সমালোচক গল্পে যে রীতির বিবর্তন ঘটেছে আজকের মনুষ্য সমাজ তথা সংসার জীবনের প্রকট ব্যধিস্বরূপ। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি বাবা মায়ের লক্ষ্য থাকে তাদের সন্তানকে অনন্য রূপে গড়ে তোলা। সময়ের তালে তালে পা ফেলে চলতে কারুর স্বপ্ন সার্থক হয় আবার কারুর ব্যর্থ হয়। যারা সার্থক হয় তাদের অধিকাংশের মধ্যে ধূমায়িত হতে থাকে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা। সন্তান দামি, উচ্চ পদমর্যাদাধারী, নামজাদা হয়ে ওঠে। গর্বে বাবা মায়ের বুক ভরে যায়, স্বপ্ন দেখে এবার বুঝি সন্তানের ওপর সংসারের দায়িত্ব অর্পণ করতে নিষ্কৃতি পাবে। কিন্তু ফল হয় উলটো, যোগ্য সন্তান তাদের স্বপ্নকে আশাকে কোনো মর্যাদা দিতেই চায় না, সবক্ষেত্রে না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনটি দৃষ্টি হয়। আলোচ্য গল্পে তেমনই লক্ষণ সুপরিস্ফুট।

গল্পের শুরুতেই পিতা তার যোগ্য পুত্র সম্পর্কে স্বীকারোক্তি পেয়েছে—“রুণু। আমার পুত্র রুণু। কিছু বললেই আমাকে অপমান করতে চায়। পদে পদে প্রতিক্ষেত্রে। তাচ্ছিল্যের অপমানে মনে হয়, এ সংসারে আমি ভাববাহী পশুমাত্র। আমার বিদ্যা, বুদ্ধি, সাংসারিক দায়িত্ব, আমার অতীত-সব কিছুতেই ওর তীব্র শ্লেষ…..।” অবশ্য এক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী সন্তানের পক্ষ নেয়। অর্থাৎ সংসারে প্রত্যেকটি প্রাণীর মধ্যে দুজনেই তার বিপক্ষে। তবে যতটা সম্ভব মানিয়ে চলার ব্যবস্থা করে তিনি বলেছেন স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে—“নিজের দেহ কেটে রক্ত ঢালছি এদের সুখের জন্য। ব্যর্থ স্বামী হিসেবে গঞ্জনা, পিতা হিসেবে অভিযোগ মুছে ফেলার জন্য।” কিন্তু সর্বদা তার সকল স্বপ্ন ব্যর্থ হতে থাকে। এ এক বিষম জীবন যন্ত্রণা।

প্রতি পদে পদে রুণু তার বাবাকে ব্যঙ্গ করে অর্থাৎ প্রাচীনতার কোনো দাম নেই তার কাছে। অথচ সে ষ্টার পাওয়া ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে, বি.এস.সি. পাস করে রুণু নিজের সামর্থ্যেই যখন রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনে পরীক্ষা দিয়ে এক্যাউন্ট ক্লার্কের চাকরিটি হাতে পায়, বাবা ভেবেছিল তার দীর্ঘ ঘানি টানার দিন বোধ হয় শেষ হল। জয়েন করার পর, বাবা ভেবেছিল, এবার বুঝি তার চিররুগ্না মেয়ে রঞ্জনার বিয়ে দিতে পারবে। “অপূর্ব সুন্দরী। ঠকিয়ে হয়তো বিয়ের বাজারে চালিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু ওর প্রাণের সংশয় হত।” তাই রঞ্জনার বিয়েটা আপাতত বন্ধ আছে। সিদ্ধান্ত হল রঞ্জনার বিয়ে নাইবা দেওয়া হল, অবসরের থেকে টাকাটাই ফিক্সড করে দেবে ওর নামে।

ভালোয় মন্দোয় যুক্তিতর্কে দিনগুলি বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ রেখা বোস রুণুর চাকরির চার মাস না যেতেই সে চাকরিতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। বাবা অথৈ জলে পড়ে…কেন ছেলে চাকরিতে যাচ্ছে না, ছেলে বাবাকে ধমক দিয়ে বলে অফিসের আইনকানুন তুমি কী বোঝ ? বাবার ছেলের এমন মতদ্বন্দ্বে কেমন দ্বন্দ্বে পড়ে যায় ড. গাঙ্গুলী। তিনি কর্তাকে সংযত থাকতে বলেন। জানিয়ে দেন জেনারেশন গ্যাপটা বোঝা দরকার। কাজেই ড. গাঙ্গুলীর নির্দেশমতো কর্তাকে নীরব হতে হয়। কিন্তু প্রতিক্ষণে আশায় বুক বাঁধতে থাকে, আজ বুঝি তার ছেলে রুণু অপিস যাবে। কিন্তু সে আশাও নিষ্ফল করে রুণু দিব্বি ঘুরে বেড়ায়।

“আমার বয়স এখন চৌষটি।৪২-এ ম্যাট্রিক পাস করে অর্থ উপার্জনের জন্য পড়াশোনা আপাতত বন্ধ করে নানা জীবিকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। হেড ইঞ্জিনিয়ারের সহকারি থেকে শুরু করে ট্রামের কণ্ডাকটারি—সবকিছু। কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম অধিক বয়সে….” গ্রামের ছেলে কলকাতাকে তার ভালো করে জানা ছিল না। প্রতিটি শহরের রাস্তায় মিটিং মিছিল, রাজনীতি শ্লোগান। তার সত্ত্বেও অতি সংযত জীবনে চাকরি ও সংসারের এ দুটোর বিশেষ প্রয়োজন, কাজেই তাকে জীবিকার তাড়নে সুদূর গ্রামাঞ্চলে পাড়ি দিতে হয়েছিল স্কুল মাস্টারি নিয়ে। কিছুদিন পর বিয়ে, একটু বেশি বয়সে। বিয়ের পরের মানচিত্র ছিল—“আমার কাছে এসে পুতুলের কল্পনার রাজ্য ভেঙে টুকরো হয়ে গেছল, যেন তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে, ভাগ্যের গাফিলতির প্রধান লক্ষ্য আমি হয়ে গেলাম। মুখ ফুটে বলেনি কোনোদিন ….মনের বাহনে নীরব অসন্তোষের মেঘ জমেছিল।”

দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে কর্তার বিশেষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় “আমার ভাগ্যে জুটেছে অভিযুক্ত হওয়া, আর অযোগ্যতার ভূষণ। ছেলে রুণু যখন তাকে অপমান করে, তাতেও সুর মেলায় নিজের সহধর্মিণী। বাপের ওপর সন্তানের আক্ষেপের শেষ নেই। বাবা হয়ে কী না করেছে তার জন্য, অথচ রুণু সর্বদা বলে কী করেছ আমার জন্য ?” বাবা যখন জানায় তাকে মানুষ করতে তার যত পরিশ্রম। রুণু ব্যঙ্গ করে বলে—“আমার জন্য বোঝা টানছ ? তুমি একটা ইডিয়ট লায়ার। পচা সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য দিনরাত খেটে মরছ।”….সার্জারি করব। তোমাদের মতো পচা রক্ত বাদ দেব। তোমরা হলে জনগণের প্রকৃত শত্রু। বাবার বুঝতে বাকি থাকে না, সারা জীবন সে বোধ হয় কাটিয়ে এল ভুতের বেগার খেটে।

গল্পের আঙ্গিকে বৈচিত্র্য সাধনে লেখক এবার ভিন্ন ভাবের সমাবেশ ঘটালেন—“গাছের কঙ্কাল ডালে স্টিলের চক্ষু নিয়ে কাকটি বসেই আছে। আলোক ঝিলিক মারে। রক্তপিপাসু দৃষ্টি নিয়ে মাঝে মাঝে ডানায় ঘষে চত্রুটি তীক্ষ্ণতর করছে। বস্তুত কাক তার সুতীক্ষ্ম চঞ নিয়ে কী করতে পারে, তার অবস্থান তো গাছের মরা শুকনো ডাল, বিসদৃশ ঘটনা। তথাপি মূল ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্য প্রদর্শনে লেখক জানালেন পিতার স্বপ্ন রঙিন কল্পনা কী কাজে লাগতে পারে। সমাজ যে আজ পচা গলিত, নর্দমার স্বরূপ, স্বার্থপরতা শৃঙ্খলে বাঁধা স্ত্রীপুত্র পরিজন সবাই পাওয়ার নেশায় পর হয়েছে। রঙিন কল্পনা এখানে নিষ্প্রয়োজন, কেবল কাকের স্টিলের চটি রোদ্দুরের চকচক্ করার মতো কল্পনাটি সুখ দেবে আনন্দ দেবে, বাস্তবে কোনো ফল দেবে না, সমাজ সংসার আজ এমন ভাঙনের মুখে, যার প্রতি নিঃশ্বাসে শুধু সর্বনাশের ছায়া। অপত্য সেই এখানে শত্রুতায় পর্যবসতি।