বিনোদনধর্মী রচনাই হল কমেডি। সরস সংলাপ ও ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে যা পরিণতি লাভ করে আনন্দজনক সমাপ্তিতে। প্রাচীন গ্রিসে দেবতা ডায়োনিসাস (Dionysus)-এর বাৎসরিক উৎসবকে কেন্দ্র করেই কমেডির উদ্ভব। নাট্যকার শেকসপিয়রের হাতেই এই নাটক জনপ্রিয়তা ও নাট্যোৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে। শেকসপিয়রের লঘু চপল রোমান্টিক কমেডিগুলিতে নীতিমূলক প্রচার কিংবা সামাজিক অসঙ্গতি সমূহের প্রতি শ্লেষাত্মক অঙ্গুলি নির্দেশ চোখে পড়ে না, ধ্রুপদী স্যাটায়ারধর্মী কমেডি থেকে তাঁর কমেডিগুলি স্বতন্ত্র। তাঁর কমেডির জগৎ বর্ণময় ও রূপকথাধর্মী এবং প্রেমের মহিমামণ্ডিত এক জগৎ। প্রাকৃতিক সম্পদশোভিত বনানী কিংবা কোনো জনবিরল দ্বীপ রচনা করে এই জগতের অনাবিল প্রেক্ষাপট। সংগীত, কাব্য, মোহময় শিক্ষা গড়ে তোলে উপযুক্ত আবহ। সংলাপের বুদ্ধিদীপ্ত সরসতা ছাপিয়ে ওঠে ঘটনার ওঠাপড়াকে। শেকসপিয়র তাঁর কমেডিতে একটি সুস্থ সুখী জীবনের কল্পনা করেছেন। তাঁর প্রত্যেক কমেডিতে এমন এক জগতের সন্ধান পাওয়া যায় যেখানে ভৌগোলিকদের প্রবেশ নিধেষ। অর্থাৎ নাটকের স্থান ভৌগোলিক সীমার সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে।
শেকসপিয়রের সকল কমেডি নাটকগুলিকে মূলত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন –
প্রথম পর্ব : দি কমেডি অব এররস (The Comedy of Errors), টু জেন্টেল ম্যান অব ভেরোনা (Two Gentlemen of Verona), লাভস লেবারস্ লস্ট (Love’s Labour’s Lost), দি টেমিং অব দ্য শু (The Taming of the Shrew)।
দ্বিতীয় পর্ব : (রোমান্টিক কমেডির স্বর্ণশিখর) এ মিড সামার নাইট’স ড্রিম (Amid Summer Night’s Dream), দি মার্চেন্ট অব ভ্যানিস (The Merchant of Venice), মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং (Much Ado About Nothing), দি মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর (The Merry Wives of Windsor), এজ ইউ লাইক ইট (As You Like it), টুয়েলফথ নাইট (Twelfth Night)
তৃতীয় পর্ব : (প্রবলেম কমেডি)—ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা (Troilus and Cressida), অলস ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল (All’s Well that Ends Well), মেজার ফর মেজার (Measure for Measure)
শেষ পর্ব : সিমবেলিন (Cymbeline), দি উইন্টার্স টেল (The Winter’s Tale), দি টেম্পেস্ট (The Tempest)।
দুখানি কমেডি :
(ক) দি মার্চেন্ট অব ভেনিস : শেকসপিয়রের দ্বিতীয় পর্বের এক শ্রেষ্ঠ নাটক। এর কাহিনিধারা হল—ভেনিস শহরের যুবক ব্যাসানিও ও তার বন্ধু ধনী ব্যবসায়ী অ্যান্টোনিও ছাড়া এই নাটকের অন্যান্য পাত্রপাত্রীরা হল ইহুদি কুসীদজীবী শাইলক, শাইলক কন্যা জেসিকা, ধনী দুহিতা পোর্শিয়া, ব্যাসানিওর বন্ধু গ্রাসিয়ানো, লরেঞ্জা, শাইলক ভৃত্য গোবো প্রমুখ। ব্যাসানিও পোশিয়ার হৃদয়-বিনিময় ও বিবাহের মূল কাহিনি সুন্দরভাবে যুক্ত করা হয়েছে শাইলকের নিষ্ঠুরতা ও লরেঞ্জো-জেসিকার প্রণয় পর্বের সঙ্গে। এই নাটকের প্রধান আকর্ষণ শাইলকের সঙ্গে অ্যান্টোনিওর চুক্তির শর্ত বিষয়ক নাটোৎকণ্ঠা এবং আইনজীবীর ভূমিকায় পোর্শিয়ার সুচতুর তার্কিক ব্যাখ্যা ও সব সংকটের নিরসন।
(খ) দি টেম্পেষ্ট : এটি শেকসপিয়রের একমাত্র নাটক যেখানে ধ্রুপদী নাট্য ঐক্যের নীতি মেনে চলা হয়েছে। দূরবর্তী কেনো এক জনবিরল দ্বীপে একটি দিনের সময় সীমায় এ নাটকের সমস্ত ঘটনা সীমাবদ্ধ। রোমান্সধর্মী ও কাব্য সুযমামণ্ডিত এ এক অত্যাশ্চর্য নাটক। মিলানের যাদুকর ডিউক প্রস্পেরো নিয়ন্ত্রিত এক স্বর্গীয় দ্বীপভূমিতে সংঘটিত এ নাট্যকাহিনি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে। সিংহাসন লিপু ভ্রাতা অ্যান্টেনিও কর্তৃক ডিউক প্রস্পেরো কন্যা মিরান্দাকে নিয়ে সমুদ্র পথে যাত্রাকালীন এসে পড়েন এক আশ্চর্য দ্বীপে, সে দ্বীপের একমাত্র অধিবাসী এক বিচিত্র দানব ক্যালিবান, ডাকিনী সাইকোরাক্সেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল এই দ্বীপে, ক্যালিবান সেই সাইকোরাক্সেরই পুত্র। এই দ্বীপে প্রস্পেরো ও মিরান্দা বাস করেন দীর্ঘ বছর। প্রস্পেরো যাদুবলে নামিয়ে আনেন নানান বাসবীয় সত্ত্বা, এরিয়েল যাদের দলপতি। বারো বছর এভাবে কাটার পর সমুদ্রযাত্রী অ্যান্টোনিও তার সহচর নেপলসরাজ অ্যালনসো ও রাজপুত্র ফার্দিনান্দ এর জাহাজটিকে যাদুবলে ডুবিয়ে দেন প্রস্পেরো। যাত্রীরা রক্ষা পায় কিন্তু ফার্দিনান্দ অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ও তাকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। এদিকে ফার্দিনান্দ ও মিরান্দা পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয় ও প্রণয়াসক্ত হয়। প্রস্পেরোর নির্দেশমতো এরিয়েল অ্যান্টোনিও ও অ্যালনসোর ওপর নানাবিধ পীড়ন চালায়। অ্যান্টোনিও তার দোষ স্বীকার করে। প্রস্পেরো ও ফার্দিনান্দ তাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হন।
যাদুবলে ডুবে যাওয়া জাহাজটিকে পুনরুদ্ধার করা হয়। প্রস্পেরো তাঁর যাদুবিদ্যা পরিহার করেন এবং দ্বীপ ত্যাগ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ক্যালিবান আগের মতোই একা থেকে যায় যাদু দ্বীপে। প্রস্পেরোর কল্যাণী যাদু যা ম্যাকবেথ নাটকের ডাকিনীমায়ার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। পুনরুজ্জীবন ঘটায় স্খলিত ও পথভ্রষ্টদের। আর পুনরুজ্জীবনের পর সকলেই ফিরে আসেন সভ্যজীবনে, মানব জীবনে। একটি জার্মান নাটক থেকে নির্বাসিত যাদুকর ও তার কন্যার কাহিনি এবং বারমুডায় স্যার জর্জ সমাস, এর জাহাজ ডুবির বিবরণ থেকে এই নাটকের রসদ সংগ্রহ করেছিলেন শেকসপিয়র।
একটি জনপ্রিয় নাট্যগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার ফলে শেকসপিয়রের যে কোনো নাটকেরই প্রাথমিক শর্ত ছিল তার মঞ্চ সাফল্য এবং পেশাদার নাট্যকার তথা অভিনেতা হিসাবে দর্শকরুচির নাড়ীর গতি তিনি সঠিক বুঝেছিলেন। নাট্য রচনায় তাঁর কৃতিত্ব তাই সহজাত, অ্যাকাডেমিক ও টেকনিক সর্বস্ব নয়, সাবলীল ও মানবিক গুণান্বিত। তাঁর বিভিন্ন ধরনের নাটকের কিছু উল্লেখনীয় বৈশিষ্ট্য এমনভাবে দেওয়া যেতে পারে—
-
(ক) শেকসপিয়রের নায়ক-নায়িকারা সকলেই খ্যাতিকীর্তি ও অভিজাত। কমেডি নাটকগুলিতে নায়িকারা সাধারণভাবে আধিপত্য করেছে। মোটের ওপর নারী ও পুরুষ উভয় চরিত্র চিত্রণে তাঁর দক্ষতা অপরিসীম।
-
(খ) মূলত নাট্য রচনায় শেকসপিয়র অনেক স্থলেরই অ্যারেস্টলীয় নির্দেশ মানেননি।
-
(গ) নাট্যদ্বন্দ্ব যে নাটকের প্রাণ, শেকসপিয়র এ শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।
-
(ঘ) পেশাদার বিদূষক ও বিদষকধর্মী অন্যান্য চরিত্র শেকসপিয়রের নাটকের অমূল্য সম্পদ।
-
(ঙ) ভাষাতাত্ত্বিকদের নিরন্তর গবেষণার বিষয় শেকসপিয়রের ভাষাশৈলী, শব্দ ভাণ্ডারের বিপুলত্বে ও বৈচিত্র্যে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই।
জীবন দেবতার সার্থক পূজারি শেকসপিয়র জীবনের পূতিগন্ধময় দিককে যেরূপ সহজ শান্ত মনে নিয়েছিলেন, জীবনের শুভ্র সুরভিত দিক থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করেননি। মানুষের জীবনের মেঘ আছে, ঝঞ্ঝা আছে, সেই সঙ্গে ইন্দ্রধনু ও সূর্যকিরণের সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর মায়ামুকুরে মানুষের বিরাট সত্তার প্রতিবিম্ব ধরা দিয়েছে, তাই শেকসপিয়র সর্বযুগের সকল দেশের কবি। শেকসপিয়রের মৃত্যুর পর তিনশো বছর কেটে গেল। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রে কত সংঘাত দেখা দিল। মানুষের চিন্তায়, সমাজে, সাহিত্যে রাজনীতিতে কত বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল কিন্তু শেকসপিয়র এখনও উত্তুঙ্গ হিমাচলের মতো চিরজীবীর জয়টীকা পরে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন।
Leave a comment