ছায়াবাদী কবিদের রচনায় বেদনাবিধুর বিষাদের গভীর প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। মহাদেবীর রচনাও এর ব্যতিক্রম নয়। মহাদেবীর ব্যক্তিগত জীবনের বিষাদময় পরিণতির প্রকাশ তার কাব্যের ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত। তিনি মূলত গীতিকবি ছিলেন এবং তার কাব্যের প্রধান ভাব হল প্রেম। একশ্রেণির সমালোচক মহাদেবীর প্রেমের কবিতায় আধ্যাত্মিকতার রং চড়িয়ে থাকেন।

ভারতীয় গীতিকাব্য প্রেমকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে। এই প্রেমের দুটি ধারা পার্থিব প্রেম এবং অপার্থিব প্রেম। রক্তমাংসে গড়া মানবমানবীর হাসি অশ্রুভরা প্রণয়কাহিনিকে অবলম্বন করে পার্থিব প্রেম রচিত হয়। আবার মানবপ্রেম যখন উচ্চতর ভূমিতে উন্নীত হয় তখন ভোগের জায়গা নেয় ত্যাগ এবং আত্মকামনার জায়গায় আত্মবলিদানের প্রতিষ্ঠা হয়। একেই কাব্যের ভাষায় আমরা আত্মার মিলন বলে থাকি।

ভক্তিপূত প্রেমের দুটি রূপ আমরা পাই। একটি রূপ হল রাধাকৃষ্ণের প্রেম বা রাম-সীতার ন্যায় প্রণয়কাহিনি, অন্য রূপটি হল ঈশ্বরের সাকার বা নিরাকার রূপের প্রতি শ্রদ্ধা বা অনুরাগসঞ্জাত।

মহাদেবীর কাব্যের বিষয় হল প্রেম ও সৌন্দর্য ! জীবনের মধুর ও কোমল রূপকেই তিনি তাঁর কাব্যের প্রতিপদ্য বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ছায়াবাদের গতিশীলতার ধারায় তার গীতগুলি শরীরী মায়াকে অবলীলায় ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছে। তার ‘সান্ধ্যগীতে’ সংকলিত কবিতাবলি কেবলমাত্র কবির মানসগঙ্গোত্রীর সহজ প্রবাহ নয় রমণীয় কাব্যকলার অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শনরূপে পরিগণিত।

বিরহ মহাদেবীর কাব্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে বিদ্যমান। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রেমধারণা থেকে তার প্রেমধারণা কিছুটা স্বতন্ত্র। আবেগতাড়িত মানবিক প্রেম এবং তত্ত্বগত দার্শনিক চেতনা একাকার হয়ে মহাদেবীর কবিতাকে কিছুটা দুরূহ করে তুলেছে। বিরহ মিলন আত্মা-পরমাত্মা এবং অসীম ও সমীমের তত্ত্ব ও প্রেম একাত্ম হয়ে গেছে মহাদেবীর কবিতায়। প্রেমকে তিনি কামনাবিমুক্ত করে রাখতে চেয়েছেন। কল্যাণই প্রেমের চরম লক্ষ্য বলে তিনি মনে করতেন। মানবজীবনের ব্যক্তিগত প্রেম এবং বিশ্বপ্রেমের নিবিড় সম্পর্ক তার কাব্যকায়ার ধ্বনিত।

মহাদেবীর কবিতা বিষাদের সিন্ধু। প্রেমের বর্ণনায় বিরহ ও অতৃপ্তির বেদনা তারই কবিচিত্তকে পীড়া দিত। তাই তাকে অনেকে ছায়াবাদের মীরা আখ্যায় ভূষিত করেছেন। তার কবিতায় বিপদ ও দুঃখের আধিক্যহেতু অনেক সমালোচক তাকে দুঃখবাদী কবির শিরোপা দিয়েছেন। কবি মনে করেন পৃথিবীর বেদনার সাথে নিজের বেদনাকে একাকার করে দিতে পারলেই কবির মোক্ষলাভ হতে পারে।

মহাদেবী বিষাদের মধ্যেই প্রিয়তমকে এবং প্রিয়তমের মধ্যে বিযাদকে আমৃত্যু খুঁজে বেড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন—“পীড়া মেরে মানসমেঁ ভাগে পট সীলিপটি হই হ্যায়।” অর্থাৎ দুঃখ আমার মনে ভিজে কাপড়ের মতো জড়িয়ে আছে। সামগ্রিকভাবে ভারতীয় নারী জীবনের ব্যক্তিগত হতাশাজনিত অসন্তোষ ও ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে একাকার করে মহাদেবী তাঁর কাব্যের সুর বেঁধেছেন। ফলে যথার্থভাবেই তিনি দুঃখবাদের প্রবক্তারূপে পরিগণিত। তাই মহাদেবী হিন্দি সাহিত্যের ছায়াবাদী ধারার যথার্থ ‘মীরা’।