বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ জীবনের থেকে নানা উপাদান নিয়ে ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাঁর ছোটগল্প মানেই তাঁর জীবনচেতনা ও দৃষ্টচরিত্রের রসময় রূপায়ণ। কখনো কখনো চরিত্রই সেখানে প্রধান হয়ে উঠেছে, কখনও ঘটনা সংগঠন। কখনও আবার কোনো মনস্তত্ত্ব প্রাধান্য পেয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর অনবদ্য ছোটগল্প।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত ‘একরাত্রি’ গল্পটি ছোটগল্প রচনার স্বর্ণযুগে একটি রাত্রিকে ঘিরে স্মৃতিচারণ ব্যক্ত হয়েছে। নায়কের চিন্তা ভাবনা ও মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী যুবসম্প্রদায়ের অন্ধভাবে নেতৃ-অনুসরণের প্রতি বিদ্রূপ করেছেন গল্পকার। সে বিদ্রূপ যুব সম্প্রদায়ের আবেগের চেয়েও তাদের যারা ভ্রান্তপথে পরিচালিত করছেন তাদের দিকেই বেশি করা হয়েছে।

আলোচ্য ‘একরাত্রি’ গল্পটি ছোটগল্প হিসেবে সার্থক হয়েছে কিনা, তা বিচার করতে হলে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে বিচার করে দেখার প্রয়োজন। যেমন, প্রথমত, দেখতে হবে গল্পটির মধ্যে বাস্তবতা রয়েছে কিনা? এখানে দেখা যায় নায়ক তার আশৈশব যৌবন পর্যন্ত নিজের জীবনধারা যা বর্ণনা করেছে তাতে কোনো অবাস্তবতার চিহ্ন নেই। প্রথমত ছোটবেলায় চারপাশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বিশেষ করে আদালতজীবীদের মধ্যে অর্থের কারণে মিথ্যার বেশাতি সে দেখেছে। নায়কের পিতা জমিদারের সেরেস্তা থাকার জন্যে তাঁর পূজ্য এই সব আদালত কর্মচারী এবং পেয়াদারা নায়কের চোখে ছিল আদর্শস্থানীয়। ফলে নায়কের জীবনের একমাত্র অভিষ্ট ছিল অর্থ রোজগার আর বিপুল অর্থ সঞ্চয় করা। তাই সে বাড়ি থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসে পড়াশোনা করে কালেক্টরের নাজির হবার আশায়।

কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে ছেলেদের মধ্যে এক বিপুল আবেগ কাজ করে। সে আবেগ যথার্থভাবে কাজে লাগালে নব্যযুবকদের দিয়ে অনেক কাজ করানো যেতে পারে কিন্তু এদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বরাবর এদের দিয়ে আত্মস্বার্থ সিদ্ধি করিয়ে নিজেদের সেবায় নিয়োজিত করেছে। দেশপ্রেমের আদর্শ দেখিয়ে তাদের বিপথে চালিত করেছে। নায়কও সেই চক্রান্তের শিকার হয়ে, তার শৈশবের সঙ্গিনীকে জীবনের মতো হারিয়েছে।

পরবর্তীকালে সংসারের দায়িত্ব মাথায় এসে পড়লে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে নোয়াখালিতে তাকে একটি স্কুলে চাকরি নিতে হয়। সেখানে জীবনের বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে সে দেখে, দেশপ্রেমের আদর্শের চেয়ে পরীক্ষার পড়া ছাত্রদের কাছে বড়।

এরপর সে জানতে পারে তার শৈশবের সঙ্গিনী তার কর্মক্ষেত্রেরই সংলগ্ন এক উকিলের গৃহবধূ। তার সঙ্গে আর আগের মতো কথা বলার অধিকার তার নেই। অত্যন্ত পরিচিত হলেও, আজ সে তার পক্ষে পরপুরুষ। পূর্বাপর সমস্ত ঘটনার মধ্যে এই নিখুঁত বাস্তব চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। অযথা কল্পনা, দৈবসংগঠন কিছুই এখানে স্থান পায় নি।

সার্থক ছোটগল্পের আর একটি শর্ত তার ক্লাইমেন্স বা শীর্ষবিন্দু। গল্প যেখানে শেষ হয়েও শেষ হয় না। আলোচ্য ‘একরাত্রি’ গল্পের মধ্যেও দেখা গেছে এক বিশেষ রাত্রি আবির্ভূত হয়েছে যেখানে নির্জন জলমগ্ন পৃথিবীর মধ্যে কেবলমাত্র নায়ক এবং তার বাল্যসঙ্গিনী তথা বর্তমান পরস্ত্রী সুরবালা দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। নায়কের ভাষায়, “আর সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে, কেবল হাত পাঁচছয় দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম। তখন প্রলয়কাল, তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে কেবল দুইজনে অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলাম, পদতলে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ উন্মত্ত মৃত্যুস্রোত গর্জন করিয়া ছুটিয়া চলিল। এখন কেবল আর একটা ঢেউ আসিলেই পৃথিবীর এই প্রান্তটুকু হইতে বিচ্ছেদের এই বৃত্তটুকু হইতে খসিয়া আমরা দুজনে এক হইয়া যাই। সে ঢেউ না আসুক।…. আমি এই একরাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।”

এরপর গল্প শেষ হয় ঝড় থেমে যায়, রাত্রিও শেষ হয়ে আসে। জল নেমে গেলে সুরবালা বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু হাত পাঁচছয় দূরে নির্বাক অবস্থায় উভয়ের উপস্থিতি নায়কের মনের তন্ত্রীতে যে সুর জাগিয়ে গেল, সেই ক্ষণকালের সুরের মধ্যেই জাগে অনন্তকালের অনুভূতি।

সমগ্র গল্পটির মধ্যে দেখা যায়, নায়কের শৈশবে সুরবালার প্রতি যে আকর্ষণ খেলার সঙ্গী থেকে ক্রমে তার যে পরিণতি, নানা ঘটনা সংগঠনের মধ্যে দিয়ে তাই গল্পটির মুখ্য উপজীব্য হয়ে ধীরে ধীরে চরম মুহূর্তের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। গল্পের এই একমুখিনতা ছোটগল্পের অন্যতম শর্ত এখানে পূর্ণ হয়েছে।

সবদিক থেকে বিচার করে দেখলে গল্পটির বাস্তবতা, একমুখিনতা, পাঠকের চিত্তাকর্ষণী শক্তি, জীবনবিম্বন এবং একটি মাত্র শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হওয়া এই সমস্ত ছোটগল্পের শর্তগুলি এখানে সার্থকভাবে পূর্ণিত হয়েছে। ফলত সব দিক থেকে বিচার করে দেখলে ‘একরাত্রি’ গল্পটি যে ছোটগল্প হিসাবে সার্থক হয়েছে এ কথা অনস্বীকার্য।