‘মহানগর’ গল্পের প্রারম্ভিক বাক্য থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত ধ্রুবপদের মতো ‘মহানগর’ শব্দটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। এ-গল্পের মূল অবলম্বন এক বালকের বিষাদকরুণ জীবন-অভিজ্ঞতা। এই বালক তার দিদিকে হারিয়েছে, গ্রামের এক সরল, প্রাণবন্ত নারীকে অবস্থা বিপাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে কলকাতার কানাগলিতে। নাগরিক জীবনের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকের কথা গল্পের সূচনায় লেখক উল্লেখ করেছেন—’আমার সঙ্গে এসো মহানগরের পথে, যে-পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মতো, যে-পথ অন্ধকার, মানুষের মনের অরণ্যের মতো। মহানগরের ব্যাপক বিস্তার এবং আপাতগ্রাহ্য সম্পদ সমৃদ্ধি ও আলোকোজ্জ্বল দৃশ্যপটের অন্তরালে যেসব কালো ক্ষতস্থানগুলির সৃষ্টি হয়েছে, গণিকাবৃত্তি তাদের অন্যতম। ‘মহানগর’ গল্পের চপলা সেই আদিম বৃত্তির শিকার। তাকে খুঁজতে এসেছে তার অল্পবয়সি ছোট ভাই রতন। কিন্তু আমূল পরিবর্তিত দিদিকে খুঁজে পাওয়ার সার্থকতা রতনকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারেনি।
আলোচ্য গল্পের প্রথমদিকে রতনের অনুভূতিতে জানা যায়, চপলা তার দিদি। রতন গ্রামের ছেলে। শৈশবে সে মাকে হারায়। দিদিই ছিল তার মায়ের মতো। একসময় দিদির বিয়ে হয় পাশের গাঁয়ে। রতন মাঝেমধ্যেই দিদির কাছে গিয়ে থাকত। বাড়িতে আসতে চাইত না। একদিন খবর এল, দিদির বাড়িতে গোলমাল। কেন গোলমাল, তা রতনকে জানতে দেওয়া হয়নি। সেদিন রতনদের বাড়িতে দিদির শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছিল, থানা থেকে চৌকিদারও এসেছিল। রতন শুনতে পেল, দিদিকে কারা নাকি ধরে নিয়ে গেছে। ছেলেমানুষ বলে তাকে এসব ব্যাপারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এ সংবাদে রতন খুব কেঁদেছিল। সে অনুমান করেছে, যারা দিদিকে ধরে নিয়ে গেছে, তারা হয়তো তাকে খুব মারছে, হয়তো দিদিকে খেতে দিচ্ছে না। দিদিও হয়তো রতনকে দেখবার জন্য কাঁদছে। বাবাকে দিদির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেও রতন কোনো সদুত্তর পায়নি। বাবা তার কাছে দিদির ব্যাপারে কেন লুকোতে চান, তা বুঝতে না পেরে রতনের বড় ভয় হয়েছে। এরপর একদিন রতন শুনল যে, দিদিকে পাওয়া গেছে। দিনের পর দিন কেটে গেলেও দিদি কেন বাড়ি আসে না, রতন তা বুঝতে পারে না। দিদির ওপর তার রাগ হয়। একদিন সকালে সে দিদির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। কিন্তু সেখানে দিদি নেই। সেখানে কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। কাঁদো কাঁদো মুখে রতন সেদিন বাড়ি ফিরে আসে। বাবার কাছে দিদিকে ফিরিয়ে আনার কথা বলে ধমক খায়। রাত্রে সে চুপিচুপি শুধু দিদির জন্য কাঁদে। রতন যদি জানত, তার দিদি কোথায় আছে, তাহলে সে নিজে গিয়েই তাকে নিয়ে আসত। অবশেষে রতন একদিন কোথা থেকে জানতে পারে, তার দিদি থাকে শহরে, জায়গাটার নাম উল্টোডিঙি। এ-কারণে সে বাবার কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করে বাবার সঙ্গে নৌকোয় চেপে মহানগরে আসে। রতনের এভাবে শহরে আসবার লক্ষ্য একটাই—তার দিদিকে খুঁজে বার করা।
মহানগরের বিশাল অরণ্যে মৃত্তিকার স্নেহের মতো শ্যামল একটি অসহায় ছেলে রতন তার নিজের আকাঙ্ক্ষিত দিদিকে খুঁজে পাওয়ার আশা নিয়ে এসে পৌঁছয়। এ-প্রসঙ্গে লেখক বলছেন—যেখানে মানুষ নিজের আত্মাকে হারিয়ে খুঁজে পায় না, সেই মহানগর থেকে তার দিদিকে সে খুঁজে বার করবে। কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সহজ-সরল-স্বাভাবিক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গহন স্বপ্ন-সাধ-আশা-আকাঙ্ক্ষা জটিল ও বহুমাত্রিক মহানগরের যান্ত্রিক পেষণে পড়ে পিচ বাঁধানো তপ্ত রাস্তার ওপর পড়া কয়েক ফোঁটা জলের মতো মিলিয়ে যায়। নাগরিক লোভ আর অর্থের হাতছানির সাঁড়াশি আক্রমণে মানুষ তার মহৎ মনুষ্যত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের অন্তরাত্মার আবেগ-অনুভূতিকে অজান্তে হারিয়ে ফেলে সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য নাগরিক যন্ত্রমানবে পরিণত হয়। তারপর কোনো এক সময় সম্বিত ফিরলে জীবনের সেই গভীরতম সম্পদকে ফিরে পাওয়ার তীব্র আকুতি নিয়ে সে দূষণ জর্জরিত মহানগরের পথে পথে ঘুরে থাকে, কিন্তু নাগরিক অন্ধকারের ছোবল-চিহ্ন তার জীবনকে আর পূর্বেকার সারল্য ও শান্তির বাতাবরণ ফিরিয়ে দেয় না। মানুষের একান্ত প্রিয়জনও এই শহুরে কলুষতার অসহায় শিকার হয়ে ইট-কাঠ-পাথরের অরণ্যে হারিয়ে যায়। আলোচ্য গল্পের রতনের কাছে শহর আর তার দিদি একার্থক। বাড়িতে থাকতে সে ভেবেছে, শহরে গেলেই বুঝি দিদিকে পাওয়া যায়। মহানগরের বিরাট রূপ তার সেই ধারণাকে উপহার করেছে, কিন্তু তবু সে হতাশ হয়নি। রতনের শিশু-হৃদয়ের বিশ্বাস, তার দিদিকে সে খুঁজে পাবেই।
মহানগরের পথের অরণ্যে আর পাঁচজনের মতন রতন হারিয়ে যায় না। মহানগর তার চিহ্ন মুছে দিতে পারে না। পোনাঘাটে এসে তাদের নৌকো থামলে তার বাবা তাকে একটি কদম গাছের তলায় দাঁড়াতে বলেছিল। কিন্তু সেই আদেশ অমান্য করে রতন রাস্তার একটা দিক ইচ্ছেমতো ধরে এগিয়ে চলতে থাকে। পথে একজনকে উল্টোডিঙির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে সে জানতে পারে যে, সেই স্থান অনেক দূরে। তবুও রতন নির্ভীকভাবে দৃঢ়চিত্তে দিদির সন্ধানে এগিয়ে চলে। অবশেষে বিকেলের দিকে রতন সত্যিই দিদির খোঁজ পায়। একটি মেয়ে তার দিদির সন্ধান দেয়। রতনের দিদি চপলা থাকে একটা মেটে বাড়িতে। ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে এসে রতনকে দেখে চপলা চমকে যায়। নির্বাক রতনের কষ্ট হয় তার দিদিকে চিনতে। তার দিদির মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ভাই ও দিদি দুজনেই কিছুক্ষণ নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর চপলা ছুটে এসে তার প্রিয় ভাইকে বুকে চেপে ধরে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ধরা গলায় সে জানতে চায়, রতন একা এসেছে কিনা। আনন্দে-আবেগে সার্থকতায় রতন কিছু না বলে দিদির বুকে মুখ লুকিয়ে থাকে। গল্পের এই স্থানে এসে প্রেমেন্দ্র মিত্র মন্তব্য করেন যে, মহানগরের পথে ধুলো, আকাশে ধোঁয়া, বাতাসেও মনে হয় বিষ আছে। মানুষের আশা সেখানে কখনো কখনো পূর্ণ হয়। খুঁজতে থাকা বস্তুকে পাওয়া যায়। তবু বহুদিনের কামনার ফলও কেমন একটু বিস্বাদ লাগে। মহানগর সব কিছুকে দাগী করে দেয়, সার্থকতাকেও একটু বিষিয়ে দেয়।
মহানগরে দিদি চপলাকে খুঁজতে এসে রতন সার্থক হয়েছিল। তার এই সার্থকতা বা সাফল্য এসেছিল, অপ্রত্যাশিতভাবেই। কিন্তু দিদির অভাবনীয় পরিবর্তন দেখে সে তৃপ্ত হতে পারেনি। রতনের এই করুণ অভিজ্ঞতার স্বরূপটিকে বোঝাবার পূর্বে লেখক মহানগরের অনুষঙ্গ এনে সংক্ষেপে পাঠককে আগাম সচেতন করলেন মহানগরের সবকিছুকে দাগী করে দেওয়ার কথা বলে, সার্থকতাকেও বিষিয়ে দেওয়ার উল্লেখ করে। এরপর বোঝা যায়, গ্রাম্যবধূ চপলা নগরের গণিকায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি পাঠক বুঝলেও রতনের বুঝতে একটু সময় লাগে। নাগরিক পরিবেশে দিদির ঘরের সম্পদ, বিলাস সামগ্রী দেখে সে বিস্মিত হয়। সে সরল মনে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে চপলা কাতরমুখে বলে ফেলে—’আমার যে যাবার উপায় নেই ভাই’। রতন তখন তার পিছুটান, তার জন্য বাবার দুশ্চিন্তা—সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে বলে-‘আমিও তাহলে যাব না দিদি’। কিন্তু সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসে, মহানাগরিক অন্ধকারের অসহায় শিকার চপলা অস্থির হয়ে তার ভাইকে বলে—এখানে যে তোমার থাকতে নেই ভাই’। ক্রমশ রতন তার দিদির জীবনের পরিবর্তন এবং তার পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার অক্ষমতার কারণটিকে বুঝতে পারে। বড় হয়ে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রতন যখন ফেরার পথ ধরে, তখন ‘মহানগরের ওপর সন্ধ্যা নামে বিস্মৃতির মতো গাঢ়’।
এভাবে আলোচ্য গল্পের পূর্বাপর পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, মহানগরের অন্ধকার, পাশবিক জীবন গ্রামের মেয়ে চপলাকে ‘দাগী’ করে দিয়েছিল, পতিতাপল্লীর মেটে বাড়ির বিলাস-সামগ্রীর মাঝখানে সে নিজেও জীবন্ত পণ্যদ্রব্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। প্রিয়ভাই রতনের সঙ্গে তাই তার মিলন বিশুদ্ধ আনন্দময় ও তৃপ্তিপূর্ণ হতে পারল না। রতনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবার সাধ্য তার এই অভিশপ্ত দিদির নেই। অপরদিকে, মহানগরের কলুষ রতনের দিদিকে খুঁজে পাওয়ার সার্থকতাকেও বিষিয়ে দিল। রতনের শিশুমনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। স্বল্পকালীন এই করুণ অভিজ্ঞতায় পরিণত রতন বড় হয়ে ভবিষ্যতে তার দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প-বাক্য উচ্চারণ করে তখনকার মতন খালি হাতে বিদায় নিতে বাধ্য হল। সুতরাং এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, প্রশ্ন-উদ্ধৃত লেখকের মন্তব্যটি ‘মহানগর’ গল্পের ক্ষেত্রে সর্বাংশে প্রযোজ্য এবং সার্থকতার সীমাস্পর্শী।
Leave a comment