শুধু সৌন্দর্যকে বড়ো করে দেখার জন্যই নয়, যে কোনো বস্তুর অবধানেরই জন্য চোখের দৃষ্টির সঙ্গে যে আমাদের মনের দৃষ্টিটাকেও যুক্ত করতে হয়, সেকথা রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা একাধিক বার শুনেছি। অপর কোনো গ্রন্থে নয়, এই ‘সাহিত্য’ গ্রন্থেই শুনেছি। এই গ্রন্থের প্রথম বাক্যটিই হচ্ছে, ‘বাহিরের জগৎ আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া আরেকটা জগৎ হইয়া উঠিতেছে। এ বাক্যের সরলার্থ—আমাদের যাবতীয় দেখা-শোনা-জানা, গন্ধ-স্বাদ-স্পর্শ, আমাদের ভালো লাগা মন্দ লাগা—এ সবকিছুরই অবধান ঘটছে আমাদের সচেতন মনের সহযোগে। আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতাই হচ্ছে আসলে আমাদের ‘মনগড়া’ অভিজ্ঞতা। মন যেখানে প্রস্তুত বা উপস্থিত নেই, সেখানে কোনো কিছুর অবধানও নেই।

বিষয়টাকে আরও একটু স্বচ্ছ করার জন্য গোটা কয়েক দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যেতে পারে।

প্রথম দৃষ্টান্তটি আদৌ সত্য ঘটনা না, নিছক কল্পকথা, যদিও তার কোনো প্রামাণ্য নজির নেই, কিন্তু ঘটনাটি বহুশ্রুত। এ আলোচনার পাঠকদেরও বোধ হয় অনেকেরই সেটা শোনা আছে। এক জায়গায় একটা খুব বড়ো চাকুরির ইন্টারভিউ হচ্ছিল। যে-ঘরে এই ইন্টারভিউটি নেওয়া হচ্ছিল, সে ঘরটা ছিল সেকালের একটা খুব জবরদস্ত সরকারি প্রাসাদের দোতলার একটি ঘর। ইন্টারভিউয়ের সময় প্রার্থীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, নীচের থেকে দোতলায় উঠে আসতে তাদের সিঁড়ির ক-টা ধাপ ভাঙতে হয়েছে? সিঁড়িটা কীসের তৈরি? সিমেন্টের, না মোজেকের, না মার্বেলের? সিঁড়ির রেলিংটা কোন উপাদানের? প্রশ্ন কটি প্রায় একশো জন প্রার্থীর কাছে রাখা হয়েছিল। তারা কেউ চোখ বুজে সিঁড়িটা ধরে ওঠেনি, চোখ চেয়েই উঠেছিল। সিঁড়িটাতে আলোও ছিল যথেষ্ট। তবু নাকি একজনও প্রশ্ন-ক-টির সঠিক উত্তর দিতে পারেনি।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি, একজন নামকরা রম্য প্রাবন্ধিকের নিজের জীবনের ঘটনা। তাঁর জনৈক বন্ধুর বাসগৃহ ছিল উত্তর কলকাতার একটি নামকরা বড়ো পার্কের ঠিক গায়েই। পার্কটিতে নানান আকারের নানান জাতের গাছ—এক-একটার আয়তন প্রায় মহীরুহের মতো। প্রাবন্ধিক ভদ্রলোক তাঁর সেই বন্ধুটিকে প্রশ্ন করেছিলেন, হ্যাঁ হে অমুক। তোমাদের বাড়ির সামনের পার্কে ওটা কী গাছ হে? বাসে করে সেদিন যেতে যেতে দূর থেকে দেখলাম, ফুলেফুলে গাছটা একবারে আগুনের মতো লাল হয়ে আছে।

জিজ্ঞাসিত বন্ধুটি সবিস্ময়ে মন্তব্য করেছিলেন, ফুলের গাছ? কই, আমাদের ও-পার্কে কোনো ফুলের বাগান কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না!

-আরে, বাগান নয় হে গাছ, বড়ো গাছ। ওটা কৃষ্ণচূড়া না পলাশ? আমার তো মনে হয় পলাশ।

প্রাবন্ধিক ভদ্রলোকের বন্ধুটি নিরুত্তাপ কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন—হবে। আমি ভাই ঠিক খেয়াল করিনি। 

এই দুটি দৃষ্টান্তই বোধ হয় একথা প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট যে, মনের অবধানের দ্বারা যুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সৌন্দর্য দর্শন দূরের কথা, আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই কোনো কিছু ঠিক মতো নজর করতে সক্ষম নই। প্রথমোক্ত দৃষ্টান্তের ইন্টারভিউ প্রার্থীরা চোখ চেয়েও সিঁড়িগুলি ঠিকমতো দেখতে পায়নি, কারণ তখন তাদের প্রত্যেকেরই সমস্ত মনোযোগটাকে দখল করে রেখেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা চিন্তা বা দুশ্চিন্তা—ইন্টারভিউটা উতরোতে পারবো তো। আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্তের মানুষটি কলকাতার নাগরিক ল্যান্ডস্কেপে গাড়ি, লরি, ট্রাম বাস ইত্যাদি ধাবমান ও প্রাণসংশয়কর যানগুলি ব্যতীত অপর যে কিছু দ্রষ্টব্য বিষয় আছে বা থাকতে পারে—এই বেহেসিবী চিন্তাটাকেই মনের কাছে ঘেঁসতে দেন না।

কাজেই শুধুমাত্র অব্যবহিত পরিপার্শ্বকে ঠাহর করতেই যখন এতখানি মনঃসংযোগের প্রয়োজন, তখন সৌন্দর্যকে বড়ো করে দেখার জন্য যে মনের আরও খরতর দৃষ্টির প্রয়োজন, সেটা তো নিঃসংশয়েই একটা স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার।

উপস্থিত প্রসঙ্গে এরপরেও আরও একটি অধিকতর প্রণিধানের বিষয় আছে। আলোচ্য বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু যে-কোনো সৌন্দর্য দর্শনের কথাই বলেন নি। ‘মুখ্যের সঙ্গে গৌণের, মাঝখানের সঙ্গে চারিপাশের, সম্মুখের সঙ্গে পিছনের একটা সামঞ্জস্য’—এটা নিছক কোনা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয় নয়। এখানে সৌন্দর্য বলতে রবীন্দ্রনাথ সেই বিশেষ প্রকারের সুন্দর বস্তুটির কথা বলেছেন, যে সুন্দরবস্তুটিকে পট বা ক্যানভাস নামক একটি সীমিত ক্ষেত্রের উপর চিত্রী নামে একজন বিশেষ মানুষ তাঁর নিজস্ব মনোগত রূপ-ভাবনার প্রতিচিত্র করে নিজের হাতে সৃষ্টি করে থাকেন। অর্থাৎ এক কথায় চিত্রকলার সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য দেখার এবং উপভোগের জন্য কেবলমাত্র চোখের পিছনকার মনের দৃষ্টিটাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন এই মনের দৃষ্টিটাকেও বিশেষ ভাবে সংযম-সাধনা ও কঠোর অনুশীলনের দ্বারা গড়ে পিটে যথোপযুক্ত শিক্ষিত করে নেওয়ার। উপস্থিত প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সেই ললিত চিত্রকলার ‘সমজদারি দৃষ্টির বিষয়টাই বিবৃত করেছেন।

সাহিত্যের মতো চিত্রকলাতেও একটা নিত্যবস্তু আছে। সেটা যতটা না ভাবের, তার চেয়েও অনেক বেশি আকার বা ফর্মের। এক কথায় চিত্রকলার সেই নিত্যসুন্দর বস্তুটা হচ্ছে সুমিতি বা ইউনিটির রং, রেখা, মাত্রা (dimension) ঘনত্ব (volume) এবং ক্ষেত্রের (field এবং perspective) সুষম ভারসাম্যের। এই সুমিতিকেই রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে বলেছেন ‘মুখ্যের সঙ্গে গৌণের, মাঝখানের সঙ্গে চারিপাশের, সম্মুখের সঙ্গে পিছনের সামঞ্জস্য। অপর একটি রচনায় বিষয়টিকে তিনি আরও বিশদ করে ব্যাখ্যা করেছেন।

“আনাড়িদের পক্ষে চিত্রকলার রহস্য প্রথম দৃষ্টিতে ঠিকমতো বোঝা অসাধ্য।… ছবিতে যে বিষয়টা প্রকাশ করছে সেইটে দেখলেই যে ছবি দেখা হয়, দর্শকরা যাতে সে ভুল না করে সেটা জানা চাই। চিত্রবস্তুর সংস্থান (composition) তার বর্ণ-কল্পনা (Colour scheme) তার অঙ্কন (drawing) তার অবকাশ (space) তার উজ্জ্বলতা (illumina tion)। যাতে করে তার বিশেষ সম্প্রদায় ধরা পড়ে সেই তার বিশেষ আঙ্গিক। এসব বিষয়ে আজও অল্পলোকেরই ধারণা আছে।… ছবির যে একটি স্বকীয় ভাষা, একটি ছন্দ আছে সেইটেই বুঝিয়ে দেবার বিষয় ; ছবির রূপের, ছবির বিষয়ের ভাবের সম্বন্ধ কী সেইটে ব্যাখ্যা করা দরকার।

অর্থাৎ ঘুরে ফিরে এখানেও সেই সাধনারই কথা। ছবির সৌন্দর্য যথাযথ ভাবে উপভোগ করতে হলে শুধুমাত্র চোখের দৃষ্টির পিছনকার মনের দৃষ্টিটাও যথেষ্ট নয়; তার জন্য মনের দৃষ্টিটাকেও একটা বিশেষ প্রণালীতে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যে শিক্ষা দীর্ঘ কালিক নিবিষ্ট অনুশীলন ব্যতীত আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন হতে পারে, বার বার সাধনা আর সিদ্ধির কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু সেই সাধনাটাই বা কী প্রকারের, আর সেই সিন্ধিই বা কোন পথে আসবে?

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন সে প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, তার অগ্রগতির ইতিহাসে মানুষের সৌন্দর্য বোধটা সার্থকতার কোন রাস্তা ধরে এসেছে। সে রাস্তাটা যদিও ইতিমধ্যে আমরা বেশ খানিকটা দেখতে দেখতে এসেছি, তবুও আরও একবার সে পথটার উপর দৃষ্টিপাত করে নিতে বাধা নেই।

সুন্দরের প্রতি স্বভাবতই যে আমরা আকৃষ্ট হই, প্রথম অবস্থায় সেটা কিছুটা জৈব আকর্ষণের মতো একটা ব্যাপার। বস্তুটা রঙচঙে, নয়ন সুখকর, কখনো বা সেটা আমাদের জৈব প্রবৃত্তির মধ্যে একটা অসুস্থ ক্ষুধাও জাগিয়ে তোলে, কখনো সেটা দেখতে মিষ্টি বা চটকদার—ব্যস, অদীক্ষিত মন তখুনি সেদিকে ধাবিত হবে। সতর্ক না থাকলে এ সময় অনেক ভেজাল মালও আমাদের মজাতে পারে। জৈব আকর্ষণের চোরাগলিগুলির মধ্যে অনেক চোরাবালিও আছে—তার ভিতরে ডুবিয়েও মারতে পারে।

এরপর এই প্রাথমিক মুগ্ধতার সঙ্গে যখন নন ও বুদ্ধি যুক্ত হয়, তখন সেই সুন্দরের মধ্যে সুমঞ্জস ও সুমিত বস্তুটাকে আমরা পৃথক করে চিনতে শিখি। বুঝতে আরম্ভ করি আরম্ভের সঙ্গে শেষের, প্রধানের সঙ্গে অপ্রধানের, এক গূঢ় অংশের সঙ্গে অন্য গূঢ় অংশের যে অবিচ্ছেদ্য সুসম্বন্ধতা—প্রকৃত সুন্দরের আসন আসলে ঠিক সেইখানেই। এরপর এর সঙ্গে কল্যাণবুদ্ধির যোগে সুন্দরকে যখন আমরা আরও নিবিড় করে পাই, তখন তাকে আমরা এই বলে চিনি যে, সুন্দর কেবল রূপসী নয়, সে হচ্ছে কল্যাণী সতী।

অবশ্য মঙ্গলের মধ্যেও একটা দ্বন্দ্ব আছে। একদিকে ইন্দ্রিয়ের সুখকর ও অসুখকর, অপরদিকে বোধি ও বুদ্ধির মঙ্গলকর ও অমঙ্গলকর—এই দুই বিপরীত কোটির দ্বন্দ্ব। উপলব্ধির গভীরতায় এই দ্বন্দ্বের মধ্যে যখন আমরা সত্যকে আবিষ্কার করি তখন অবশ্য এই দ্বন্দ্বও ঘুচে যায়। কিন্তু ঘুচে যায় তখনই, যখন সেই সত্যকে আমরা আনন্দ দিয়ে আপনার করে নিতে পারি। আনন্দের যোগে আত্মীয়তার সম্পর্ক পাতানো না পর্যন্ত সত্য আমাদের কাছে একজন মুখচেনা প্রতিবেশীর চেয়ে অধিক ঘনিষ্ঠ হতে পারে না। সত্য শুধু তখনই আমাদের উপলব্ধির মধ্যে তার স্ব-রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যখন সেই সত্যের জন্য আমরা সর্বস্ব পণ ধরতে পারি। আর শুধু তখনই ইংরেজ কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরা ঘোষণা করতে পারি— Beauty is Truth, Truth is Beauty কারণ আনন্দের যোগে এই ভাবে উপলব্ধি করতে পারলে তখন সত্যই হয়ে সুন্দরতম। বলা বাহুল্য, এই উপলব্ধিও সাধনা সাপেক্ষ। সেই যে চোখের দৃষ্টির পিছনকার মনের দৃষ্টি—সেই মনের দৃষ্টিকে শিক্ষিত করার, দীক্ষিত করার কঠোর সাধনা।

মানুষের সকল সৃজনকার্য জেনে বা না জেনে এই দিকেই চলেছে। কাব্যে, চিত্রে ও অন্যান্য শিল্পকলায় এই সৃজনকার্য সত্যকেই সুন্দরতম আধারে অভিব্যক্ত ক’রে, আনন্দকে দিব্যানুভূতিতে উত্তীর্ণ করে, যা চোখে পড়তো না, তাকে আমাদের দৃষ্টির সামনে উপলব্ধির সামনে হাজির করে আমাদের জীবনাশ্রিত সত্য ও আনন্দলোকের সীমানাকে প্রসারিত করে দিচ্ছে। এখানকার আমন্ত্রণ সর্বলোকের প্রতি। আনন্দের পর্বতশৃঙ্গ সকলকেই আহ্বান করছে। কিন্তু এ শৃঙ্গে উপনীত হতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন উপযুক্ত প্রস্তুতির—মনের, হৃদ্যতার এবং নিবিষ্ট নিদিধ্যাসনের।