কিংবা নির্ভেজাল রোম্যান্টিকতা আবিষ্কার করেছেন বহু আলোচক।

কিন্তু এই ভক্তিবাদের নিরিখে মহাদেবীকে বিশ্লেষণ করলে তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যকে যথাযথ অনুধাবন করা যাবে না। কেননা আপাতভাবে বিরহসাধনার মধ্য দিয়ে প্রিয়তমকে লাভ করার কথা তাঁর কাব্যে বারবার উচ্চারিত হলেও আসলে এই ভক্তিবাদ মহাদেবীর ব্যবহৃত রূপকমাত্র। আসলে বিংশ শতাব্দীর সামাজিক রাজনৈতিক দুর্বিনীত সময়ে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধের দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ পটভূমিতে মহাদেবী খুঁজে পেতে চেয়েছেন মানবিক করুণার আলোকমালা। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের পাশবিক বোমার আগুনে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে অঙ্গার, ধোঁয়া আর ভস্মরাশি, তখন সেই অঙ্গারপথে মানবতার এক টুকরো শাস্ত শ্যামল ভূমির জন্য মহাদেবীর পদযাত্রা। ফলে তাঁর কবিতায় বারবার প্রকাশিত হয়েছে বেদনার সুর। প্রার্থিতকে পাবার জন্য তাঁর কবিতায় তাই ধ্বনিত হয়েছে বিরহের আর্তি।

এই নিরন্তর মানবিক করুণার সন্ধান ও প্রতিকূল সময়ের বন্ধুর পথের অসামঞ্জস্যই মহাদেবীর মানসলোকে জন্ম দিয়েছে বৈষ্ণবীয় বিরহসাধনার দর্শনটিকে। আলোচ্য কবিতায় সেই প্রতিকূল পথের অভিসারযাত্রাকেই সাগ্রহে বরণ করে নেবার বার্তা উচ্চারিত। ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটি মহাদেবী বর্মার ‘দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ৫ সংখ্যক কবিতা। মনে রাখতে হবে যে, দীপশিখা’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুংকার, সমস্ত দেশ জুড়ে মন্বন্তরের হাতছানি, প্রকট অর্থনৈতিক মন্দা, সেইসঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক হানাহানি এক ঘোর দুর্বিপাককে যেন বহন করে নিয়ে এসেছে সেই সময়কালে। এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কালে দাঁড়িয়ে কবি মহাদেবী বর্মা এক অচঞ্চল প্রত্যয়ে মানুষের কল্যাণ ও জয়গাথা গেয়েছেন এই কবিতায়।

কবি বলেছেন, চতুর্দিকে নিভে যাওয়া আশার প্রদীপগুলিকে তিনি জ্বালিয়ে তুলবেন। যে অন্ধকার আজ ঘিরে নেমেছে চারপাশে, তারই মাঝখানে তিনি জাগিয়ে তুলবেন দীপক রাগিনীর উদ্দীপনমন্ত্র। পৃথিবীর অন্ধকার কারাগার ভেঙে আজ উন্মত্ত হয়ে ধেয়ে এসেছে ধূলিঝড়। মহাদেবী বিশ্বাস করেন, সেই লাস্যময় তড়িৎকে আর ঢেকে রাখতে পারবে না কালো মেঘের ঘনঘটা। ধুলিঝঞ্ঝার বীণায় কবি তারের মতো বেঁধে দিতে চান মর্ত্যপৃথিবীর প্রতিটি তৃণগুচ্ছ।

এই বিক্ষুব্ধ সময়ে নক্ষত্ররাও যেন ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে, বিভ্রান্ত বাতাস আর পথ খুঁজে পাচ্ছে না, আকাশের কোলে অশুভ উল্কা ছড়িয়ে দিয়ে ধ্বংস যেন নেমে আসছে মত্ত হয়ে। সেই ধ্বংসের মধ্যেই কবি তাঁর মমতাময় আঙুলের আড়ালে বাঁচিয়ে রাখবেন জীবনের সুকুমার স্বপ্নগুলিকে। আজ প্রদীপের মৃদু শিখা দিয়েই কবি বেঁধে রাখতে চান দুর্যোগকালের ছন্দলয়। তিনি প্রতিটি স্বরকে সাজিয়ে তুলতে চান দীপাবলীর আলোকমালার মতো।

মানবের অশ্রুধারায় কোমল ব্যথাকে প্রত্যক্ষ করে কবি এই সময়ের আগুনপথে বিছিয়ে দিতে চান মোমের মতো গলে পড়া বেদনার গান। এই বেদনাকে ধ্বংস আর ভস্মের গাথাকে মহাদেবী নঞর্থক দৃষ্টিতে দেখতে চাননি, তিনি এই দুর্যোগকালের দীপকরাগে নিহিত থাকতে দেখেছেন স্বর্ণময় ঐশ্বর্য।

এমন দুর্যোগের কালে কবি তাঁর জীবনদেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন যে, তিনি যেন তরী বেয়ে এসে তাঁকে তীরে দেখেও পরিত্যাগ করে ফেলে না যান। তিনি যেন তাঁর প্রবল হুংকারে কবিকে তাঁর ঝঞ্ঝার দোলায় দোলায়িত তরীতে ডেকে নেন। কবি এই জোয়ারের তুমুল খরস্রোতেই তরণী ভাসাতে চান, এবং গেয়ে উঠতে চান এই ভীষণলগ্নের উপযুক্ত দীপক রাগিনী।

লক্ষণীয়, মহাদেবীর এই কবিতায় স্পষ্টভাবে উপস্থিত রবীন্দ্রকবিতার ছায়া। একদিকে সোনার তরী কবিতার ভাবানুষঙ্গ যেমন প্রতিফলিত হয়েছে তরীর নেয়ের কাছে কবির আবেদনের মধ্যে, তেমনি দুর্যোগের পথে ভয়হীন অভিসারের যে বাণী উচ্চারিত মহাদেবীর কবিতায়, তার মধ্যে পাঠক খুঁজে পেতে পারেন ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থের সুর। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে প্রায় অনুসরণ করেই মহাদেবী এই ক্রান্তিকালে প্রতিকূল যুগপরিবেশের বন্ধুর পথেই দীপক রাগিণীর ভয়হীন সুরে গেয়েছেন দুঃসহ সময় অতিক্রমণের চরৈবেতি মন্ত্র।