‘যেন মূল ও শিকড় সমেত চারাটা আমার হাতে উঠে আসতে তৈরি হয়েছিল।’- কোন্ প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে? কথাটির মধ্যে কোনা গূঢ় তাৎপর্য আছে কি?

জোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ গল্পটি আসলে বর্তমান সমাজের শ্রেণিসম্পর্কের সংকেতকেই বহন করেছে কথাবস্তুতে। গল্পের কথক মিন্টু গল্পের সূচনাতেই তাদের বাড়ির রান্নাঘরের পিছনের ছাইগাদায় একটি চারাগাছ এনে পুঁতেছিল। এই সরু লিকলিকে পেঁপে চারাটা ছিল স্কুলে যাবার রাস্তার ধারের নর্দমার পাশে। স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় মিন্টু চারাটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে আসে। মাটি থেকে তুলতে চারাটি কিন্তু একটুও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, একটা শেকড়ও নষ্ট হয় না। আশ্চর্য হয়ে গাছটার এই অনায়াস উঠে আসা প্রসঙ্গেই মিন্টু প্রশ্নে উদ্ধৃত কথাগুলি ভেবেছে।

কথাটি সাধারণ বিবরণের মতো উচ্চারিত হলেও লেখক কথাটির মধ্য দিয়ে এক গভীর গূঢ় সংকেত সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। বিত্ত ও ক্ষমতার দিক থেকে বহুস্তর বিভক্ত—এই সমাজে উচ্চস্তরবর্তীরা সর্বদা নিম্নস্তরবর্তীকে বঞ্চিত করে শোষণ করে। কিন্তু সাময়িক ক্ষোভের জন্ম হলেও এজন্য কোনো শ্রেণিবিপ্লবের চেতনা এখানে সহজে জাগ্রত হয় না। নিম্নস্তরবর্তী মানুষেরা সর্বদাই যেন উচ্চস্তরের সুখভোগ স্বাচ্ছন্দ্যের স্বইচ্ছায় উচ্চবর্গের কৃপালাভের জন্য তৎপর হয়ে থাকে। পেঁপে গাছটি নর্দমার ধার থেকে মধ্যবিত্তের ছাইগাদায় স্থানলাভের জন্য যে তৈরি ছিল বলেই মনে হয়। পেঁপেগাছটি এখানে যেন মদন চরিত্রেরই প্রতীক হয়ে ওঠে। মদন ও সুকুমারদের কাছে বিতাড়িত হয়ে অনায়াসে মিন্টুদের বাড়ি ঠাই করে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে। আবার যেই সে সুকুমারদের বাড়িতে পুনর্বহাল হবার সুযোগ পায়, তখন একই রকম অনায়াসে সে মিন্টুদের বাড়ির মায়া ত্যাগ করে সেখানে চলে যায়। তাই পেঁপেচারাটির প্রসঙ্গ এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সংকেত বহন করেছে।

‘তাছাড়া আমাদের পিছনটা তো ফাঁকা, পোড়ো মাঠ। মানুষের মুখ দেখা যায় না। আব্রুর দরকার পড়ে না।’—কে কাকে বলেছিল? প্রসঙ্গটি কী? কথাটির কোনো তাৎপর্য আছে কী?

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ গল্পটি আধুনিক সমাজসম্পর্কের জটিলতা ও শ্রেণি চরিত্র বিশ্লেষণমূলক গল্প। গল্পে তিনটি শ্রেণির অস্তিত্ব স্পষ্ট। উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি সুকুমাররা। মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রয়েছে গল্পকথক মিন্টুদের পরিবার এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি চাষীঘরের ছেলে শ্রমজীবী কিশোর মদন। রাস্তা থেকে তুলে আনা একটি পেঁপেগাছ মিন্টু তাদের রান্নাঘরের পিছনের ছাই গাদায় পুঁতে ছিল। কিন্তু ডুমুরগাছের ছায়ায় চারাটি ভালো বাড়তে না পারায় মদন সেই ডুমুর গাছের বড় বড় কতগুলো ডাল কেটে ফেলে। মিন্টুর মা প্রশ্নে উদ্ধৃত কথাগুলি বলেছিলেন।

‘চোর’ নাটকীয় চমকহীন, ঘটনাহীন বিবরণধর্মী গল্প হলেও গল্পটির মধ্যে অনেক সংকেতধর্মিতা আছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানসিক বৈশিষ্ট্য এখানে সংকেত বা প্রতীকের মধ্য দিয়ে উপস্থাপিত। যেমন মদনের শ্রেণিচরিত্র সংকেতিত হয়েছে পেঁপে গাছের প্রতীকে, তেমনি মধ্যবিত্ত রক্ষণশীলতার প্রতীক বোধহয় ডুমুর গাছ। মিন্টুর বাবা বাড়ির আব্রু রক্ষার জন্যই ডুমুর গাছটির প্রয়োজন অনুভব করেছেন। কিন্তু মিন্টুর মায়ের বক্তব্যে বোঝা যায় যে, এই রক্ষণশীলতা বা আব্রু প্রায় অর্থহীন। মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিরই কোনো পূর্বাপর ঐতিহ্য নেই। ঔপনিবেশিক শাসনেরই অনিবার্য ফল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ইংরাজ শাসকের কৃপায় কেরানী-বৃত্তির সুযোগলাভের মধ্য দিয়েই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। তাই পশ্চাদবর্তী ঐতিহ্যই যেখানে নেই, সেখানে রক্ষণশীলতাও অবান্তর। যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে মানিয়ে চলাই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক–মিন্টুর মায়ের কথায় এই ব্যঞ্জনাই সম্ভবত প্রকাশ পেয়েছে।

‘মদন পেঁপে চারাটা চুরি করে নিয়ে যায় নি।…..পেঁপেচারাটাই মদনকে আমাদের বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে। কেবল মদনকে না, আমাকেও … —উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘চোর’ গল্পের প্রায় শেষাংশে লেখক পেঁপেচারাটিকে প্রায় প্রতীকী তাৎপর্যে উপস্থাপিত করেছেন। নর্দমার পাশ থেকে মিন্টু পেঁপে চারাটিকে সংগ্রহ করে নিজেদের বাড়ির ছাইগাদায় পুঁতেছিল। মদনও অসহায় বিতাড়িত অবস্থা থেকে, স্থান পেয়েছিল মিন্টুদের বাড়িতে। পরে মদন সুকুমারদের বাড়িতে পুনর্বহাল হয়ে মিন্টুদের কাজ অনায়াসে ছেড়ে দেয় এবং একদিন মিন্টুর সাধের পেঁপেচারাটি চুরি করে। নিয়ে গিয়ে সুকুমারদের বাড়িতে পৌঁতে। কিছুদিন বাদে মিন্টুর সঙ্গে সুকুমারের ঘনিষ্ঠতা হবার পর একদিন মিন্টু আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করে যে, সে নিজেও সুকুমারদের বাড়ির বিলাস-বৈভব, ভোগ-সুখের সাজানো জগৎটার প্রতি মনে মনে ভূষিত হয়ে পড়ছে। নিজের মায়ের শীর্ণ রুগ্ন হাতের স্নেহমিশ্রিত যত্নের অকৃত্রিমতা ছেড়ে সুকুমারের মায়ের সুডৌল ফর্সা হাতে কাটা ফল-মূল-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ণের জন্য তার মনে একটি অপেক্ষা যেন জেগে থাকে। অর্থাৎ মদনের মতো সে নিজেও ঐ উচ্চতর স্বপ্নের জগৎটির মোহপাশে বন্দী হয়ে পড়ছে। উচ্চতর বিত্তের ঐ সোনালী জগতের হাতছানিরই প্রতীক হিসাবে লেখক নধর পেঁপেগাছটিকে এখানে ব্যবহার করেছেন। সেই পেঁপেগাছ বা বিত্তের ভোগ-সুখের মোহ নিম্নবিত্ত মদনকে তো হরণ করেই, মধ্যবিত্ত মিন্টুকেও তা নিঃশেষে হরণ করে।