কৃষাণ চন্দর বহু প্রশংসিত, ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপে রক্তস্নান করেছে বারবার, নব্বই শতাংশ জুড়ে সেই নরকীয় জিঘাংসার বর্ণনায় বিদীর্ণ। গল্পটি ওখানেই শেষ হলে নিছক ‘time’-কে ধরে রাখার “time-pass” হত। গল্পের শেষে আছে বিভীষিকাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দেওয়া সেই ট্রেনের আগামী দিনের স্বপ্ন—“আমার সে নবযাত্রা কী অপরূপ।……সেখানে হিন্দু মুসলমান বলে কেউ নেই। আছে কেবল মানুষ। প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি”। কী আশ্চর্য, ‘আদাব’ তেমনি নামেমাত্র মাঝির জীবনকে দাঙ্গার যূপকাঠে বলি নিয়ে মানবতাকেই স্বাগত জানিয়েছে, বলেছে “আসি”,—আদাব।”
বীভৎস নরক সে সময় যেন। রাজনীতির বিষবৃক্ষ সারা দেশ আগুন লাগল ১৯৪৬ এর দাঙ্গায়। মানুষ পশুতে পরিণত হল, পুলিশের বুটের তলায় মরতে থাকে হানাহানিতে মুমূর্ষু দুই জাতির সাধারণ মানুষ। সেই বাস্তবের ঠিকানা, ‘আদাব’। একে অপরকে দেখে সন্দেহের চোখে—আল্লাহ আকবর কী ‘বন্দেমাতরম’। যুযুধান দুই পক্ষ—দুভাই হিন্দু মুসলমান। সেই বাতাবরণকে আশ্চর্য দক্ষতায় রূপ দিয়েছেন লেখক গলিতে দু’টি অপরিচিত জীব তখন প্রায় মুখোমুখি—“স্থির চারটে চোখের দৃষ্টি ভয়ে সন্দেহে উত্তেজনায় তীব্র হয়ে উঠেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। উভয়ে উভয়কেই ভাবছে খুনি। চোখে চোখ রেখে উভয়েই একটা আক্রমণের প্রতীক্ষা করতে থাকে।” এরপর দাঙ্গা নয়, নরকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয় জীবন—দুটি ভিন্ন জাতির দুটি মানুষ।
মরণাগ্নির দিনে জীবনের শপথ নেয় মুসলমান মাঝি আর হিন্দু সুতা মজুর। পুঁটলিতে অস্ত্র থাকার সন্দেহ মিটে যায় অচিরেই। পাশাপাশি বসে যেন দুটি সহযোদ্ধা—দাঙ্গার রাজনীতির প্রতি খড়ড়্গহস্ত বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর দুটি বিবেক। “…..আমি জিগাই মারামারি কইরা হইব কী ? তোমাগো দু’গা লোক মরব, আমাগো দুগা মরব। তাতে দ্যাশের কী উপকারটা হইব।-আরে আমিও তো হেঁইকথাই কই। হইব আর কী, হইব আমার এই কলাটা—হাতের বুড়ো আঙুল দেখায় সে।” তবু তো মানুষ মারে মানুষকে কেন—দুজনেই অনুভব করে।
—“মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্চা হইয়া গেছি, নইলে এমুন কামড়া-কামড়িটা লাগে কোয়?”
বিবেকের এই জাগরণ, মেকি সভ্যতার মুখোশ খুলি দেওয়া ওই চার চোখের দৃষ্টি ১৯৪৬-এর কঙ্কাল দেখিয়ে দেয়। জয়ী হয় সম্প্রীতি, কাছে আসে জাত-ভুলে যাওয়া দুটি মানুষ। নাৎসী-ইহুদি জাতিদাঙ্গায় লিখিত পাউল সেলানের ‘টেনব্রে’ কবিতায় মানব হৃদয়ের বিক্ষত বন্দনা— The blood and the image that was in blood, Lord, Pray Lord, We are near”
রক্ত আর রক্তের সম্পর্ক নিকটে আসে—রক্তাক্ত হানাহানি মুছে যায়। মাঝে মাঝে ছড়িয়ে যাওয়া সন্দেহের বীজ জেগে ওঠে, তবে সম্প্রীতিই জয়ী হয়। গলিতে তাই মুসলিম ভাই পথ দেখায় হিন্দু সুতা মজুরকে। তারা তো বিদ্বেষ চায়নি— “কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ কোত্থেকে বজ্রপাতের মতো নেমে এল দাঙ্গা। এই হাটে বাজারে—দোকানে এত হাসাহসি, এত কথা কওয়া কওয়ি—আবার মুহূর্ত পরেই মারামারি কাটাকাটি—একেবারে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিল সব।” ভাবে আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দু’জনে। মানবিকতার জাগরণ এখানেই। ঈদে যোগদানের নেশায় মৃত্যুফাঁদে পা দেয় মাঝি, দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে হিন্দুর। রাস্তায় নিশ্চিত মৃত্যু তবু উৎসবের টানে মাঝি যাবেই, তখন ‘সুতা মজুরের বুকের মধ্যে টন্টন্ করে ওঠে ….
“—যদি তোমায় ধইরা ফেলায়। ভয়ে আর অনুকম্পায় তার গলা ভরে ওঠে।” মাঝি যেতেই—“উৎকর্ণ হয়ে রইল সে ভগমান—মাঝি য্যান বিপদে না পড়ে।” তার আগে বিদায় বেলার মাঝিও সুতা মজুরকে বলে “যাই।……ভুলুম না ভাই এই রাতের কথা। নসিবে থাকলে আবার তোমার লগে মোলাকাত হইব। আদাব।
—আমিও ভুলুম না ভাই—আদাব”।
এই “আদাব” রাখী বাঁধনের আদাব—দাঙ্গা নয়, রক্ত নয়, ঘৃণায় নয়—মানুষে মানুষে সম্প্রীতির “আদাব”। দুটি ‘জাতি’র দুটি ‘মানুষ’ হওয়ায় ‘আদাব’। গল্পের শেষে বউ ছেলের চোখের জল চোখে নিয় মৃত্যু হয় মাঝির।
জীবনের জন্য এই বিভেদহীন আকুতি, মৃত্যুর নিসর্গে ভেদসর্বস্ব হত্যাসর্বস্ব রাজনীতিকে নামহীন মাঝি-মজুর। ‘আদাব তাই ১৯৪৬-এর সময়েই ‘আমন’ এর ডাক দেয়। তাই ‘আদাব’ সম্প্রীতির মন্ত্রের—মনুষ্যত্বের বিকাশের জীবনের উদ্বোধনের সার্থকনামা সৃষ্টি। দুটি মানুষের ‘আদাব’ জানানোর রূপটি শঙ্খ ঘোষের কবিতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়—
“সেখানে দাঁড়িয়ে যারা ছিন্নভিন্ন পক্ষাঘাত থেকে
চন্দ্রগরিমায় দিকে বাড়াবে অশোক হাতগুলি
তারা কেউ এরা নয়—হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়
মানুষই তখন গান, মানুষই তখন ব্রুবাদুর।”
(গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ : ২৫–শঙ্খ ঘোষ)
Leave a comment