সাধারণভাবে নামকরণ ব্যাপারটিকে আলাতলঘু ও বাহ্য ব্যাপার বলে মনে হলেও সাহিত্যে নামকরণ বিষয়টি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আসলে সাহিত্যের শিরোনামের মধ্য দিয়েই রচনার মূল বিষয় বা ভাবটি পাঠকের নিকট আভাসিত হয়ে ওঠে। সাধারণত ছোটগল্পের বিষয়বস্তু অথবা নায়ক-নায়িকার নাম অনুসারে ছোটগল্পের নামকরণ হয়। আবার কখনো কখনো ছোটগল্পের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রধান বক্তব্য যা বিষয়কেই শিরোনামের মধ্যে আভাসিত করা হয়ে থাকে। ছোটগল্পের মূল বক্তব্য, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনদর্শনের গভীর প্রকাশ হয় বলেই সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে নামকরণের তাৎপর্য এত ব্যাপক। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ গল্পের বিষয়বস্তু -এক ছোট্ট বালকের মহানগরে হারিয়ে যাওয়া দিদিকে খুঁজে বের করবার কাহিনি। সেই বৃত্তান্তকে তুলে ধরা হয়েছে রতন নামের এক বালকের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। বালকের চোখে দেখানো হলেও ‘মহানগর’ আসলে নাগরিক জীবনের জটিলতা তথা পরিণত বোধের গল্প। এখন এই গল্পের নামকরণটি কতখানি সার্থকতায় মণ্ডিত হয়ে উঠেছে, সেটাই আমাদের আলোচ্য।

‘মহানগর’ গল্পের সূচনায় লেখক তাঁর সঙ্গে সেই মহানগরে যাওয়ার জন্য পাঠককে আহ্বান করছেন, যে-মহানগর আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো ছড়িয়ে আছে, আবার যে মহানগর উঠেছে মিনারে-মন্দিরচূড়ায় আর অভ্রভেদী প্রাসাদশিখরে তারাদের দিকে মানবাত্মার প্রার্থনার মতো। একই সঙ্গে লেখক মহানগরের জটিল, অন্ধকার পথেও পাঠককে আসতে বলছেন। তিনি মনে করেন— মহানগরের সংগীত রচনা করা উচিত—ভয়াবহ, বিস্ময়কর সঙ্গীত’। কঠিন ধাতু ও ইটের ফ্রেমে। লক্ষ জীবনের সুতো নিয়ে মহানগর বিশাল সূচিচিত্র নির্মাণ করে চলেছে। আলোচ্য গল্পে মহানগরের বৃহৎ, জটিল ও সামগ্রিক রূপ অঙ্কন করা লেখকের উদ্দেশ্য নয়। তিনি স্পষ্টভাবে এখানে জানিয়েছেন যে, তিনি কেবল মহানগরের একটুখানি গল্প বলতে পারেন। এ থেকে বোঝা যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র আলোচ্য গল্পের কেন্দ্রস্থলে মহানগরকেই স্থান দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।

মহানগর কলকাতার বহুমাত্রিক পরিচয় দেওয়ার পরেই লেখক এ-গল্পের নায়ক রতনকে মহানগরের পটভূমিতে স্থাপন করেছেন। নদী যখন মহানগরের নাগাল পেয়েছে, ভোরের আবছা আলোয় যখন নদীর দুধারে জাহাজ-স্টিমার আর বড় বড় কারখানার জেটিকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তখন নৌকোর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে রতন হালের কাছে তার বাবার পাশে বসে। নৌকো যখন মহানগরে পৌঁছয়, তখন সবিস্ময়ে রতন লক্ষ্য করে—’রূপকথার গল্পের চেয়ে অদ্ভুত সেই শহর’। মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করার আগে গল্পের প্রথমাংশে লেখক কলকারখানা, জাহাজ, স্টিমার এবং লোহালক্কড়ের প্রাচুর্যপূর্ণ মহানগরের এক হৃদয়হীন, কঠিন অবয়ব ও ভিড়ে ঠাসা জীবনের চিত্র এঁকেছেন। অল্পবয়সি রতন গ্রাম থেকে কেন শহরে এসেছিল, সেটা জানাবার পূর্বে লেখক মহানগর সম্বন্ধে বলেছেন যে, মহানগরের বিশাল অরণ্যে কত মানুষ কত কিছুর খোঁজে আসে—কেউ অর্থ, কেউ যশ, কেউ উত্তেজনা, কেউ-বা বিস্মৃতি। এরপর লেখক জানিয়েছেন যে, মৃত্তিকার স্নেহের মতো শ্যামল একটি অসহায় ছেলে রতন সেখানে এসেছে তার দিদির খোঁজে। যেখানে মানুষ নিজের আত্মাকে হারিয়ে খুঁজে পায় না, সেই মহানগর থেকে রতন তার দিদিকে খুঁজে বার করবে।

এভাবে আলোচ্য গল্পের ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছবার পূর্বে লেখক সযত্নে ও সচেতনভাবে মহানগরের জটিলতা সম্পর্কে পাঠকের মনে একটা ধারণা সৃজন করতে চেয়েছেন। উল্টোডিঙির পথে নেমে রতন যখন তার দিদিকে খুঁজছিল, তখনও এসেছে মহানগরের প্রসঙ্গ। লেখক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, নানান অভীষ্ট বস্তু খুঁজতে আসা মানুষেরা মহানগরের পথের অরণ্যে হারিয়ে যায়। মহানগর তাদের চিহ্ন মুছে দেয়। কিন্তু এ-গল্পে রতন হারিয়ে যায়নি। সে তার দিদিকে খুঁজে পেয়েছিল। হঠাৎ ভাইকে দেখে রতনের দিদি চপলা যখন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিল, তখন লেখক জানালেন যে, মহানগরের পথে ধুলো, আকাশে ধোঁয়া, বাতাসেও মনে হয় বিষ আছে। মানুষের আশা এখানে কখনো কখনো পূর্ণ হয়। খুঁজতে থাকা বস্তুকে পাওয়া যায়। তবু বহুদিনের কামনার ফলও কেমন একটু বিস্বাদ লাগে। মহানগর সবকিছুকে দাগী করে দেয়, সার্থকতাকেও একটু বিষিয়ে দেয়।

মহানগরে দিদিকে খোঁজবার জন্য রতন এসে পৌঁছবার পর আলোচ্য গল্প এগিয়ে চলতে থাকে মহানগরের পথ ধরে। রতনের কাছে দিদিকে খুঁজে পাওয়ার সাফল্য এসেছিল অপ্রত্যাশিতভাবেই। কিন্তু দিদির অভাবনীয় পরিবর্তন দেখে রতনের শিশুমন তৃপ্তি পায়নি। রতনের এই করুণ অভিজ্ঞতার স্বরূপটিকে বোঝাবার পূর্বে লেখক উপরিউক্ত মহানগরের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকের কথা সংক্ষেপে বলেছেন। অর্থাৎ বাবার নিষেধ অমান্য করে মহানগরের উল্টোডিঙিতে রতনের চলে আসা এবং দিদি চপলার সঙ্গে তার বিষাদ-করুণ মিলন যে মহানগরের মহাসমুদ্রের দু-একটি ঢেউ মাত্র, গল্পের প্রথমাংশে লেখক কথিত বক্তব্যের সঙ্গে গল্পের পরিণতির সেই সাযুজ্য পাঠক অনুভব করতে পারে। বোঝা যায়, গ্রাম্যবধূ চপলা অবস্থাবিপাকে পড়ে মহানগরের গণিকায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি পাঠক বুঝলেও অল্পবয়সি রতনের বুঝতে একটু সময় লাগে। নাগরিক পরিবেশে দিদির ঘরের সম্পদ, বিলাস-সামগ্রী দেখে সে বিস্মিত হয়। মাটির ঘরও যে এমন সাজানো-গোছানো হতে পারে, রতনের এই বিস্ময়সূচক অনুভূতির মাধ্যমে লেখক গ্রামীণ জীবনের সরল, সতেজ ও স্বাভাবিকতার পাশে মহানাগরিক জীবনের মেকি আবরণটিকে তুলে ধরেছেন। রতন সরল মনে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে চপলা কাতরমুখে বলে—’আমার যে যাবার উপায় নেই ভাই’। রতন তখন তার পিছু টান, তার জন্য বাবার দুশ্চিন্তা—সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে বলে— ‘আমিও তাহলে যাব না দিদি’। কিন্তু সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসে, মহানগরের অন্ধকারের অসহায় শিকার চপলা অস্থির হয়ে তার ভাইকে বলে—এখানে যে তোমার থাকতে নেই ভাই’। ক্রমশ রতন তার দিদির জীবনের পরিবর্তন এবং তার পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার অক্ষমতার কারণটিকে বুঝতে পারে। একবেলার অভিজ্ঞতাতেই সে যেন জীবন-সম্বন্ধে পরিণত বোধ অর্জন করে। বড় হয়ে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রতন যখন ফেরার পথ ধরে, তখন ‘মহানগরের ওপর সন্ধ্যা নামে বিস্মৃতির মতো গাঢ়’।

এভাবে আলোচ্য গল্পের পটভূমি এবং মর্মবাণীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে মহানগর কলকাতা। গল্পের প্রারম্ভিক বাক্য থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত ধ্রুবপদের মতো ‘মহানগর’ শব্দটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। স্পষ্টতই বোঝা যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র এ গল্পের প্লট নির্মাণে মহানগরের পটভূমির ওপরে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি এখানে মহানগরের বহুবিস্তৃত জীবনের একটা বিশেষ ক্ষতস্থান পতিতাপল্লীকে অঙ্কন করতে চেয়েছেন। রতনের দিদি চপলাকে মহানগরের এই ক্ষতস্থান ‘দাগী’ করে দিয়েছে, পতিতাপল্লীর মেটে বাড়ির বিলাস সামগ্রীর মাঝখানে সে নিজেও জীবন্ত পণ্যদ্রব্যে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রিয় ভাই রতনের সঙ্গে তাই তার মিলন বিশুদ্ধ আনন্দময় ও তৃপ্তিদায়ক হতে পারল না। রতনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবার সাধ্য তার এই অভিশপ্ত দিদির নেই। একান্ত ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কও যে মহানগরের জটিল, অমানবিক গোলোকধাঁধায় পড়ে কীভাবে মাটিতে পতিত কদমফুলের মতন খ্যাঁতা হয়ে যায়, ‘মহানগর’ গল্প তারই নির্মম ও বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সুতরাং আলোচ্য গল্পের নামকরণ হিসাবে ‘মহানগর’ যে সর্বাংশেই সার্থক ও সঙ্গতিপূর্ণ, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।