যাদবের মৃত্যুদৃশ্য এই উপন্যাসে একটি কৌতূহলোদ্দীপক ও তাৎপর্যময় দৃশ্য। কথা প্রসঙ্গে যাদব অবিশ্বাসী শশীকে তাঁর দেহত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সূর্যবিজ্ঞানের মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে যাদব শশীকে বলেন অতীত ভবিষ্যৎ সূর্যবিজ্ঞানবিদের নখদর্পণে, মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত জানা যায়। শশীর কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর ফুটে উঠেছে দেখে যাদব হঠাৎ বলে ফেলেন যে তিনি রথের দিন দেহত্যাগ করবেন। খবরটা চারদিকে জানাজানি হওয়ার ফলে গ্রামে-গ্রামে শোরগোল উঠল। পাগলদিদি শশীকে অভিযোগ করল এই বলে যে সে চারিদিকে খবরটা ছড়িয়ে দিয়ে তার সর্বনাশই করেছে। এখন সূর্যবিজ্ঞানীর কাছে কথা রাখার দায়বদ্ধতাই মুখ্য কথা। রথের দিন যাদব মরতে চান। সকলে সাগ্রহে রথের দিনটির জন্য প্রতীক্ষা করে আছে। দশ-বার ক্রোশ দূর থেকে অনেক গৃহস্থ আসত এই দেবতার অলৌকিক কাণ্ড দেখতে। শশী ম্লেচ্ছ নাস্তিক, যাদবের অলৌকিক শক্তিতে তার অবিশ্বাসই ছিল, তবু সে ব্যাপারটা দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছে।
নির্দিষ্ট দিনের আগে থেকেই লোকে এসে গাছতলায় বাসা বেঁধেছে। অনেকের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কায়েত পাড়ার পথে নেমে মনে হল এ যেন তীর্থ। প্রাত্যহিক জীবনের হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতার সঞ্চিত গ্লানি পেছনে ফেলে রেখে এসে উৎসুক একাগ্রতায় তারা এই অলৌকিক দৃশ্য দেখতে এসেছে।
রথের দু’দিন আগে বৃষ্টি হয়েছিল। সেদিনও সকালের দিকে কখনো কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে লাগল। কখনও মেঘলা হয়ে গেল। আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই সংকীর্তন আরম্ভ হয়েছিল। সকাল থেকে আরও দল এসে কীর্তন জেঁকে বসেছে। যাদব স্নান সেরে পট্টবস্ত্র পরিধান করেছেন, সকলে ফুলের মালায় তাকে সাজিয়েছে। পাগলদিদির গলাতেও অনেকে ফুলের মালা পরিয়েছে। সধবারা তেল-সিঁদুর দেওয়া বন্ধ করেছে। কারণ আজ ত’ পাগলদিদির বৈধব্যযোগ। তাঁকে আর তেল-সিঁদুর দেওয়া যায় না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাদবের বাড়ির সামনে আর কায়েত পাড়ার পথে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। গাওদিয়া, সাতগাঁ, আর উত্থার গ্রামের একদল ছেলে ভলান্টিয়ার হয়ে কাজ করেছে। এরা খুব উৎসাহী। বাঁশ বেঁধে দর্শনার্থী মেয়ে-পুরুষ সব পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। ভাঙা দাওয়ায় যাদবের বসবার স্থান। অঙ্গনে কয়েকটা চৌকি ফেলে গ্রামের মাতব্বরেরা উপবিষ্ট। তাঁরা হুঁকো টানছেন, তাঁদের আলাপের ভঙ্গি দেখে মনে হয় উৎসবের বাড়ি শুরু হয়েছে। শীতলবাবু, বিমলবাবুর মতো গ্রামের মাথা সকালে একবার ঘুরে গেছেন, দুপুরে আবার আসবেন। বাবুদের বাড়ির মেয়েরা এলেন অপরাহ্ণে। তখন যাদব ও পাগলদিদি অচেতন অবস্থায়।
শশী দুজনকে লক্ষ্য করছিল। বেলা এগারটার পর থেকে দু’জনেই ধীরে ধীরে নিস্তেজ ও নিদ্রাতুর হয়ে আসছেন দেখে মনে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে শশীর দিকে ঢুলুঢুলু দৃষ্টিতে তাকিয়ে যাদব এক রহস্যময় হাসি হেসেছিলেন। পাগলদিদি তখন চোখ বুজেছেন। যাদবের মুখ ঢেকে গেছে চটচটে ঘামে। আর কালিমায় চোখের তারা ছোট হয়ে গিয়েছিল। তিন-চার হাজার ব্যগ্র উত্তেজিত লোকের মধ্যে শশী ডাক্তার একা। সে শিহরিত হয়ে উঠেছিল। তবু পলক ফেলতে পারেনি। যাদব ও পাগলদিদির দেহে মৃত্যুর পরিচিত লক্ষণগুলি একে একে ফুটে উঠেছিল।
সকলে যখন দেখল যাদবের সঙ্গে পাগলদিদি পরলোকে চলেছেন তখন চারিদিকে হৈ-চৈ পড়ে গেল। ছেলে-বুড়ো, স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। ভলান্টিয়ারদের চেষ্টায় সকলের দর্শন ও প্রণাম শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবেই চলছিল। এখন সকলকে আর সংযত করা গেল না। পাগলদিদির পা দুটো সিঁদুরে ঢেকে গেল। যাদব আর পাগলদিদি ভিড়ে যেন পিষে যান।
তারপর জনতা ঠেকাবার ব্যবস্থা হিসেবে দুজনের শয্যা রচনা করে পাশাপাশি দু’জনকে শোয়ানো হল। কায়েতপাড়ার সংকীর্ণ পথে রোজকার রথ বেরোয়নি। শীতলবাবুর হুকুমে বেলা প্রায় তিনটের সময় বাবুদের রথটা অনেক চেষ্টায় যাদবের ঘরের সম্মুখে টেনে আনা হল। পাগলদিদিকে চোখ খোলানো গেল না। যাদব অনেক কষ্টে চোখ খুললেন। চোখের তারা দুটি এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে।
এবার যাদবের আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। সকলে বলল এটা সমাধি। পাগলদিদি ঘণ্টাখানেক পরে মারা গেলেন। ঠিক সময়টা কেউ ধরতে পারল না। এক সধবা ব্রাহ্মণী গঙ্গাজলে মুখের ফেনা ধুইয়ে দিলেন। যাদবের শেষ নিঃশ্বাস পড়ল গোধূলিবেলায়। শশী অবাক হয়ে সব দেখছিল। শশীর স্পর্শ করার অধিকার নেই। দূর থেকে সে ব্যাকুলভাবে বলল—“ওর মুখে কেউ গঙ্গা জল দিন।”
সত্যমিথ্যায় মেশানো জগৎ। মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করে দিতে পারে মিথ্যার মোহ। মিথ্যা প্রকাশের জোরে চিরকালের জন্য সত্য হয়ে উঠতে পারে। তিন-চার হাজার উৎসুক দর্শক উত্তেজিত অবস্থায় এই দৃশ্য দেখতে জড়ো হয়ে আছে। শশী এসব দেখে শিউরে উঠেছে। তবু নিষ্পলক দৃষ্টিতে শশী এসব দৃশ্য দেখছিল।
এই দৃশ্য অপার্থিব দৃশ্য। চিরদিনের জন্য এই ঘটনা মানুষের মনে গাঁথা থাকবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবন রহস্য সন্ধানের স্রষ্টা। শশী বিজ্ঞানমনস্ক চিকিৎসা যুক্তি দিয়ে সব কিছুকে দেখে বিচার করে। কিন্তু যুক্তির বাইরে যে কত ঘটনা আছে, তা প্রণিধান করার জন্য শশী এই দৃশ্য দেখতে এসেছে। জীবন যখন নীরস হয়ে যাবে, তখন এ আশা করার সাহস থাকবে যে দুঃখ-ক্লান্তি এসব তুচ্ছ, মরণকে মানুষ মনের জোরে জয় করতে পারে। যাদব বৃহতের জন্য ব্যাকুলতা জাগিয়ে রেখেছিল। এই রহস্য ভেবে শশী অভিভূত হয়ে পড়ে। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসে লেখক জীবনরহস্য চিত্র নানাভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যাদবের মৃত্যুদৃশ্য এমনই এক রহস্যচিত্র যা জ্ঞানবুদ্ধির অতীত এক সত্য।
Leave a comment