জীবনানন্দ দাশ একটি নিদারুণ অবক্ষয়িত যুগের সেরা রূপকার। সংশয়াপন্ন দিশাহীন যুবক-যুবতীদের মানস-প্রতিভূ। বলা যায় এক বিমূঢ় যুগের সর্বাপেক্ষা বিভ্রান্ত কবি তিনি। জীবনের কোথাও তিনি কোনো বিশ্বাস বা সান্ত্বনা খুঁজে না পেয়ে, সুপ্রাচীন অতীত থেকে বর্তমান পৃথিবীর জীবনসমুদ্র মন্থন করে শুধু হলাহলই পেয়েছেন। আর সেই হলাহলকে আকণ্ঠ পান করে গভীর বিষণ্ণতা ও যন্ত্রণায় ব্যথিত হয়েছেন। জীবনের অজস্র অসঙ্গতির মধ্যেও তিনি ঐক্য খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তার ফল রয়েছে ব্যর্থ পরিশ্রম ও জরাগ্রস্ত ক্লান্তির মধ্যেই নিবদ্ধ। জীবনানন্দের দৃষ্টিতে এই যুগটি ছিল বন্ধ্যাযুগ। ব্যক্তিগত জীবনের আর্থিক দায় এবং অর্জনের ব্যর্থতা কবির চিত্তে নিয়ে এসেছিল চরম নৈরাশ্য। আত্মগত আমির এই নৈরাশ্য ও অসফলতার বোধ ঘনীভূত হয়েছে বিশ্বজোড়া মন্দা ও নানা আর্থ সামাজিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরাধীনতার যন্ত্রণা, নির্মম দমন পীড়নের চাপা আবহ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিপুষ্ট রাষ্ট্রগুলির দাদাগিরি মানুষকে ক্রমশই এক বিচ্ছিন্ন ও বিপন্নতার আবিলতায় নিমজ্জিত করছিল। সময়ের এই প্রবল অভিঘাতে একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধে সংবেদনশীল কবিচিত্ত ক্রমশই আটকে পড়ছিল। এই সময়কার নানা লেখা, চিঠিপত্র, পাণ্ডুলিপিতে পৃথিবী ও জীবন সম্পর্কে বীতস্পৃহ কবির এক বিভ্রান্ত বিমূঢ় আত্মনিগ্রহপ্রবণ ব্যক্তিচিত্তের পরিচয় পাওয়া যায়।

বিশ্বজোড়া বিচ্ছিন্নতার বোধ, আগুয়ান সংকটের গাঢ় তমিস্রা শুধু কবিকে নয় মননশীল মানুষদেরও ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিতে থাকে। ক্রমশ তারা গাঢ় অবসাদে আচ্ছন্ন হতে থাকে। জীবনের সহজ অভিধায়, গতানুগতিক জীবন ধারণের মধ্যে এই সমস্ত মানুষরা আর আনন্দ পায় না। জীবনে সুখ-শান্তির অভিধান তাদের কাছে ছেঁড়া কাগজের মতো উপেক্ষিত। অসহনীয়তার এই বোধ, অর্থহীন বেঁচে থাকার মতো করে তাদের মন-বুদ্ধি -আত্মাকে ভ্রংশ করে ফেলে। তাদের সামনে সঙ্কটকে উপলব্ধি করবার মতো কোনো ভবিষ্যদৃষ্টি নেই, অন্যের জীবনে শান্তি ও সুষ্ঠু চেতনা সম্পাদনের জন্য উদার অন্তঃকরণ নেই। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে কবি জীবনানন্দ অনুভব করেছিলেন নাগরিক জীবনের ক্লেদাক্ত সমীকরণ তত্ত্বটিকে। মাটির বুকে বেড়ে ওঠা সহজ মানুষ পৃথিবীতে দুর্লভ হয়ে গেছে— এমনটাই জেনেছিলেন কবি। ছিন্নমূল সময়ের অস্তিত্বের সঙ্কট মানুষকে এতটাই রক্তাক্ত করে ফেলেছিল যে তৈরি হয়েছিল সকলের থেকে আলাদা হয়ে যাবার এক আশ্চর্য সঙ্কট। কবি জীবনানন্দও এই বোধ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারেননি। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবিতাগুলি এর প্রমাণ বহন করে আসছে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র (১৯৩৬) পর জীবনানন্দের কাব্যের ক্রমপর্যায়গুলি এ প্রসঙ্গে লক্ষ করা প্রয়োজন। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যটিতে কবির এজাতীয় মানসিকতার তেমন প্রক্ষেপ নজরে আসে না। আবার ‘রূপসী বাংলা’ প্রকাশিত হয়েছিল জীবনানন্দের মৃত্যুর পর (১৯৫৭)। তাই পরবর্তী কাব্য ‘বনলতা সেন’-এর ভাবনায় অন্বেষক্লান্ত পৃথিবীর চিরপথিক সত্তাটিকে পাখির নীড়ের মতো শান্তি খুঁজে পেতে দেখি। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে ‘সুচেতনা’, ‘সুদর্শনা’ বা ‘সুরঞ্জনা’র মতো আপাত অর্থে নারী নামাঙ্কিত গভীরতর অর্থে চেতনার দ্যোতনা সঞ্চারী কবিতাগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে (শ্রাবণ, ১৩৫৯/১৯৫২) কবিতাগুলির অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু একি শুধুই গ্রন্থটির আয়তনগত পরিবর্তনের জন্য তৈরি। আমাদের মনে হয় না। দ্বিতীয় সংস্করণের ‘বনলতা সেনে’র মাধ্যমে একটা বিশেষ ভাবনাকেই কবি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। সেই বার্তাটি হল—

“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন 

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে।”

জীবনের সৌন্দর্য শান্তি, অবলীন শুদ্ধতার আশ্বাসে ভরা সম্পর্কগুলি সম্পূর্ণতা পায় সুষ্ঠ চেতনার স্পর্শে। কিন্তু নাগরিক সভ্যতার অবক্ষয়ে জারিত এই মানুষগুলির মধ্যে সেই চিন্ময়ী চৈতন্যের কোনো প্রলেপ দেখতে পাচ্ছিলেন না কবি। অথচ তিনি বুঝতে পারছিলেন রণোম্মত্ত এই মানুষগুলির জীবনের শেষ সত্য কিন্তু আপাত ইঁদুর দৌড়ের খেলায় সামিল হয়ে পার্থিব সুখলাভ নয়।

“এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।”

শেষ সত্য নয় বলেই কলকাতা শহর রূপসী প্রতিমা হয়ে উঠবে জেনেও কবি আনন্দে আশ্বস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। কারণ তিনি জানেন, আপাত আধুনিকতার চাদরে মোড়া এই কলকাতা শহর মানবিক শ্রী, সৌন্দর্য ও মূল্যবোধের আশ্রয়ভূমি হয়ে উঠতে পারবে না কখনও। তাই বহু ব্যবহৃত বাক্যবন্ধটিকে কবিতায় ব্যঙ্গাত্মক বা শ্লেষাত্মক শব্দেই ব্যবহার করেছেন কবি।

“কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে।”

নাগরিক সভ্যতার ক্ষয়, বিলোপ, আপাত মূল্যবোধহীন বিচ্ছিন্ন মনোভাবের কারণেই কবি বুঝেছেন মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে আজ সে শুধু আঘাতই করে। সময়ের রুঢ় প্রবৃত্তি মানুষের কোমল অনুভবগুলোকে কখনও চাপা দিয়ে, বদলে দিয়ে, বিকৃত করে তোলে তার প্রকাশ ও ধরনকে। তাই কবির স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ,

“পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো 

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত

ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে।”

বিশ্বের বাণিজ্যনীতি আমাদের ভালোবাসার মাঝে স্বার্থের দেয়াল তুলে দিয়েছে। মনুষ্যত্ব হারিয়ে আজ আমরা সকলে খুনি হবার মন্ত্র শিখে গেছি। সভ্যতার নাগরিক শ্রীবিলাসের ধারণাটিই মানুষকে খুনি করে তুলছে প্রতিনিয়ত। লোভী মানুষের বাণিজ্যতরীতে নিয়ত অগণিত মানুষের মৃতদেহ যেন পণ্য হয়ে আসছে। সেই মৃতদেহ অফুরন্ত স্বর্ণভাণ্ডার নিয়ে আসছে লালসামগ্ন মানুষগুলির জন্য। তারা আসলে সময়েরই ফসল। নাগরিক মানুষ তাদের প্রেম ভালোবাসা, বিবেক, মূল্যবোধের সঙ্গে বিনিময় সম্পর্ক স্থাপন করেছে পৃথিবীর স্বর্ণভাণ্ডারের। মানুষকে পণ্য করে সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার অগ্রগতির এই চেহারা স্বর্ণ লিপ্সার গ্লানি আমাদের পিতামহ, প্রপিতামহ এবং বুদ্ধ, কনফুসিয়াসের মতো মনীষীদেরও বোবা যন্ত্রণায় কাতর করে তুলেছিল। আবার পরম্পরাগত কারণে পরবর্তী প্রজন্মকেও তা মূক করে রাখে। এই আত্মঘাতী জীবন-যন্ত্রণার কথা কবি অন্যত্রও বলেছেন—

“মানুষ মেরেছি আমি তার রক্তে আমার শরীর 

ভরে গেছে, পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি।”

মানুষের লালসামগ্ন এই জীবন মানুষকেই স্তম্ভিত করে দেয়। তবু এ সভ্যতার সংকলিত জিনিসের ভিড়ে মানুষ গতানুগতিক লড়াইয়ের আহ্বান শুনতে পায়। সেই আহ্বানকে উপেক্ষা করবার মতো সাহস, সততা নাগরিক মানুষের নেই। কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবার মোহে এক অদ্ভূত স্তাবকতার জালে করায়ত্ত হয়ে গেছে মানুষের যাবতীয় সাধ পূরণের প্রক্রিয়া।

তবু জীবনানন্দ আশার দীপ প্রজ্জ্বলিত করে রাখেন মানবের সত্তায়। কারণ তিনি জানেন এই ক্ষয়, বিলোপ, বিধ্বংসী মানসিকতাই সভ্যতার অগ্রগতির একমাত্র ফসল নয়, অন্বেষণক্লান্ত চিরপথিক সত্তাটি এই মানবসমাজের কাছ থেকেই বেঁচে থাকার যাবতীয় উপাদান খুঁজে পেতে পারে। সেই মানব সমাজের প্রত্যয়ী অভিঘাত পাবার জন্য বহু শতাব্দীকাল মানবকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। ক্লান্তিহীন কর্মী মানুষের অজস্র কর্মধারার মাধ্যমেই দূরতর দ্বীপ ‘সুচেতনায়’ আমরা একদিন পৌঁছে যাব। নাগরিক শ্রীবিলাস, সভ্যতার অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না কবি, সভ্যতা অপেক্ষা সমাজ গঠনের দিকেই গভীর বিশ্বাস পোষণ করেছেন। কারণ তিনি জানেন এই সভ্যতার পিছনেই থাকে মানুষের অহংকার, লুব্ধ মানসিকতা, পদদলিত করে রাখার হিংস্র আকাঙ্ক্ষা। তাই সভ্যতা নয়, মানবসমাজই গড়ে তুলতে পারে মানবিকতার প্রবাহ, যা সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের গঠনগত বিন্যাসকে শ্রেণিহীনতার ব্যঞ্জনায় অভিষিক্ত করবে। মানবজাতিকে পৌঁছে দেবে সুচেতনার দূরতর দ্বীপে। তাই নাগরিক জীবনের হতশ্রী দৈন্যতাগ্রস্ত চেহারায় নয়, প্রবাহিত মানবসমাজের অতীত থেকে বর্তমান, বর্তমান থেকে অনাগত কালভূমিকে মহাকালের বৃত্তে দাঁড়িয়ে লক্ষ করেছিলেন বলেই জীবনানন্দ কবিতাটির অন্তিমে শোনাতে পেরেছেন অনন্তের আশ্বাসবাণী।

“দেখেছি যা হ’ল হবে মানুষের যা হবার নয় 

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয়।”