কুমুদ-মতি আখ্যান ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের এক নাটকীয় চমৎকারিত্বে পূর্ণ কাহিনীবৃত্ত। মতি এই উপন্যাসের এক আশ্চর্য চরিত্র। কুমুদের জীবন ও চরিত্র আরও আশ্চর্যের। বালিকা বয়স থেকেই মতি স্বপ্ন দেখে। সে যে কোনো গড়পরতা বাঙালী মেয়ের মতো স্বপ্ন দেখে। বধূ হয়ে সুগৃহিণীর মতো সংসারধর্ম সম্পন্ন করার স্বপ্ন। “স্বপ্ন মতির অফুরন্ত। মস্ত একটি ঘরের এককোণে সে বসিয়া আছে। সর্বাঙ্গে তাহার ঝলমলে গহনা, পরনে ঝকমকে শাড়ি, ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মতির মুখখানি কি রাঙা লজ্জায়।” এই স্বপ্নমূর্তি মতির কামনার সঙ্গে লিপ্ত হয়ে থাকে। ছেলেবেলা থেকে শশীকে মতি পূজা করে, শ্রদ্ধা করে। “বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।” এই বীরপূজা থেকেই হঠাৎ একদিন কুমুদের দেখা পায়।

বিনোদিনী অপেরা পার্টির তরফ থেকে কুমুদ গাওদিয়া গ্রামের পূজার উৎসবে আসে। সেখানে সে প্রবীরের ভূমিকায় অভিনয় করে মতিকে মুগ্ধ করে। মতির স্বপ্নের রাজপুত্র প্রবীররূপে আসে। তালপুকুরের ধারে গড়ে ওঠা কুমুদ ও মতির প্রণয় শেষ পর্যন্ত বিবাহে পর্যবসিত হয়। শশী তাকে খেয়ালের বশে “একটা মুখ্যু গেঁয়ো মেয়ে”-কে বিবাহ করতে নিষেধ করে। কুমুদও স্বপ্ন দেখত। কুমুদ চরিত্রে স্বপ্ন সফল করার প্রেরণা আছে, তপস্যা নেই। মতি ছিল সংসার-অনভিজ্ঞ। সংসারের নিয়মকানুন সে জানত না। মতি সরলপ্রাণ ও হীনমন্যতাবোধে আক্রান্ত মেয়ে। এই মতি কুমুদকে বিয়ে করে অজানা জীবনকে গ্রহণ করল। বিয়ের পর মতি হনিমুনে চলে যায়। “গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি, তাকে লইয়া কুমুদ চলিল হনিমুনে।” গাওদিয়ার জীবন থেকে সে নিরুদ্দেশ জীবনে গিয়ে উপস্থিত হয় কুমুদ মতিকে নিয়ে কলকাতার এক হোটেলে ওঠে। কলকাতার সিনেমা ও গঙ্গাতীরে কুমুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে মতি বিস্মিত হয়। কুমুদের খামখেয়ালী স্বভাব। আলস্যপ্রিয়তা সব দেখে মতি অবাক হয়ে যায়। প্রথম প্রথম সে নিজের সৌভাগ্যে পুলকিত হয়ে ওঠে। “গাঁয়ের কোন মেয়ে তার মতো এমন ভাগ্যবতী।” “তার নিজের পছন্দ করা বর, বিবাহের পর এমন স্ফূর্তি করিয়া বেড়ানো, বিষয়ে স্বাধীনতা। হোটেলের জীবনযাত্রা দেখে মতি অবাক হয়ে যায়।” হোটেলে খাবার সময় বেশি বেশি ভাত দেয়, ভাত যে লক্ষ্মী, সেই ভাত নষ্ট হবে ভেবে, মতির মনে কষ্ট হয়। খাওয়া-দাওয়ার পর সিগারেট টানতে টানতে কুমুদ ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত অবস্থায় সিগারেটটা হাত থেকে খসে পড়লে মতি তা তুলে রাখে। চৌকিতে কুমুদ গা এলিয়ে দেয়। মতির পাশে শোয়ার জায়গা থাকে না। নিয়ম বজায় রাখতে না পেরে বিষণ্ণ মনে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। তিনটের সময় ঘুম ভেঙে কুমুদ মুখহাত ধুয়ে জামা কাপড় পরে বাইরে বেরোয়। মতি দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে পড়ে। মিনিট পনেরো পর দরজায় ঘা পড়তে খিল খুলে সে দেখে কুমুদ নয়, কুড়ি-বাইশ বছরের চশমা-পরা একটা ছেলে এসে হাজির। মতিকে দেখে সেও অবাক হয়ে যায়। এঘরে তার বন্ধু ছিল, “ঘর ছেড়ে চলে গেছে জানতাম না,” মতি ছেলেটার তাকানোর ভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে যায়। মতি ভয় পায়। এমন সময় ম্যানেজার এসে পড়ে। মতি তখন দরজাটা বন্ধ করে দেয়। মতি বোঝে আশেপাশের ঘর থেকে লোকজন চলে আসে। গণ্ডগোল হয়। রুদ্ধ ঘরে বসে মতি লজ্জায় কাঠ হয়ে গেল। মতির মনে নানা প্রশ্ন এল। – “এ কেমন জায়গায় কুমুদ তাহাকে একা ফেলিয়া রাখিয়া গেল।” গৃহকোণে বসে মুখোমুখি কপোতকপোতীর মতো দিন কাটাবে, কিন্তু কুমুদের আলস্যপ্রিয়তায় মতির স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেল। শুয়ে বসে হাই তুলে কাটায় কুমুদ। আলস্যের মধুর আরামে টিন-টিন সিগারেট খায়, ঝাঁ করে মতিকে আদর করে জানালা দিয়ে পুরো দশ মিনিট বাইরে চেয়ে থাকে, অন্যমনে শিষ দেয়, তারপর মতিকে চা করতে বলে। কলকাতা প্রসঙ্গে কুমুদের উৎসাহ কমে যায়, কলকাতাত একটা বাজার, তার চেয়ে পুরী-ওয়ালটেয়ার ঘুরে আসা ভাল। কিন্তু সেটাই বা কবে হবে তার কোনো হদিস পায় না মতি। ‘আবেগ-মূর্ছনার একটা সম্পূর্ণতা মতির কখনো পাইবার উপায় নাই। ……তবে ছোট বড়ো সেবার সুযোগ মতিকে কুমুদ অফুরন্ত দিয়াছে।” এই অবস্থায় ক্লান্ত হয়ে যায় মতি, নিজেকে বন্দিনী মনে করে। মতি ভাবে তার খেলার সাথী কেহ থাকিবে না, মাঠ ও আকাশ আর জীবনে পড়িবে না চোখে। বালিমাটির নরম গেঁয়ো পথে আর সে পারিবে না হাঁটিতে। মোটে সাত দিনে মতির মনে হতাশা নেমে আসে। মতির বন্ধুদের প্রশ্নের রীতি দেখে গাঁয়ের মেয়ে মতি বোঝে এরা লোক ভাল নয়। অনেকে মতির সঙ্গে আলাপী হতে চায়। কেউ কেউ অকারণে পরিচয় গড়তে চেষ্টা করে। এইসব বন্ধুদের মধ্যে একজনকে মতির ভাল লাগে। তার নাম বনবিহারী।

বনবিহারী তার এই হতাশ-ক্লান্ত হোটেলজীবনে স্নেহ ও নৈকট্যের আশ্বাস নিয়ে আসে। সে মতিকে ভাসুর বলে পরিচয় দেয়। প্রথমেই বনবিহারী মতিকে বলে যে কুমুদ তাকে হোটেলে নিয়ে উঠেছে, এর জন্য সে আজ তার মাথা ফাটিয়ে দিতে এসেছে। বনবিহারীর কথায় আত্মীয়তার সুর দেখে মতি আশ্বাস পায়। বনবিহারী শিল্পী, বিজ্ঞাপনের ছবি এঁকে পেট চালাতে হয়। বাড়ি বলতে একটা ঘর আর একফোঁটা বারান্দা। তবু ত’ সেটা বাড়ি। কুমুদকে একদিন সস্ত্রীক বাড়িতে যাওয়ার আদেশ দিয়ে চলে গেল।

বনবিহারী আর তার স্ত্রী জয়া। জয়া মোটা, তবে সুন্দরী। জয়ার চেহারা জমকালো। চোখ দুটো ঝকঝকে, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। জয়া কুমুদকে বৌদি হিসেবে রসিকতা করে কথা বলে। বিয়ে করে বৌকে লুকিয়ে রাখল কুমুদ? জয়ার যে কৌতূহল ফেটে পড়ছে। গাঁ থেকে বৌ এনেছে দেখে জয়ার বিস্ময়ের শেষ নেই। জয়া ও বনবিহারীর আন্তরিকতা মতির কাছে অদ্ভুত ঠেকে। জয়ার রসিকতা, তরলতা ও পরনে দাসীর মতো বেশ, কুমুদের নাম ধরে ডাকা এসব মতির মনে প্রথম দর্শনে একটা বিরুদ্ধ ভাবের সৃষ্টি করে। জয়া চলে গেলে মতির মনে হয়েছে এতক্ষণ ‘ভোজবাজী’ চলছিল। কুমুদ ও জয়ার মধ্যে নিবিড় অন্তরঙ্গতা দেখে তার মনে জাগে ঈর্ষা। মতি কুমুদকে প্রশ্ন করে কেন সে তার নাম ধরে ডাকে। কুমুদ বলে জয়া তার অনেকদিনের বন্ধু। মেয়েমানুষ বন্ধু? এসব মতির কাছে দুর্বোধ্য। কুমুদ তাকে ভর্ৎসনা করে। তার মন এত ছোট? কুমুদের কাছে সাত টাকা সম্বল দেখে মতি অবাক হয়ে যায়। মতি চিন্তা করে। হোটেলের টাকা কুমুদ দেবে কিভাবে? এসব প্রশ্নে কুমুদ বিরক্ত হয়ে ওঠে। তাকে ভর্ৎসনা করে।

শেষে কুমুদ মতিকে নিয়ে আসে একটা গলির মধ্যে ছোট একতলা বাড়ির সামনে। জয়া বনবিহারী দরজা খুলে তাকে স্বাগত জানাল। মঙ্গলঘট স্থাপনে পায়নি, বাড়িতে শাঁখ নেই, উলু দিতেও জানে না। জয়া ও মতি মিলে নতুন ঘর সাফ করে সাজিয়ে ফেলল। বিকেলে এল নানা জিনিসপত্র। টেবিল, চেয়ার, আলনা, তক্তপোশ। নীল শেড দেওয়া সুন্দর একটি টেবিল ল্যাম্প। জয়ার স্নেহ ও আন্তরিকতা মতির জীবনে নিয়ে এল নতুন আশা।

জয়া কুমুদের সঙ্গে গল্প করে বন্ধু মতো। ঈর্ষায় বিদ্ধ হয় মতি। হোটেলবন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে মতি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। গাঁয়ের মেয়ে মতির মন গাওদিয়ার জন্য চঞ্চল হয়। নতুন পরিবেশে জীবনের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা দেখে মতি একটু আশান্বিত হয়। কুমুদ খামখেয়ালী, জীবনে খেয়ালবশে চলতে পারাতেই তার তৃপ্তি। জয়া ও বনবিহারীর জীবনযাত্রা সে লক্ষ্য করে। জীবনযাত্রায় বাইরের বৈচিত্র্য জয়া-বনবিহারী আনতে চায় না। সারাদিন বনবিহারী ছবি আঁকে। বাইরে যায় শুধু ছবি বেচবার জন্য, বাকি সময় ঘরে বন্দী রাখে নিজেকে। তাদের সংসারে কখনো সচ্ছলতা, কখনো অভাব। মতি-কুমুদ জয়া-বনবিহারীর সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করছে। আলু-পটলের বিনিময় জয়া পছন্দ করে না। সাংসারিক দেওয়া-নেওয়া সম্পর্কে জয়া কিন্তু বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন। এসব মতির কাছে অভিনব অভিজ্ঞতা। জয়ার ওপর মতি রাগ করে অভব্য কথা বলে। জয়ার সঙ্গে মতির খাপ খায় না। তাদের মেলামেশা, গল্পগুজবের মধ্যে প্রীতির অভাব চোখে পড়ে। এর মধ্যেও যেটা উল্লেখ্য তা হচ্ছে জয়ার মনে স্বামীর জন্য গভীর দুঃখ। স্বামীর প্রতিভা অর্থাভাবে বিকশিত হতে পারেনি বলে জয়ার মনে বেদনা গভীর হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গরমিল হলেও মতিকে জয়া এসব কথা বলে, কিন্তু মতির মধ্যে বুঝবার শক্তির অভাব দেখে জয়া আহত হয়। সম্ভাবনাময় শিল্পীর জীবন কিভাবে যে পঙ্গু হয়ে গেল, তা বোঝবার অনুভূতি মতির নেই বলে জয়ার মন তার ওপর বিরূপ হয়ে ওঠে। মতি অবশ্য বনবিহারীকে শ্রদ্ধা করে। বিস্মিত দৃষ্টিতে, বনবিহারীর ছবি আঁকা দেখে। বনবিহারীর স্নেহদৃষ্টিতে মতি ‘খুকী’। তাই সময় পেলেই তার ছবি এঁকে দেবে এ কথা বলে বনবিহারী। জয়া ইশারা করে মতিকে ডাকে। ছবি আঁকার সময় যেন তার স্বামীকে মতি বিরক্ত না করে। ঘটনার নানা স্রোতে এইভাবে সূক্ষ্ম মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় চারজন নরনারীর জীবনযাত্রা প্রবাহিত হয়। হোটেলের অনিয়মিত বেপরোয়া জীবনের পাশে আসে গৃহজীবন। এই জীবনে সুখদুঃখ ঈর্ষাও দেখা দেয়।

জয়া-বনবিহারী বৃত্তের সার্থকতা মতি ও কুমুদের জীবনে প্রচুর। প্রথমত, মতি কুমুদের বোহেমিয়ান জীবনে সাময়িকভাবে একটা ছেদ পড়ে। মতিও পায় গৃহ ও গৃহকর্মের সাফল্য। জয়ার মতো আত্মীয়া ও প্রতিবেশিনীর সাহায্যে মতি অনেক বেশি অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে অনেক বেশি পরিণত। মতি জয়ার জীবনযাত্রা থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেয়। মতি জয়ার তুলনায় অনেক বেশি অগভীর। স্বামী সম্পর্কে বোধ তার প্রথম দিকে যা, পরবর্তীকালে তা থাকে না। এই বোধ মতিকে প্রভাবিত করে। বনবিহারী এবং বিশেষ করে জয়া কুমুদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে, তাকে গৃহী হিসেবে তৈরি করতে সাহায্য করে। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন—”বিবাহিত জীবনের এরুপ Bohemianism উচ্ছৃঙ্খল যাযাবরত্নের চিত্র বঙ্গসাহিত্যে আর নাই। ……বিবাহের মত একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো ও সে জুয়াখেলার অনিশ্চয়তা ও অদৃষ্টবাদিত্ব আরোপ করিয়াছে। মতির চরিত্র তাহার প্রভাবে নিগূঢ়ভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে। কুমুদের নতুন ভাগ্যপরীক্ষার পথে সেও তাদের সঙ্গী হইয়া তাদের জীবন নীতিকেই বরণ করিয়া লইয়াছে।”—(বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা)। কুমুদ-মতির জীবনযাত্রায় বনেদকে হয়তো জয়া বনবিহারী পরিবর্তিত করে তুলতে পারেনি, কিন্তু তাদের মধ্যে সুখী গৃহস্বপ্নের বাস্তব সংগ্রামকে মতি প্রত্যক্ষ করেছে। আগ্রহের সঙ্গে মতি জয়া ও বনবিহারীর জীবনযাত্রা লক্ষ্য করে। এই দিকে এই বৃত্তের উপযোগিতা অসাধারণ।

জয়াকে দেখে মতি নিজের ঘর গুছিয়েছে। “সামান্য জিনিষ, জয়ার ঘরের সঙ্গে তুলনা করিয়া নিজের ঘরখানা মতির খালি খালি মনে হইতে লাগিল, খেলাঘরের মতো ঠেকিতে লাগিল। কিন্তু সেইদিন বিকালেই জিনিস আসিল। কোথা হইতে টাকা পাইল কুমুদ সেই জানে। হোটেলের পাওনা ফাঁকি দিক, কৃপণ সে নয়। টেবিল, চেয়ার, আলনা, বড়ো একটা তক্তপোষ আনিয়া সে ঘর বোঝাই করিয়া ফেলিল, নীল শেড দেওয়া সুন্দর একটি টেবিল ল্যাম্প ও মতির জন্য ভালো একখানা শাড়িও কিনিয়া আনিল।” এইভাবে মতির গৃহস্বপ্ন সার্থক হয়ে ওঠে। জয়ার সংস্পর্শে এসে একদিকে যেমন মতির স্বপ্ন রূপ পায়, অন্যদিকে সে জীবনকে দেখতে শেখে, সংসারের জটিলতা বুঝতে শেখে। জয়া মতির মনে ঈর্ষা এনে দেয়, কুমুদকে যারা বাঁধতে পারে নি, জয়া কি তাদেরও একজন? মতির মনে সরল বোধ থেকে এই অনুভূতি কথা বলে—“তা যদি হয় তবে তো বড়ো কষ্ট জয়ার মনে।” হিংসা নয়, সমবেদনা এসে মতিকে পূর্ণ করে। ক্রমে ক্রমে জয়া বনবিহারী সম্পর্কও বদলে যায়। জয়া বনবিহারীর ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারে না। ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। জয়া বনবিহারীকে ঠক, জোচ্চার বলে। মতি জয়ার ব্যাপার দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। জয়া দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। মতি জয়ার ব্যবহারে বিপন্ন বোধ করে। মিথ্যার মানস-স্বর্গ থেকে জয়া নেমে এসেছে, এ-ব্যাপারে মতি-কুমুদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কুমুদ-মতির ভালোবাসা দেখে জয়ার মোহভঙ্গ হয়। জয়া শেষে বোঝে বনবিহারীর প্রতিভা ভূয়ো। সবই জয়ার কল্পনা। এই বোধ পরিবর্তন মতি-কুমুদ বৃত্তের প্রত্যক্ষ ফল। জয়া যা নিয়ে এতকাল বেঁচে ছিল সবই ভেঙে গেল। জয়া কুমুদের বাঁচার দর্শন, বাঁচার আনন্দকে উপভোগ করে। হঠাৎ সে বলে ‘আমি যদি মতি হতাম’—জয়া মতি-কুমুদের ভালোবাসাকে সহ্য করতে পারে না। তাই জয়া কুমুদকে নতুন বাড়ি দেখে চলে যেতে বলে। কুমুদের দুঃখ এই যে তাদের জীবন জয়া বনবিহারীর ঘর ভেঙে দিল। মতি অবশ্য এসব দুর্বোধ্য রহস্য বুঝতে পারে না। জয়া-বনবিহারী কাহিনীর ট্র্যাজেডি এইভাবেই মতি-কুমুদকে এগিয়ে দেয় জীবনের অন্য দিকে। এখানেই এই কাহিনীর সার্থকতা।