ভূতনাথের প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় বুদ্ধিতে খাটো, লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া একটি উনিশ বছর বয়সের যুবক রূপে। ষোল-সতেরো বছর পর্যন্ত ‘বিদ্যালয়ে তানানানা’ করে কাটিয়ে অবশেষে আয়ুর্বেদ পড়তে আগ্রহী নয়, সম্মত হয়েছে। তার মেধা নেই। অধ্যাবসায়ও নেই। পড়া সংক্রান্ত দরকারী কথা তার কানে বিশেষ পৌঁছয় না। অর্থাৎ সে অমনযোগী। বিষয়ী পিতা তাকে আয়ুর্বেদশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলাপ ও মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পড়ায়। কিন্তু একান্ত অনিচ্ছায় সে তা সহ্য করে। জীবিকা হিসাবে আয়ুর্বেদ শেখার ভিত্তি হিসাবে ব্যাকরণ পাঠে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার ব্যাপারটা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। তার মায়ের কাছে এ ব্যাপারে সে বিরূপতাও প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই ভূতনাথই ক্রমশ মনের দিক থেকে বেড়ে উঠেছে। তার পিতৃভক্তি পরিণত হয়েছে ঘৃণায় যখন পিতৃদেবের ভয়ঙ্কর হত্যাকারীর চরিত্র তার সামনে উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে।
আলোচ্য গল্পে ভূতনাথ চরিত্রটিরই একটি ক্রমবিকাশ লক্ষ্য করা যায়। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত ও পরিণত হয়েছে। মণিমালিকার সঙ্গে যখন তার বিয়ে হয়েছে তখন তার বয়স কম এবং পিতার সে অনুগত। মণিমালিকা নিতান্তই বালিকা এবং সে ছিল তার খেলার সাথী। “ভূতনাথ মণিকে রাগায়, কাঁদায়, আবার খিলখিল করিয়া হাসায়।” দ্বিতীয় বিবাহ হয় অনুপমার সঙ্গে, তখনও সে পিতার বিরোধী নয়। অনুপমা হয়ে উঠল তার যৌবনের সঙ্গিনী। অনুপমার মৃত্যু তার মনে গভীরভাবে আঘাত দেয়। তার স্মৃতি তাকে পীড়িত করতে থাকে এবং সে আবার বিবাহ করতে অস্বীকার করে। তার ব্যক্তিত্ব যে ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে তার এই অস্বীকারের মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু পিতৃদেবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না বলে শেষ পর্যন্ত তাকে পিতৃ-ইচ্ছায় বীণাপাণির পাণিগ্রহণ করতে হয়।
বীণাপাণির পিতার প্রেরিত মানি অর্ডার যখন ভূতনাথের হস্তগত হয় তখন কৃষ্ণকান্তের গভীর চক্রান্ত এবং চরিত্রের ভয়ঙ্করতা তার কাছে উদ্ঘাটিত হয়ে যায়। বার বার তাকে বিবাহ দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং কালোমেয়ের বাবার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের কৌশল তার কাছে সহসা স্পষ্ট হয়ে যায়। ভূতনাথ পিতার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে বেঁকে বসে। সে শ্বশুরকে চিঠি দিয়ে মানি অর্ডার পাঠাতে নিষেধ করে। এখানে ভূতনাথের ব্যক্তিত্ব ও সততার পরিচয় পাওয়া যায়। সততা ও মানবিকতার পরিচয় এর আগেও পাওয়া যায়, পরপর দুই স্ত্রী মারা যাবার পর পুনশ্চ তৃতীয় পক্ষ বিবাহ করার প্রবল অসম্মতিতে স্পষ্টই বোঝা যায়। এই ঘটনার সময় ভূতনাথ আর অযথা পিতৃভক্ত নয়। সে পরিপূর্ণ মানুষ। ভালো মন্দ বিচার করার মতো ব্যক্তিত্বে গঠিত। সর্বোপরি আপন স্ত্রীর প্রতি এখন সে দায়িত্ববান স্বামী। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণকান্তের বীণাপাণিকে হত্যার চেষ্টা ভূতনাথকে পিতৃ-আনুগত্যের বন্ধন ছিন্ন করতে প্ররোচিত করে এবং পিতৃদ্রোহী করে তোলে। পিতার ধারণায় নির্বোধ ভূতনাথ পিতার চরিত্র বুঝে ফেলে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সক্রিয়তা আকস্মিক নয়, তার অভিজ্ঞতারই পরিণতি। সে বুঝতে পারে তার হৃদয় তার পিতার কাছে সম্পূর্ণ মূল্যহীন, সে অর্থলোলুপতার মাধ্যম মাত্র, তখনই সুতীব্র ঘৃণায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। জগদীশ গুপ্তের চরিত্র-চিত্রণের নৈপুণ্য এইখানে।
Leave a comment