কোনো কোনো সমালোচক ‘নিশীথে’ গল্পটির মূলরস অতিপ্রাকৃত বলে মনে করেছেন, কোনো কোনো সমালোচক তা স্বীকার করেন নি। এ সম্পর্কে আলোচনা করে যুক্তিসহ তোমার মত প্রকাশ করো।

ড. সুখময় মুখোপাধ্যায় নিশীথে গল্পটির মূলরসকে অতিপ্রাকৃত বলেছেন। কারণ গল্পটির আবহ, নায়কের অনুভূতি সবই অতিপ্রাকৃতের রসের উদ্বোধন ঘটিয়েছে। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় নিশীথে গল্পটিকে অতিপ্রাকৃত বলে স্বীকার করেন নি। তিনি লিখেছেন, “নিশীথে’ গল্পটি সম্পূর্ণ মনোবিকারভিত্তিক। দাম্পত্য আদর্শচ্যুতির জন্য অপরাধবোধ এই মনোবিকারের উদ্দীপক, নিশীথরাত্রির নির্জনতার মধ্যে হঠাৎ শ্রুত ধ্বনিতরঙ্গ উহার উপলক্ষ্য ও আত্ম-উদ্ঘাটনের অদম্য আবেগ উহার প্রকাশের পিছনে বিস্ফোরক শক্তির ন্যায় উৎক্ষিপ্ত। দক্ষিণাচরণের মানস গঠনের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যাহার জন্য একটা ক্ষণিক অভিঘাত উহার চেতনাকোষে চিরসজ্জিত রহিয়াছে ও স্মৃতি-অনুষঙ্গের সূত্রে অতীত বেদনা অনুভব লোক হইতে ইন্দ্রিয়জগতে আতধ্বনির বিক্রমে পুনরুদ্ধৃত হয়।” ড. বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিশ্লেষণ আমি সঠিক বলে মনে করি এবং অতিলৌকিক নৈসর্গিকের পরিবেশ বা আবহও সৃষ্টি হয়েছে লেখকের বিকারগ্রস্ত মনের দৃষ্টিতে। তবে দক্ষিণাচরণের কবিমনের পরিচয় তিনি ডাক্তারের কাছে নিজেই দিয়েছেন এবং সংস্কৃত কাব্যপাঠে তাঁর গভীর অনুশীলনের কথাও নিজেই বলেছেন। সুতরাৎ পদ্মাতীরের নির্জন বালুকাবেলার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে তিনি অনুভব করেছেন ও বর্ণনা করেছেন তা তাঁর কবিমনেরই পরিচায়ক। তা ছাড়া প্রথমা পত্নীর প্রতি তাঁর হৃদয়ে লালিত গভীর প্রেম তাঁর প্রতি অন্যায় আচরণে তাঁকে গভীরভাবে অনুতপ্ত করেছে।

প্রথমা পত্নীর চরিত্রগাম্ভীর্য, তাঁর সেবা গ্রহণে অনিচ্ছা এবং স্বামীর সমস্ত আত্মমুখলোলুপতার অকুণ্ঠ প্রশ্রয়, মনোরমার সঙ্গে বিবাহ নিষ্কণ্টক করার জন্য স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ— এ সমস্তই তার স্বামীর মনে এমন অনপজেয় রেখায় অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল, যে কালের ও জীবনের নব অভিজ্ঞতার প্রলেপ তাকে মুছে ফেলতে পারেনি। উপলক্ষ্য পেলেই দক্ষিণাচরণের পূর্বস্মৃতি আবার অবচেতন থেকে চেতনলোকে জেগে উঠত। মনোরমার প্রথম আবির্ভাবে প্রথমা স্ত্রীর সেই ত্রস্ত প্রশ্ন—“ও কে, ও কে, ও কে গো”—সাময়িকতার ক্ষীণ বন্ধন ছাড়িয়ে যেন অসীম দেশে ও অনন্তকালে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, মানবাত্মার চিরন্তন মর্মকোষে চিরমুদ্রিত হয়ে অমরতা লাভ করেছে। এই সামান্য একটি ক্ষুদ্র প্রশ্নের এই অসাধারণ বোধশক্তির কারণ বোধ হয় এই যে, এই কয়েকটি সামান্য কথায় প্রথমা স্ত্রীর চির-অবদমিত আবেগোৎকণ্ঠা একবারমাত্র আত্মউন্মোচন করেছে, জীবনভোর চাপা সত্য বারেকের আত্মবিস্মৃতিতে সবেগে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে এবং তা প্রথমা স্ত্রীর মনোভাবের সত্য দ্যোতনারূপে অনুতপ্ত স্বামীর চেতনায় অনুবিদ্ধ রয়েছে। এর পরিবেশ রচনার জন্য প্রয়োজন নদীতীরের নির্জনতাও এই নির্জনতায় হঠাৎ উদ্‌গীরিত ধ্বনি-কাকলি। বলাকার পক্ষধ্বনির মত এখানেও শব্দতরঙ্গ বিশ্বরহস্যের মর্মবিদারণে নিয়োজিত। প্রকৃতপক্ষে গল্পটি অতিপ্রাকৃত নয়, আত্মদমন অক্ষম বিকারেরই অভিব্যক্তি।

রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ গল্পটি ছোটগল্পরূপে কতটা সার্থক হয়েছে, আলোচনা করো।

অনেকেই ‘নিশীথে’ গল্পটিকে রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু গল্পটি না অতিলৌকিক না মনোবিকারের গল্প। এডগার অ্যালান পোর ‘লিজিয়া’ গল্পের অনুকরণে গল্পটি লেখা হয়েছে অধ্যাপক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস তা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছেন। সুতরাং বিদেশী গল্পের অনুকৃত গল্প কখনই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে না।

গল্পের নায়ক দক্ষিণাচরণের মনোবিকার তাঁকে অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের দিকে প্ররোচিত করেছে এবং কাহিনীর বর্ণনায় একটা অতিপ্রাকৃত আবহের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করবার বিষয় যে এডগার অ্যালান পো-র লিজিয়ার মত প্রত্যক্ষ অলৌকিক ঘটনা ‘নিশীথে’ গল্পে অবতারণা করা হয় নি।

‘নিশীথে’ গল্পটি মূলত চরিত্রগত, ঘটনাগত বা ভাবগত নয়। কিন্তু লেখক গল্পটির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে স্থিত থাকতে পারেন নি—ঘটনা ও ভাবের সংমিশ্রণে কেন্দ্রচ্যুত হয়েছেন।

ছোটগল্পের লাক্ষণিক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করে ড. ভূদেব চৌধুরী তার সারসংক্ষেপ করেছেন নিম্নোদ্ধৃত বক্তব্যে।

প্রথমত, অপার বিস্তৃত রহস্য-জটিল আধুনিক জীবনভূমি ; যার প্রতি বিন্দুতে জমে আছে অতলান্ত গভীরতা। তার যে-কোনো একটি গহনে তলিয়ে পূর্ণজীবনের একটি অখণ্ড ছায়ারুপকে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ছোটগল্পের দ্বিতীয় উপাদান শিল্পীব্যক্তির ঘন-নিবিড় অনুভব-তন্ময়তা—চলমান জীবন সম্বন্ধে তাঁর ধ্যানী-জনোচিত আত্মস্থতা। সেই সুস্থির চেতনার মুকুরে জীবনের যে-কোনো মুহূর্ত যেন পূর্ণ জীবনের ছায়া ফেলতে পারে।

তৃতীয়ত, চাই রচনার ব্যঞ্জনাধর্মিতা। যেন একটি জীবনের বিশেষ মুহূর্তের অবস্থান অভিঘাত বা আবেগ সর্বদেশকালের জীবনভূমিতে উৎক্রমণ করতে পারে।

ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছোটগল্প সম্পর্কে যে মূল্যবান আলোচনা করেছেন তা উদ্ধৃতিযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “ছোটগল্প ঘটনাশক্তিতে নিহিত একটি নিটোল মুক্তা, ছোট ঝিনুকে পরিবেশিত একবিন্দু জীবন-রসনির্যাস, ললাটলিপিতে উৎকীর্ণ এক বাক্যাত্মক একটি গাঢ়বদ্ধ জীবনাণুশাসন। মানুষের জীবনে কত এলোমেলো, বহু-বিস্তৃত, অসংবদ্ধ অভিজ্ঞতার সমাবেশ। ঔপন্যাসিক সেই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, বিশৃঙ্খল উপাদান-রাশিকে তাৎপর্যসূত্রে গাঁথিয়া এক বৃহৎ পরিণতির দিকে লইয়া যান। ছোটগল্প রচয়িতা সেগুলিকে নিজ ক্ষুদ্র অঞ্জলিতে তুলিয়া লইয়া উহার দ্বারা অঙ্গুলি পরিমিত বেদীতে জীবনদেবতার অর্থ রচনা করেন। ছোটগল্পে জীবন অভিজ্ঞতার যেটুকু তুলিয়া লওয়া হয়, আর যে বৃহৎ ফেলিয়া রাখা হয় উভয়ে মিলিয়া উভয়ের পরিপুরকরূপে প্রতিভাত হয়। যাহা চোখের বাহিরে থাকিল তা ব্যানার রঞ্জনরশ্মিতে বোধশক্তির বিষয়ীভূত হয়। একটি ক্ষুদ্র আখ্যানখণ্ডে সমগ্র জীবনতাৎপর্য প্রতিবিম্বিত করাই ইহার উদ্দেশ্য ও শিল্পরূপের প্রেরণা।”

ড. বন্দ্যোপাধ্যায় যে বলেছেন জীবনের অজস্র উপাদানের সামান্যই গ্রহণ করে একবিন্দু জীবন-রসনির্যাস ক্ষুদ্র আখ্যান খণ্ডে পরিবেশিত করাই ছোটগল্পের কাজ, সেই কাজটি যে নিশীথে গল্পে সম্পাদিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ছোটগল্পের এই প্রাথমিক শর্ত পালন করলেই তা সার্থক ছোটগল্প হয়ে ওঠে না। নিশীথে গল্পে কাহিনীর একমুখিনতা আছে, কিন্তু রস পরিবেশনের ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত। গল্পটি চরিত্রভিত্তিক না অতিপ্রাকৃত পরিবেশ নির্ভর গল্পপাঠকেরও সে সম্পর্কে সংশয় থেকে যায়। ‘নিশীথে’ গল্পের নায়কের স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুতাপের আগুনে পুড়ে এক মনোবিকারের জন্ম দিয়েছে এবং নায়কের জীবনে ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করেছে। ছোটগল্পে শিল্পী-ব্যক্তির যে ঘন-নিবিড় অনুভূতি-তন্ময়তা প্রত্যাশিত তা ‘নিশীথে’ গল্পে উপস্থিত কিন্তু মূল গল্পে অন্বিত হতে পারে নি। প্রকৃতি বর্ণনার অপূর্ব সৌন্দর্য পাঠককে যে সৌন্দর্যলোকে উত্তীর্ণ করতে পারত তা ভৌতিক আবহের রহস্যময়তায় ব্যর্থ হয়েছে।

রচনার যে ব্যঞ্জনাধর্মিতা সার্থক ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ উপাদান, ‘নিশীথে’ গল্পে তা অনুপস্থিত। মদ্যপ বিকারগ্রস্ত দক্ষিণাচরণের মানসিকতা ও আচরণ গল্পটিতে সেই অসাধারণ ভাবৈশ্চর্যের সৃষ্টি করতে পারে না, যা বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণ করতে পারে। সুতরাং ছোটগল্পরূপে ‘নিশীথে’ খুব সার্থক হয়েছে বলা যায় না।