বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে আমরা কাপালিক চরিত্রের সাক্ষাৎ পাই। তিনি তন্ত্রমতে দেবী কালিকার পূজা করতেন। তন্ত্রমতে পূজার্চনা তামসিক সত্তাকেই প্রকট করে। হীন চর্চা, পঞ্চ ‘ম’কারে সাধনা এগুলি তান্ত্রিক পূজার বিধি, তাইজন্য তিনি নবকুমারকে দেবীর সামনে বলি দেবার জন্য উৎসুক হয়েছিলেন, কাপালিক এর পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলার জন্য সে যাত্রায় নবকুমার প্রাণে বাঁচে। কিন্তু উপন্যাসের ঘটনা সংঘটনে, পদ্মাবতীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে এবং কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের সংসার বিনষ্টে এবং সর্বোপরি তাদের জীবন বিপন্নে এই সন্ন্যাসী কিংবা তান্ত্রিক কাপালিকের ভূমিকাই প্রধান।

বিভূতিভূষণের ‘মেঘমল্লার’ গল্পে সুরদাস ওরফে গুণাঢ্য চরিত্রটিও একজন তান্ত্রিক। এবং সে তন্ত্র-মন্ত্র প্রভৃতি হীন উপায়েই সাধনা করতো। এবং সে নিজে একজন অত্যন্ত খল চরিত্র। ‘কপালকুণ্ডলা’র কাপালিকও যেমন থল সুযোগসন্ধানী ঈর্ষাপরায়ণ ভয়ংকর, সুরদাস ওরফে গুণাঢ্যও তদনুরূপ।

গল্পের শুরুতেই দশপারমিতার মন্দিরে আমরা তাকে প্রথম দেখি। দশপারমিতার মন্দিরে উৎসব, এই উৎসবে গল্পের নায়ক চরিত্র প্রদ্যুম্ন ভাল বীণ বাজিয়ের সাক্ষাৎলাভ করতে এসেছিল এবং এখানেই তার সঙ্গে সুরদাসের আলাপ ঘটে— “অনেকক্ষণ ধরে দেখবার পর তার (প্রদ্যুম্ন) চোখে পড়ল একজন প্রৌঢ় ভিড়ের মধ্যে তার দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পরনে অতি মলিন ও জীর্ণ পরিচ্ছদ।”

বিভূতিভূষণ এভাবেই প্রথম সুরদাসের পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। প্রৌঢ়টি নিজেকে—’আমি অবস্তীর গাইয়ে সুরদাস’ বলে পরিচয় দান করে প্রদ্যুম্নর কাছে। এবং প্রদ্যুম্নর পিতার সঙ্গে তার যে সখ্য ছিল সে কথাও বলে এবং প্রদ্যুম্ন কি করে সে খবর নেয় ভালো করে। এবং নদীর ধারে ভাঙা মন্দিরে প্রদ্যুম্নকে একদিন তার সঙ্গে গোপনে দেখা করতে যেতে বলে।

এরপরে সুরদাস চলে যায় এবং প্রদ্যুম্ন যখন বিহারে ফিরতে শুরু করে তখন তার প্রিয়া সুনন্দার সঙ্গেও তার দেখা হয়, সুনন্দার সঙ্গে নানান কথাও হয়। সুনন্দাকে সে বাঁশির সুরও শোনায় কিন্তু সুরদাসের কথা তার বারবারই মনে পড়ে এবং সুরদাসের উপস্থিতি বা সত্তা প্রদ্যুম্নকে যে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রদ্যুম্ন প্রিয়ার সান্নিধ্যে থেকেও বারবার সুরদাসের কথা ভাবার ঘটনায়— “কি জানি কেন প্রদ্যুম্নের বার বার মনে আসছিল সেই জীর্ণ পরিচ্ছদপরা অদ্ভুতদর্শন গায়ক সুরদাসের কথা।….”

এই অংশেই লেখক সুরদাসের বহিরঙ্গের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ বর্ণনায়— “তাদের বিহারের কলাবিৎ ভিক্ষু বসুব্রতের আঁকা জরার চিত্রের মতই লোকটা কেমন কুশ্রী লোলচর্ম-শীর্ণদর্শন। পুরাতন পুঁথির ভূর্জপত্রের মত ওর পরিচ্ছদের কেমন একটা অপ্রীতিকর মেটে লাল রং।”

প্রদ্যুম্নর সঙ্গে সুরদাসের দেখা হওয়ার ক্ষণ থেকে সুরদাসের প্রতি প্রদ্যুম্নর একটা আকর্ষণ আমরা লক্ষ্য করি। সেটা যে ভাল বীণ বাজিয়ের সাক্ষাৎ লাভ সেটা আমরা গল্প পাঠকেরই ধরতে পারি। কারণ প্রদুম্ন ভাল বীণ বাজিয়েকে খুঁজছিল এবং সুরদাসের সাক্ষাৎ পাওয়ার পর সুরদাস নিজেকে বীণ বাজিয়ে বলেই পরিচয় দেয়।

সুরদাসের কথামত তার পরদিন প্রদ্যুম্ন তার সঙ্গে দেখা করতে যায়, প্রদ্যুম্নর বাঁশি শুনে সে মুগ্ধ হয়ে। আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত্রে দেবী সরস্বতীকে মর্ত্যে আনার গোপন প্রক্রিয়াটি তাকে জানায়। প্রদ্যুম্ন একটু ইতস্তত করলেও সুরদাসের কথা বলার সম্মোহনী শক্তির দ্বারা বশীভূত হয়ে বাঁশি বাজাতে রাজি হয়। এবং এরপর ঐ আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাত্রে সুরদাস ওরফে গুণাঢ্যের কথামত বাঁশিতে মেঘমল্লারের তান তুলে দেবীকে মর্ত্যে আনে।

এখানে একটা কথা বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রদ্যুম্নর শুধুমাত্র বাঁশির মায়ায় দেবী ভোলেন নি, সুরদাসের তান্ত্রিক শক্তি এবং ক্রিয়াকর্মের জন্যই দেবীমর্ত্যমুখী হন। তাই আমরা গল্পে দেখি প্রদ্যুম্নর বাঁশি বাজানোর আগে সুরদাসের তান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূজার্চনার আয়োজন। এবং সুরদাস যে একজন তান্ত্রিক তা এই অংশে স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন গল্পকার—“ব্যাপারটার শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায় দেখবার জন্য তার মনে এত কৌতূহল হচ্ছিল যে অন্ধকার রাতে একজন প্রায় অপরিচিত তান্ত্রিকের সঙ্গে একা থাকবার ভয়ের দিকটা তার একেবারেই চোখে পড়ল না।” এবং তান্ত্রিকের জীবনাচরণ যে অতি হীন তাও এখানে প্রকট—“তাঁর চোখের কেমন একটা ক্ষুধিত দৃষ্টি যেন প্রদ্যুম্নর ভালো লাগল না।”

তান্ত্রিক ও হীন উপায়ে তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা এবং পূজার্চনা যাঁরা করেন তাঁদের দৃষ্টি ভলো হয় না এবং হীন চর্চার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে তামসিক প্রবৃত্তিটা তাদের মধ্যে বেশি হয়। এ গল্পেও দেখি সুরদাস ছলনা করে প্রদ্যুম্নকে বশীভূত করে এবং তাকে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে। দেবীকে বন্দিনী করবার লোভ তার আগে থেকেই ছিল প্রদ্যুম্নকে দিয়ে তার কার্যটি সম্পন্ন করে। বৌদ্ধবিহারের আচার্য পুর্নবর্ধন সুরদাসের যথার্থ স্বরূপ উন্মোচন করেন প্রদ্যুম্নর সামনে এবং সুরদাস যে তাঁর নাম নয় তার নাম যে গুণাঢ্য সেটাও স্মরণ করিয়ে দেন।

প্রদ্যুম্ন তখন গুণাঢ্য এবং দেবীর খোঁজে বিহার পরিত্যাগ করে। এবং ঊরুবিশ্বগ্রামে প্রথমে দেবী এবং তারপর একদিন গুণাঢ্যের সাক্ষাৎ পায়—’পশু চিকিৎসক’ হিসেবে। দেবীর বন্দিনী অবস্থা দেখে এবং আত্মবিস্মৃতা দেবীর দুঃখ দেখে প্রদ্যুম্নর মনে করুণার সঞ্চার হয় এবং তাঁকে মুক্তি দিতে উপায় খুঁজতে থাকে।

দেবীর মুক্তির উপায় বলে দেয় গুণাঢ্য-ই যে দেবীকে বন্দিনী করেছে। কিন্তু এখানেও তার হীন চক্রান্ত, ছলনা আবার প্রকট হয়ে পড়ে— “আমি এ কাজ করবার পর যথেষ্ট অনুতপ্ত আছি….এর এমনি শক্তি যে মনে করলে আমি যাঁকে ইচ্ছা বাঁধতে পারি, কিন্তু আনতে পারি নে।….এইজন্য আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়েছিলুম, আমি নিজে সঙ্গীতের কিছুই জানিনে যে তা নয়, কিন্তু আমি জানতাম যে তুমি মেঘ মল্লারে সিদ্ধ, তোমার গানে দেবী ওখানে আসবেনই, এলে তারপর মন্ত্রে বাঁধন। ….অনেকটা মন্ত্রের গুণ পরীক্ষা করবার কৌতূহলেই আমি এ কাজ করি।”

একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গুণাঢ্য যে কথা বলে তা অনেকটাই ছলনা মেশানো— “এখন আমার গুরুর কাছ থেকেই আসছি। তিনি সব শুনে একটা মন্ত্র শিক্ষা দিয়েছেন, এটা পূর্ব মন্ত্রের বিরোধী শক্তিসম্পন্ন। সেই মন্ত্রপূত জল দেবীর গায়ে ছড়িয়ে দিলে তিনি আবার মুক্ত হবেন বটে কিন্তু যে ছিটিয়ে দেবে, সে চিরকালের জন্য পাষাণ হয়ে যাবে।”

গুণাঢ্য ভালোভাবেই জানত এই কথাগুলি শোনার পর প্রদ্যুম্ন নিজে থেকেই দেবীকে মুক্ত করার জন্য পরবর্তী মন্ত্রপূত জলটি চাইবে কারণ সে তরুণ তার প্রাণে দয়া-মায়া-মমত্ববোধ এবং সর্বোপরি আত্মত্যাগের মানসিকতা আছে। তাই ছলনা করে প্রদ্যুম্নকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং প্রদ্যুম্নও এই ফাঁদে পা দিয়ে দেবীকে মুক্ত করে নিজে জড়তাপ্রাপ্ত হয়ে গেছে।

গুণাঢ্য নিজে প্রৌঢ় তার মৃত্যু হলে হারাবার কিছু হত না কিন্তু এই ধরনের ভোগী, লোভী রিপু দংশিত মানুষেরা সুযোগসন্ধানী হয় এবং অপরকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতেও পিছপা হন না। এই গল্পে তান্ত্রিক গুণাঢ্য অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু সেটি হীন চক্রান্ত ও ছলনাকে চরিতার্থ করার উপায় হিসেবে। তার সম্মোহনী কথা বলার শক্তিতে সে অচিরেই প্রদ্যুম্নের ক্ষতির কারণ হয় এবং দেবী সরস্বতীকেও বন্দিনী করে। প্রদ্যুম্ন স্বপ্নে হিংস্র মাছ এর মুখটা সুরদাসের মত দেখেছিল এবং সেই মাছ দেবীর পা ঠুকরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে দেখেছিল—এটা কতকটা ঠিকই কারণ দেবী সরস্বতীর বন্দিনী অসহায় অবস্থার জন্য গুণাঢ্য ওরফে সুরদাসই দায়ী এবং সে যে হিংস্র, লোভী, সুযোগসন্ধানী এক তান্ত্রিক তা গল্পটি পড়লেই স্পষ্ট হয়। বিভূতিভূষণের লেখনীতে গুণাঢ্য ওরফে সুরদাস এক আশ্চর্য সৃষ্টি।