রীতিরাত্মা কাব্যস্য/অলংকৃত বাক্যমাত্রই কাব্য নয় তার নিরলংকার বাক্য ও কাব্য হতে পারে তাঁর কারণ কাব্যের আত্মা হচ্ছে রীতি।

আলংকারিকদের বক্তব্য ছিল যে কাব্যে যে মানুষের উপাদেয়—তার কারণ হল অলংকার। অর্থাৎ অলংকারের গুণেই কাব্য সুন্দর হয়। কিন্তু এই বিশ্বসংসারের এমন অনেক কবিতা আছে যারা নিরলংকার হয়েও যথার্থ কাব্য হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের শেষ চিঠি কবিতার কিছু অংশ এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করছি—

অমলার ঘরে বসে সেই অযোথা চিঠি খুলে দেখি

তাতে লেখা-

তোমাকে দেখতে বড্ডো ইচ্ছে করছে

আর কিছুই নেই।

এ কবিতা নিরলংকৃত হয়েও কন্যার মৃত্যুতে পিতার শোক যথার্থ করুণ রসের স্ফূরণ ঘটিয়েছে। আবার নিম্নলিখিত উদাহরণটি শেষ করা যাক—

‘তরঙ্গনিকরোন্নীত তরুণীগণ সংকুলা 

সারদ, বহতি কল্লোলব্যূহব্যাহত তীরভূঃ

এ কাব্যের শব্দে ও অর্থে অনুপ্রাস ও রূপক অলংকার থাকলেও এটি যথার্থ কাব্য হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ অলংকৃত বাক্যমাত্রেই যে কাব্যে নয়, অথচ নিরলংকৃত বাক্যও যে কাব্য হতে পারে তার কারণ কাব্যের আত্মা হচ্ছে রীতি। এই রীতি হল পদরচনার বিশিষ্ট ভঙ্গি। ‘বিশিষ্টা পদরচনা রীতিঃ’ বলেছেন বামন। অর্থাৎ কাব্যের আত্মা হল Style অতুল গুপ্ত রীতি ও Style-কে এক হিসাবে দেখেছেন পৃথিবীর অনেক কবির কাব্য এই Style-এর গুণেই লোকরঞ্জন হয়েছে। ভারতচন্দ্রের প্রধান আকর্ষণ তাঁর Style, তাই তো বুফোর মন্তব্য ‘Style is the man’ এ প্রসঙ্গে অতুল গুপ্ত অবয়ব সংস্থানের কথায় এসেছেন। অঙ্গে শুধুমাত্র অলংকার পরলেই মানুষকে সুন্দর দেখায়নি, যদি না তার অবয়ব সংস্থান নির্দোষ হয়। এই রীতি বা Style হল কাব্যের সেই অবয়ব সংস্থান।

কাব্যং গ্রাহামলংকারাৎ/কাব্য যে মানুষের উপাদেয় সে এই অলংকারের জন্য।

সংগীতের মতোই কাব্য হল কল্পনাশ্রয়ী। একদিকে সে অর্থযুক্ত পদ সম্বন্বয়ে সুষমান্বিত, অন্যদিকে আবার ভাবের তরঙ্গে তরঙ্গায়িত, ভাষা সেখানে ভাবের বাহন হয়ে আসে। আর কবি তো কথার স্বর্ণকার তাই তিনি গদ্যের মতো কাব্যের শব্দ তার অর্থকে আটপৌরে না রেখে নানান সাজ-সজ্জায় সাজিয়ে তোলেন। অলংকার যেমন নারীর ভূষণ, তেমনি অলংকারবাদীরা শুধু কাব্যের ভূষণ হিসাবে অলংকারকে অভিহিত করে ক্ষান্ত হননি, তিনি বলেছেন কাব্য যে মানুষের কাছে উপাদেয় হয়ে ওঠে তা অলংকারের জন্যই। ভমহ থেকে কুন্তক পর্যন্ত প্রায় সকলেই কাব্যে অলংকার প্রয়োগে কথা বলেছেন। তাই বামন বলেছিলেন ‘কাব্যং গ্রাহ্যমলংকারাৎ’। তাই অলংকারবাদীদের মতে কাব্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে শব্দে ও অলংকারে। তথাপি অলংকার থাকলেই কাব্যে যে সর্বদাই রসোত্তীর্ণ হবে এমন বলা যায় না, অলংকার থাকা সত্ত্বেও সার্থক কাব্য হয়নি, এমন উদাহরণের অভাব নেই। যেমন—‘এত ভগ্ন বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা—এ কবিতাংশটিতে অনুপ্রাস অলংকার থাকলেও তা সার্থক কাব্য ওয়ে ওঠেনি। আর এখানেই জন্ম নেয় রীতিবাদ।

রসের ব্যাঞ্জনাই বাক্যকে কাব্য করে। কাব্যের ধ্বনি হচ্ছে রসের ধ্বনি।/কাব্যের আত্মা ধ্বনি বলে যাঁরা আরম্ভ করেছেন, কাব্যের, কাব্যের আত্মারস বলে তাঁরা উপসংহার করেছেন।/বাক্যং রসাত্মক কাব্যম।

কবিতা যখন বাচ্যার্থকে ছাড়িয়ে ব্যাঞ্জনাকে প্রকাশ করে তখন তাকে বলে ধ্বনি। ধ্বনিবাদীদের প্রচেষ্টাতে কাব্যের আত্মা ‘ধ্বনি’ রূপে প্রাধান্য লাভ করে। অভিনব গুপ্ত বাচ্যার্থ ও ব্যঞ্জনার যুগ্ম প্রকাশকে ‘শ্রেষ্ঠ ধ্বনি’ বলেছেন। কবিতার ব্যাঙ্ময় যদি কোনো রসকে প্রকাশ করে তার তাকে বলা হবে রসধ্বনি। ধ্বনিবাদীদের মতে সমস্ত ধ্বনির পরিণতি ঘটে রসধ্বনিতে। তাই-ই ধ্বনিবাদীরা রসকে কাব্যের অন্তিম তথা চরম পরিণতি হিসাবে মেনে নিয়েছেন। আর ধ্বনি হল সেই রসের প্রকাশ। কবিরা মানুষে চিরকালীন কথাকে মানবের আবেগকে ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ করে রসে রূপদান করে থাকেন। আর সেই রসই পাঠকের হৃদয়ে রুদ্ধ আবেগের ধারা বেরিয়ে আসে। পাঠকের মনে কবির আবেগ উৎসাহ সঞ্চারিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মদন ভষ্মের পর’ কবিতায় মানবের চিরন্তন বিরহ মিলনকে ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ করে রসধ্বনিতে পরিণত করেছেন—

‘পঞ্চশরে দন্ধ করে করেছ একী সন্ন্যাসী 

বিশ্বময়ে দিয়েছো তারে ছড়ায়ি

ব্যাকুলতার বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিঃশ্বাসী

অশ্রু তাঁর আকাশে পড়ে গড়ায়ে।

এখানে অভিনব গুপ্ত কথিত ‘নিজের আনন্দময় সম্বিতের আস্বাদ রূপ একটি ব্যাপার’—প্রত্যক্ষ করা যায়। মানব মনের চিরন্তন বিরহ মিলনের ভাবানুভূতি এখানে ব্যঞ্জিত হয়েছে ও শ্রেষ্ঠধ্বনি রসধ্বনির প্রকাশ ঘটেছে। ধ্বনিকে অবলম্বন করেই কাব্য শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে সহৃদয় পাঠক ধ্বনির মাধ্যমে রসের আস্বাদ লাভ করেন। মদনের দেহ ভস্ম হওয়া নিয়ে বহু শ্লোক পূর্বে রচিত হয়েছে, উদাহরণ সকল অভিনব গুপ্ত দুটি শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন যে সে দুটি শ্লোকে বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা প্রকাশিত হয়নি বলে সার্থক কাব্য হয়ে ওঠেনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মদন ভস্মের পর’ কবিতায় অপূর্বভাবে ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ করে রসধ্বনির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই কবিতাটি কাব্য হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে অতুল গুপ্ত লিখেছেন—’এ কবিতার কাব্য তার বাচ্যকে ছাড়িয়ে মানব মনের যে চিরন্তন বিরহ, যা মিলনের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে তারই ব্যঞ্জনা করছে এবং সেখানেই এর কাব্যত্ব। অভিনব গুপ্ত অবশ্য ঠিক এ ভাষা ব্যবহার করতেন না, কিন্তু এই একই কথা তিনি তাঁর অলংকারিকের ভাষায় বলতেন যে এ কবিতার কাব্যত্ব হচ্ছে এর কারণ বিপ্রলম্ভের ধ্বনি। এই জন্যই য়সধ্বনি, অলংকার ধ্বনি, ভাব ধ্বনির ও রসধ্বনির মধ্যে রসধ্বনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।

রস হচ্ছে নিজের আনন্দময় সম্বিতের আস্বাদ রূপ একটি ব্যাপার।

কাব্যরস একান্ত ভাবেই অনুভূতির বিষয়। আর এই কাব্যরস অনুভবের বিষয়টি আবার একান্তভাবেই মনের ব্যাপার একমাত্র সহৃদয় পাঠকের পক্ষেই এই রস আস্বাদন করা সম্ভব। রসবাদের প্রধান বক্তব্য হল বিভাব-অনুভাব ও সঞ্চারী ভাবের স্বাদ ব্যক্ত হবার পর পাঠক ও দর্শকের মনে রতি ইত্যাদি স্থায়ী ভবে রূপান্তরিত হয়। বিশ্বনাথ সাহিত্য দর্পণে লিখেছেন ‘বিভাবে নানুভাবেন ব্যক্ত : সঞ্চারিনী তথা। রসতামেতি রত্যাদি : স্থায়ী ভবেঃ সচেতসাম’ সহৃদয় পাঠকের মনেই ভাব রসে রূপান্তরিত হয়। সমস্ত সহৃদয় পাঠকের মনেই স্থায়ীভাব গুলি (অর্থাৎ রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয় জুগুপ্সা, বিস্ময়) একই রকম। ফলে কাবপাঠের সময় কাব্যের ঘটনা-কাহিনি সহৃদয় পাঠকের মনে ওই স্থায়ী ভাবগুলিকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। বিভাব ইত্যাদি সাধারণী করনের প্রভাবেই কাব্যের চরিত্রের সাথে পাঠকগণ একাত্ম হয়ে যান, আর তখনই স্থায়ী ভাবের সাথে সাথে বিভবে অনুভব সঞ্চারী ভাবে সমস্তই এই সাধারণীকরণে বন্দি হয়ে পড়ে। তখনই পরের অথচ পরের নয়, আবার আমার অথচ আমার নয়—এমন অনুভূতি যাকে বিশ্বনাথ বলেছেন—’পরস্য ন পরস্যোতি মমেতি ন মমেতি চ’-এমন অনুভূতির জন্ম হয়। সহৃদয় পাঠকের মনের স্থায়ীভাব কাব্যের বিভাব-অনুভাবের সাথে যুক্ত হয়ে মনের অন্তরে রসাভিব্যক্তি ঘটাতে থাকে। লৌকিক স্থায়ীভবে অন্যান্য সঞ্চারী ভাবে ও বিভাবে-অনুভাবের সহযোগিতায় অলৌকিক রসে পরিবর্তিত হয়। ব্যক্তিগত ভাবনা তখন সর্বসাধারণের হয়ে দাঁড়ায় আর এই সার্বজনীনতার জন্যই লৌকিক ভাব অলৌকিক রসে রূপান্তরিত হয়। এই অলৌকিক রস রসিক জনের মনে প্রভাব বিস্তার করে। আর এ জন্যই অলংকারিকেরা জানিয়েছেন কাব্যরসের আধার হল সহৃদয় পাঠকের মন।

দরদী লোকের সুকাব্য জনিত চিত্তের অনুভূতি বিশেষের নামই ‘রস’-সুতরাং বলা যেতে পারে কাব্যরসের আধার কাব্যও নয় কবি নয় সহৃদয় কাব্যপাঠকের মন।

রসাত্মক বাকাই হল কাব্য। কাব্যকে সমৃদ্ধ যোগ্য করে তোলে রস। এখন প্রশ্ন এই রসকে পাঠক হিসাবে অনুভব বা আস্বাদ করে থাকেন। কোথায়ই বা সম্ভাবিত হয় এই রস ? অভিনব গুপ্তের মতে বাক্যে নয়, কাব্যে নয়, পাঠকের মনে থাকে রস। তবে সকলে নন, সহৃদয় ব্যক্তিই কাব্যরস পান করে ধন্য হন।

এখন প্রশ্ন ওঠে সহৃদয় ব্যক্তি কাব্যে ? সহৃদয় ব্যক্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন অভিনব গুপ্ত, তিনি বলেছেন——যে নাং কাব্যনুশীলানাভ্যাসে বশাদবিশদী ভূতে মনোসুকুরে বর্ণনীয় তন্ময়ী ভবন যোগ্যতা তে হৃদয় সংবাদ ভাজঃ সহৃদয়া’। অর্থাৎ নিয়মিত কাব্যানুশীলনের ফলে যাদের মনের আয়নায় কাব্যের ঝর্ণার বিষয় তন্ময়তা লাভ করে তারাই হলেন সহৃদয় ব্যক্তি। সকল ভাবে বলতে গেলে কাব্যের বিস্ময়ের সাথে যিনি একান্ত হতে পারেন তিনিই হলেন সহৃদয় ব্যক্তি। সহৃদয় ব্যক্তি যখন কাব্যরসের আস্বাদ করেন তখন এই পার্থিব লাভ-ব্যক্তি চিন্তা তার মন থেকে দূরে সরে যায়। রজঃ ও তমোগুণ রসাস্বাদে বিঘ্ন সৃষ্টি করে তাই যতক্ষণ না সত্বঃ গুণের উদয় হয়ে সংশয় হচ্ছে, ততক্ষণ কাব্যরস আস্বাদ সম্ভব নয়। এই সময় শান্ত পরিশীলিত মনে কোনো অহংভাব থাকে না। এমতাবস্থাতেই রসাস্বাদ সম্ভব। তাই কবি নন, একমাত্র সহৃদয় ব্যক্তিই কাব্যরসের সার্থক আস্বাধন করতে পারেন। যিনি সহৃদয় ব্যক্তি নন তাঁর কাছে ‘বনলতা সেন’ কিংবা ‘সোনার তরী’ অকাব্য হতেই পারে। কারণ কাব্যরস কখনও বিচার বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না, তার আস্বাদন ঘটে অনুভূতির জগতে। তাই তো রস হল সহৃদয় হৃদয় সংবাদী।