নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পটিকে চরিত্রভিত্তিক উপন্যাস বলা না হলেও এর মধ্যে একটিমাত্র চরিত্রকেই চিত্রিত ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে চরিত্রটি রাজাবাহাদুরের চরিত্র। আপাতদৃষ্টিতে রাজাবাহাদুর নিপাট ভদ্রলোক। তাঁর বদান্যতার তুলনা নেই। তিনি অতিথি বৎসল। অতিথি রূপে লেখক তাঁর বাড়ি গেলে তিনি লেখকের সঙ্গে চা পান করবেন বলে সকাল থেকে অপেক্ষা করে থাকেন। তাঁর নামে একদা লেখক একটি প্রশস্তি কাব্য লিখে দিলে তিনি লেখককে কোনো একটা উপলক্ষে সোনার ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। এই দানশীলতা, বদান্যতা রাজাবাহাদুরের চরিত্রের অন্যতম গুণ বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু রাজাবাহাদুরের এই গুণসম্পন্ন চরিত্র যে কেবলমাত্র মুখোশ তা বোঝা যায়, তাঁকে কাছ থেকে দেখার পর। লেখক তাঁর কাছে শিকারের সঙ্গী হতে এসে দিন তিনেক রাজাবাহাদুরের সঙ্গে ছিলেন। তাতে তিনি রাজাবাহাদুরের যে চরিত্র চিত্রিত করেছেন তাতে রাজাবাহাদুরের হিংস্র ক্রুর মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর দুটো চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, চোখ দুটো রক্তাভা ধারণ করে, একদৃষ্ট শূন্যপানে তাকিয়ে দাঁত চিপে তিনি যখন অস্ফুট স্বরে আস্ফালন করতে থাকেন তখন সামনে উপস্থিত ব্যক্তির বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। অর্থাৎ হাতে বন্দুক পেলে তিনি মনে মনে হিংস্র হয়ে ওঠেন। অথচ চারিদিকের সবুজ সতেজ পরিবেশের মধ্যে বসে তাঁর নিজেরই কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারার মানসিকতা প্রকাশ করে। কেন না, যিনি কবিতা লিখতে ইচ্ছে করেন তিনি কী করে হাতে বন্দুক পেলে হিংস্র হয়ে উঠতে পারেন। এখানে হয় তিনি কথার পিঠে কথা চাপিয়ে নিজের মাহাত্ম্য প্রচার করতে চাইছেন, নচেৎ নিজের ক্রুরতাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তবে তিনি নিজের দোষগুণ লোকের কাছে অনায়াসে ব্যক্ত করতে পারেন। তা শুনে কে কি ভাবল তা মনে করার অবকাশ তাঁর নেই। অর্থাৎ তিনি নিজের মতে চলেন—এক অর্থে তিনি স্বেচ্ছাচারী। অর্থের দত্তে তিনি নিজে সকলের বিচারকর্তা অথচ নিজের দোষ দেখতে পান না। বন্দুক হাতে নিলেই যে কোনো ধরনের শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁর চোয়াল এমন শক্ত হয়ে ওঠে যে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় হয়। তিনি মদ্যপান শুরু করেছেন চোদ্দ বছর বয়স থেকে রাজারাজড়াদের এসব কোনো ব্যাপারই নয়। কিন্তু নিজে মদ খেলেও লেখককে তিনি মদ খাওয়ার জন্য জোর করেননি। সঙ্গে ও সামনে বসিয়ে গল্প করতে করতে নিজেই মদ খেয়েছেন। নেশা জমে উঠলেও তাঁকে মদ্যপানের জন্যে জোর করেননি। শিকারে গিয়ে সারারাত অপেক্ষা করে শিকার না পেয়ে তিনি ভাগ্যের দোষ দিলেও তাঁর ক্রোধের শিকার হয় এক হায়না। কিন্তু নিজের আভিজাত্য বজায় রাখার জন্যে সেই হায়নাকে অরণ্যেই ফেলে আসেন তিনি। অর্থাৎ শিকারের মধ্যে তাঁর যে বীরত্ব, হিংস্রতার নিদর্শন তিনি জনসমক্ষে তুলে ধরতে চান, সেখানে কোনো ছোটোখাটো পশুর স্থান নেই। তাই তাঁর লাউজ্বের দেওয়ালে সাজানো থাকে দাঁতাল হাতির মাথা, বাঘ, ভালুকের মাথা। কিন্তু হায়নার স্থান সেখানে নেই। হায়ানারা তাঁর নিষ্ফল ক্রোধের শিকার।

নিজের কৃতিত্বের নিদর্শন ও প্রমাণ অন্যের কাছে জাহির করা তাঁর প্রবল বলেই, লেখক চলে যেতে চাইলে তিনি বিরক্ত হয়ে ওঠেন এই ভেবে যে, লেখক বুঝি তাঁর শিকারের নিদর্শনগুলিকে ‘ফার্স’ বলে মনে করেছেন। তাই আর একটা রাত্রি থাকার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন—আগামীকাল লেখককে এখানে রাখা আর সম্ভব হবে না।

সে রাত্রে রাজাবাহাদুর মাছ শিকারের নাম করে মস্ত একটা রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন। কিন্তু শিকার যত বড়োই হোক, সে শিকারের চেয়ে রাজাবাহাদুরের হিংস্রতা অতি ভয়ঙ্কর রূপে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিজের কীর্তির ধ্বজা ওড়ানোর জন্যে একটা মানব শিশুকে শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। বাংলোর কীপারের কাছে মানুষ হতে থাকা পিতৃমাতৃহীন যে শিশুটিকে সকালে তিনি আদর করেছেন, পকেট থেকে পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে শিশুদলের কাড়াকাড়ি করে পয়সা কুড়ানোর ভঙ্গি দেখে মজা পেয়েছেন, অন্যান্য দিনেও লাউঞ্জের উপর থেকে রুটির টুকরো ফেলে দিয়ে যে শিশুর কাড়াকাড়ি করে খাওয়া দেখে তিনি মজা করেছেন, সেই শিশুটিকেই তিনি বাঘ শিকারের জন্য টোপ করেছিলেন। লেখকের মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে রাজাবাহাদুরের হিংস্রতা—“কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে যদি জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়। তাতে কারও ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রকাণ্ড রয়্যাল বেঙ্গল মেরেছিলেন রাজাবাহাদুর-লোককে ডেকে দেখানোর মতো।” অর্থাৎ নিজের কৃতিত্ব জারি করার ব্যাপারে একটা মানুষের প্রাণ, একটা শিশুর কান্না তাঁর কাছে বড়ো নয়। এ যে রাজাবাহাদুরের হিংস্র, নৃশংস মনোভাবের পরিচয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আলোচ্য গল্পটির মধ্যে যদিও রাজাবাহাদুরের চরিত্রচিত্রণই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, তব কাহিনি বিন্যাসকালে রাজাবাহাদুরের চরিত্র আপনা আপনি চিত্রিত হয়ে গেছে। তা থেকে রাজাবাহাদুরের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাতে তিনি বনেদী জমিদার হবার জন্যে অর্থ সম্পদে পুষ্ট হলেও বদান্যতা, ভদ্রতা বজায় রেখে বিনয়যুক্ত কথা বলায় অভ্যস্ত। কিন্তু রাজারাজড়ার মতো তিনিও হিংস্র, ক্রুর, নৃশংস। তাঁর নৃশংসতার প্রতিবাদ করলে অতিথির বুকে পর্যন্ত বন্দুক ঠেকাতে তিনি দ্বিধা করেন না। আবার যাকে শিকারের সঙ্গী করেন তার জন্যে ভেট পাঠাতেও তিনি ভুল করেন না। সব মিলিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আলোচ্য গল্পে রাজাবাহাদুরকে দোষেগুণে পূর্ণ একজন মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলেছেন, যে মানুষকে গড়ে তুলেছে প্রকৃতি—লেখক যাঁকে গড়ে তোলার প্রয়াস সাধন করেননি। ‘টোপ’ গল্পের রাজাবাহাদুর তাই হয়ে উঠেছে নির্ভেজাল এক কঠিন বাস্তব চরিত্র।