প্রশ্নটির যথা-প্রাসঙ্গিক আলোচনার আগে আমরা প্রথমেই গুটি কয় মহাজন বচন স্মরণ করে নিচ্ছি। কেন, সেকথা যথাস্থানে বিবৃত হবে।

(1) “Even if good literature entirely lost its currency with the world, it would still be abundantly worth-while to continue to enjoy it by one self. But it will never lose currency with the world, inspite of momentary appearances, it never will lose its supremacy, currency and supremacy are insured to it, not in deed by world’s deliberate and conscious choice, but by something far deeper – by the instinct of self-preservation in humanity. [Mathew Arnold, ‘The Study of Poetry’]

(2) ‘Sainte Beauve once indicated in a famous discouerse, ‘your true classic is universal in that it appeals to the catholic (সর্বমানবিক, সর্বজন-উপযোগী) mind of man. It is doubly permanent: for it remains significant, or acquires a new signifance, after the age for which it was written and the condition under which it was written have passed away; and yet it keeps, undefaced by handling, the original noble imprint of the mind that first minted it-or shall we say that, as generation after generation rings the coin, it ever returns the echo of its father-spirit?” [A. Quiler, Couch-‘ON THE ART OF READING’]

(3) “One of the facts that might come to light in this process in our tendency to insist, when we praise a poet, upon those aspects of his work in which he least resembles anyone else. In these aspects, or parts of his work we pretend to find what is individual, what is the peculiar essence of the man. We dwell with satisfact ion upon the poet’s difference from his predecessors, especially his immediate predecessors, we endeavour to find something that can be isolected in order to be enjoyed. Whereas if we approach a poet without his prejudice, we shall often find that not only the best, but the most individual parts of this work may be those in which the dead poets, his ancestors, assert their immortality most vigourously”. [T. S. Elliot. Tradition and the Indi vidual Talent’.]

আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে কোনো কিছু বিশদ করে বলার আগেই পৌণে এক গণ্ডা বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি এনে হাজির করা হল—প্রচলিত ধারার সচরাচর যত্রতত্র অনুসৃত না হলেও প্রথাটা এমন কিছু রীতি-বিগর্হিত ব্যাপার নয়। গত শতাব্দীর একাধিক বরেণ্য ঔপন্যাসিকও তাঁদের গ্রন্থের প্রায় প্রতি পরিচ্ছেদের শীর্ষে এমনি এক-একটি উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁদের কাহিনির অবতারণা করতেন। আমাদের এ প্রয়াসের লক্ষ্যটি কিন্তু কিছু ভিন্নতর। বিশেষ একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখেই আমরা এ রীতিটার দ্বারস্ত হয়েছি।

বস্তু বা বিষয়ের স্বরূপগত সত্য নির্ণয়ের জন্য বিজ্ঞান এবং যুক্তিশাস্ত্রে inductive reasoning বা আরোহ অনুমান নামক যে একটি পদ্ধতি হামেশাই অনলম্বিত হয়ে থাকে, এটা বোধ হয় আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। ব্যাপারটা খানিকটা এইরকম : যদি দেখা যায় একটা বিশেষ বস্তুর কোনো সাধারণ লক্ষণ বা ধর্ম স্থান ও সময়ের দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও কিছুতেই পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না, তখন অকাট্য সিদ্ধান্ত হবে যে যথোক্ত ধর্মটাই সেই বস্তুর নিবিশেষ ধর্ম স্বরূপ। যেমন কয়লা নামক বস্তুটা পৃথিবীর যে-কোনো স্থানের ভূগর্ভ থেকে যে-কোনো সময়েই উত্তোলিত হোক, দেখা গেল সর্বক্ষেত্রেই সেই বস্তুটা একটা কালো রঙের দাহ্য বস্তুপিণ্ড। সুতরাং নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত হল, কালোত্ব আর দাহ্যশক্তিই হচ্ছে কয়লার একটি সনাতন স্বধর্ম।

সত্য-নির্ণয়ের এই inductive বা আরোহ পদ্ধতিটি অনুসরণ করে ওপরের উদ্ধৃতি ক-টির বক্তব্য অনুধাবনের চেষ্টা করা যাক। তাতে কী দেখতে পাচ্ছি আমরা? প্রথমেই দেখতে পাচ্ছি, বক্তব্য ক-টি এমন তিনজন মানুষের যাঁরা প্রত্যেকেই বিগত একশত থেকে দেড়শত বৎসর কাল যাবৎ আপন-আপন দেশের সাহিত্য-বিচারের পরিমণ্ডলে এক-একজন প্রধান পুরুষ। ম্যাথ্যু আর্নকে (১৮২২–১৮৮৮) আজও পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যের সর্বপ্রধান সমালোচকের স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। ফরাসি সাহিত্যে সাঁৎ বেয়োভ (Saint Beauve ১৮০৪–১৮৬৯)-এর মর্যাদাও আর্নল্ড-এর সমান। আর এলিয়ট-এর পরিচয় ? সেটা ইতিমধ্যে জানা না থাকলে, আমাদের সম্ভবত সাহিত্যের ছাত্র হবারই অধিকার থাকে না।

দ্বিতীয়ত দেখতে পাচ্ছি, তিনজনই প্রধান পুরুষ, কিন্তু দেশ ও কালের পরিমাপে প্রত্যেকেই প্রায় পরস্পরের বিদেশি। অথচ তাঁদের বক্তব্যের মর্মার্থ এবং সিদ্ধান্ত প্রায় অভিন্ন। এই তিনজনেরই বক্তব্য থেকে এই একটা কথাই বেরিয়ে আসছে যে প্রকৃত সাহিত্য—যেটাকে তাঁরা ক্লাসিক বা চিরায়ত সাহিত্য বলেছেন—তার মধ্যে এমন একটা নিত্যবস্তু থাকে যার আবেদন universal অর্থাৎ সার্বিক এবং permanant অর্থাৎ শাশ্বত। মানুষের মনন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই নিত্য বস্তুটার কোনো কালেই কোনো অবমূল্যায়ন হয় না। বরং কাল থেকে কালান্তরে এই নিত্য বস্তুটাই পরবর্তী যুগে এসে একটা নূতন তাৎপর্যে ব্যঞ্জিত হয়ে সেই বিশেষ যুগের অন্যতম প্রধান মর্মকথা হয়ে উঠেছে। যেমন, চারশত বৎসর আগেকার এক অস্থিতচিত্ত যুবকের স্বগত আর্তনাদ ‘To be nor to be’ (হ্যামলেট)– বিশ শতকীয় অস্তিত্ববাদীদের কারো কারো কাছে বীজমন্ত্রের মতো সত্য হয়ে উঠেছে। অথবা যেমন, এ যুগের অনেক দেশেরই ক্রমবিকাশমান স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করছি সেই ম্যাকবেথীয় ক্ষমতালোলুপতার হৃদয়হীন রাক্ষস-ক্ষুধা।

এলিয়ট তো আবার তাঁর বক্তব্যের সাহিত্যের এই সার্বিক ও শাশ্বত চরিত্রটা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে এসেছেন। বলেছেন, সাহিত্যে বস্তুতপক্ষে মৌলিক, অনন্য বা পরিপূর্ণ নিজস্ব বলে কোনো বস্তুরই অস্তিত্ব নেই। সাহিত্যের সমস্ত সত্য, রূপ আর সুরই মানুষের সর্বব্যাপী ঐতিহ্যেরই মধ্যে বীজাকারে লগ্ন এবং লীন হয়ে আছে। পূর্বসূরীদের রচনাবলির মধ্যে প্রত্যেকটির আকর রীতিমতো আকারিত হয়েই বর্তমান।

এলিয়ট কথিত মানব-মনীষীর এই ঐতিহ্যটাকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব ভাষ্য অনুযায়ী বলেছেন ‘বিশ্বমন’। বহুযুগের বহুকোটি মানুষের জীবনাচার ও মানসিকতার যোগফল হচ্ছে ঐতিহ্য। ‘বিশ্বমন’ও তাই। যে-সাহিত্যের আবেদন সার্বিক ও শাশ্বত সেই সাহিত্য এই বিশ্ব মানেরই সৃষ্টি। এই বিশ্বমনের সৃষ্টি লীলাটি কীভাবে সাহিত্য হয়ে ওঠে সে কথাটাও আমরা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছেই জেনে নিতে পারি।

“যেটা যথার্থ চিন্তা করবো, যথার্থ অনুভব করবো, যথার্থ প্রাপ্ত হব, যথার্থরূপে প্রকাশ করাই তার একমাত্র স্বাভাবিক পরিণাম—এটা আমার প্রকৃতি সিদ্ধ—ভিতরকার একটা চঞ্চল শক্তি ক্রমাগতই সেই দিকে কাজ করছে। অথচ সে শক্তিটা যে আমারই তা ঠিক মনে হয় না, মনে হয় সে একটা জগত-ব্যাপ্ত শক্তি আমার ভিতর দিয়ে কাজ করছে। প্রায় আমার সমস্ত রচনাই আমার নিজের ক্ষমতার অতীত বলে মনে হয়– এমনকি আমার অনেক সাধারণ গদ্য লেখাও।

তবু এরপরও আরও একটি কথা বোঝবার বাকি থাকে। সকল কালের সকল মনের যোগফলই কি বিশ্বমন ? না, সকল কালের সকল মন হচ্ছে বিশ্বমনের এক-একটি খণ্ডাংশ। যদিও কথাটা হরে-দরে একই। তবু রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কথাটা আমাদের সেই ভাবেই বুঝে নেওয়া বিধেয়। কেননা, আমাদের আলোচনার বিষয় তো রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটাই।

রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে বলেছেন, বিশ্বমন হচ্ছে বিশ্ব চৈতন্যের এক বিশেষ প্রকাশ। সেটা স্বয়ং-সম্পূর্ণ, অনাদিকাল থেকেই সেটা জগৎব্যাপ্ত হয়ে আছে। আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যষ্টি মন এই বিশ্বমনেরই এক-একটি খণ্ডাংশ মাত্র; অর্থাৎ স্বরূপত অভিন্ন। আমরা আমাদের স্ব-স্ব মনগড়া এক-একটা নিজত্বের (individuality) বেড়া দিয়ে এই বিশ্বমনটাকে আমাদের উপলব্ধি থেকে আড়াল করে রাখি। যেমন, আমরা ঘরের আকাশকে (space) চারদেয়ালের বেড়া দিয়ে পৃথক করে রাখি বাইরেকার ব্রহ্মাণ্ড-ব্যাপ্ত মহাকাশ থেকে।

অধিকাংশ মানুষই এই আড়ালটাকেই সত্য বলে মেনে নেয়, ফলত আড়ালটা থেকেই যায়। কিন্তু কেউ-কেউ আছেন (যেমন কেউ-কেউ কবি) যাঁরা তাঁদের এই নিজত্বের বেড়াটাকে একটা বিশেষ ক্ষমতাবলে স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের মতো গড়ে তুলতে পারেন। সেই স্বচ্ছ দেয়ালটা হচ্ছে তাঁদের বোধির, তাঁদের গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন কল্পনা-শক্তির আর হৃদয়-সংরাগ তানিত জীবনবোধের। উপলব্ধির এই স্বচ্ছতার জন্যই সেই সব কেউ-কেউ মানুষ ওই বিরাট সার্বিক ও শাশ্বত বিশ্বমনটার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন। তারপর এই একাত্মবোধের সঙ্গে যখন তাঁদের সহজাত প্রকাশ-ক্ষমতা ও রচনাকৌশলের প্রতিভাটাও যুক্ত হয়, তখনই সৃষ্ট হয় ওই বিশ্বমনের প্রতিচ্ছবি চিরন্তন চিরায়ত সাহিত্য। আর আমরা সাধারণ পাঠক কেবল এই সাহিত্যকে ধরেই আমাদের সহৃদয় উপলব্ধি দিয়ে সেই বিশ্বমনটাকে স্পর্শ করতে পারি। এইটেই আমাদের কাছে একমাত্র সাঁকো।