বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে ১৮৭৬-এ প্রবর্তিত অভিনয় নিয়ন্ত্রণ বা নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক অধ্যায়। ইংরাজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির হাত ধরেই বাংলায় আধুনিক নাট্যচর্চার সূত্রপাত হয়। প্রথম পর্বে বাংলা নাটকগুলি ছিল শিক্ষিত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের সুস্থ আমোদের উপকরণ। কবিগান, যাত্রা, ঝুমুর, আখড়াই, বাইজিবিলাসের আদিরসাত্মক ও স্থূল মনোরঞ্জন ত্যাগ করে রুচিসম্পন্ন শিক্ষিত বাঙালীরা নাট্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালীর অন্তরে যে স্বদেশপ্রীতিকে ক্রমে জাগ্রত করে তুলছিল তা ক্রমে ক্রমে বাংলা কাব্য, উপন্যাস ও নাটকেও সঞ্চারিত হতে শুরু করে।

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই জাতীয়তাবাদী মনোভাব বাঙালীর অন্তরে স্ফূরিত হতে থাকে। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই হরিশচন্দ্র বাংলায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৮৬০-এ ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রকাশ ইংরাজ শাসককে উদ্বিগ্ন করেছিল এবং নীলদর্পণের অনুবাদক জেমস্ লঙের জরিমানা ও তৎসংক্রান্ত ঘটনাধারা ইংরাজ শাসক ও বাঙালী প্রজার সম্পর্কটিকে স্পষ্ট করে তুলেছিল। ১৮৭২-এ জাতীয় নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা ও বঙ্গদর্শনের প্রকাশ বাঙালীর জাতীয় চেতনাকে সংহত করতে সাহায্য করেছিল।

১৮৭১-এ ন্যাশনাল থিয়েটার বা জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার মধ্যে যে অস্পষ্ট জাতীয়তাবাদের চেতনা ছিল, সেটি ‘নীলদর্পণে’র অভিনয় ও দর্শকমনে বিপুল ছায়াপাতের ঘটনায় অনেকখানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ পর্যন্ত বাঙালীর রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল নিরীহ আবেদন নিবেদনে সীমাবদ্ধ। কিন্তু নাট্যমঞ্চে ব্রিটিশ বিরোধী নাটক মঞ্চস্থ হলে তা যে ক্রমে জনরোষের চেহারা নেবে তা বুঝতে ব্রিটিশ সরকারের অসুবিধা হয় নি।

কিন্তু প্রতিষ্ঠার পরে পরেই ন্যাশনাল থিয়েটারের অন্তর্কলহ এবং ভাঙন, সেইসঙ্গে গ্রেট ন্যাশনাল বা বেঙ্গল থিয়েটারে মধুসূদন দীনবন্ধু-রামনারায়ণের নাটক, প্রহসন কিংবা অন্যান্য অপেরার অভিনয় ব্রিটিশ সরকারকে সম্ভবত কিছুটা নিশ্চিন্ত করেছিল। কিন্তু পুরোনো নানা নাটকের অভিনয়ের পাশাপাশি ১৮৭৫-৭৬ নাগাদ তৎকালীন বঙ্গমঞ্চগুলিতে ক্রমে দেশাত্মবোধক এবং প্রশাসন বিরোধী কিছু নাটক দর্শকের উচ্ছ্বসিত সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। এই নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’, কিরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারতে যবন’, হরলাল রায়ের ‘বঙ্গের সুখাবসান’, ‘হেমলতা’ ইত্যাদি।

কিন্তু যে নাটকের অভিনয়গুলি ব্রিটিশ সরকারকে ক্রমে আশঙ্কাগ্রস্ত করে তুলেছিল তার মধ্যে বেঙ্গল থিয়েটারের অভিনীত নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গুইকোয়ার’ এবং গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত অমৃতলাল বসুর ‘হীরকূচর্ণ’ উল্লেখযোগ্য। পুরুবিক্রম, বঙ্গের সুখাবসান বা হেমলতা নাটকে ইতিহাসের আবরণে স্বদেশবোধের প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু আলোচ্য নাটক দুটিতে সাম্প্রতিক একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনাকে রূপায়িত করা হল। তৎকালে বরোদা রাজ্যে ইংরেজ রেসিডেন্ট বিষপানে মারা গেলে সেই অজুহাতে সরকার মহারাজকে সিংহাসনচ্যুত করেন। ব্রিটিশ সরকারের নগ্ন আগ্রাসী ভূমিকা ও স্বেচ্ছাচারিতা, প্রজাদের উপর নির্মম অত্যাচার, বিদ্রোহী প্রজাদের শাস্তিবিধান ইত্যাদি দৃশ্য নাটক দুটিতে সরকারের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেছিল।

উপেন্দ্রনাথ দাস গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার থাকাকালীন (১৮৭৫) তাঁর লেখা ‘শরৎ-সরোজিনী’ এবং ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’ নাটকদুটি এবং কয়েকটি প্রহসন জনমানসে ব্রিটিশ সরকার বিরোধী মনোভাব সঞ্চার করতে থাকে। শরৎ-সরোজিনী’ তে দেখানো হল নায়ক এক দস্যু ইংরাজকে হত্যা করছে এবং বিচারালয়ে অকুণ্ঠ চিত্তে সেই কথা গৌরবের সঙ্গে ঘোষণা করেছে। সরোজিনীও শরৎকে ইংরেজ রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচাতে অপর ইংরাজেকে হত্যা করেছে। ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’তে হুগলীর ইংরাজ ম্যাজিস্ট্রেটের লাম্পট্য তুলে ধরা হল। তাঁর নারীর প্রতি লালসার নগ্ন চিত্রও অঙ্কিত হল এই নাটকে। ফলে ইংরাজ সরকার ক্রমশ বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠতে থাকে।

ইতিমধ্যে আর একটি ঘটনাও বাংলা নাটকে তথা রঙ্গমঞ্চে রূপায়িত করলেন উপেন্দ্রনাথ দাস। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অফ ওয়েলেস ১৮৭৫-এ ভারতে আসেন। ভবানীপুর নিবাসী উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের গৃহে অতিথি হিসাবে তিনি অন্তঃপুর ও অন্তঃপুরিকাদের দর্শন করেন। অন্তঃপুরে গিয়ে পুরনারী দর্শনের এই ঘটনা বঙ্গসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ঘটনাটিকে ব্যঙ্গ করে উপেন্দ্রনাথ ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’ নামে একটি প্রহসন রচনা করেন ও গ্রেট ন্যাশনালে ১৯ ও ২৩শে ফেব্রুয়ারী (১৮৭৬) অন্য পূর্ণাঙ্গ নাটকের সঙ্গে তা অভিনীত হয়। সরাসরি প্রশাসনিক কর্তাকে আক্রমণ করায় সরকার এই নাটক বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু গ্রেট ন্যাশনাল কর্তৃপক্ষ কৌশল অবলম্বন করে ‘হনুমান চরিত্র’ নামে সেই নাটক আবার অভিনয় করলেন। ‘হনুমান চরিত্র’কেও পুলিশ নিষিদ্ধ করল। তখন পুলিশসুপার মিঃ ল্যাম্ব ও পুলিশ কমিশনার মিঃ স্টুয়ার্ট হগকে ব্যঙ্গ করে উপেন্দ্রনাথ নতুন প্রহসন মঞ্চস্থ করলেন ১লা মার্চ ‘দি পুলিশ অফ পীগ এ্যান্ড শীপ’ নামে। স্পষ্টতই মি. হগ এখানে পীগ এবং মি. ল্যাম্ব শীপ হিসাবে রূপায়িত হলেন।

এই নাটকটি ইংরাজ সরকার ও পুলিশকর্মীদের ক্রোধে ঘৃতাহুতি দিল। “দি পুলিশ অফ পীগ অ্যান্ড শীপ’ নাটকাভিনয়ের পূর্বদিনই, ১৮৭৬ এর ২৯শে ফেব্রুয়ারী বড়লাট লর্ড নর্থব্রুক বাংলা নাটকের সরকার বিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে এক অর্ডিনান্স জারি করেন। যেখানে জনস্বার্থ রক্ষার জন্য কুরুচিপূর্ণ, কুৎসামূলক, প্ররোচনা সৃষ্টিকারী নাটক ও তার অভিনয় নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলার সরকারকে ক্ষমতাদানের কথা বলা হয়। এরপর ৪ঠা মার্চ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার থেকে উপেন্দ্রনাথ, অমৃতলাল সহ বহু নাট্যকর্মী ও আয়োজককে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদের ছেড়ে দিলেও উপেন্দ্রনাথ ও অমৃতলালের একমাস করে কারাদণ্ড হয়। পরে অবশ্য হাইকোর্টে আপীল করে তাঁরা বেকসুর মুক্তি পান।

মার্চ মাসেই কাউন্সিলের কাছে Dramatic Performance Control Bill পেশ করা হয়। অশ্লীলতা ও কুৎসার কথা বলা হলেও সরকার আসলে নাটকের মধ্য দিয়ে ক্রমসংগঠিত সরকার বিরোধী চেতনা সঞ্চারকেই ভয় পাচ্ছিলেন। ফলে এ ধরনের নাটকের কণ্ঠরোধ করা ঔপনিবেশিক সরকারের পক্ষে জরুরি হয়ে উঠেছিল। ১৮৭৬ এর ১৬ই ডিসেম্বর নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিলটি আইনরূপে গৃহীত হল। ভারত তথা বাংলায় সাম্রাজ্যবাদী ইংরাজ সরকারের নাট্য নিয়ন্ত্রণের নামে এই দমনমূলক ভূমিকা আরো স্পষ্ট ও নগ্নরূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৮৭৮-এ ভার্ণাকুলার প্রেস অ্যাক্ট (সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন) ও আর্মস অ্যাকট (আগ্নেয়াস্ত্র বহন নিষিদ্ধকরণ)-এর মধ্য দিয়ে।

ইংরাজ সরকারের নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়নের পিছনে দেশীয় ব্যক্তিবর্গের সহায়তাও কম ছিল না। দেশীয় রক্ষণশীল সমাজ অভিনয় ক্ষেত্রে বারাঙ্গনা শ্রেণীর নারীদের অনুপ্রবেশ ভালচোখে দেখছিলেন না। তাঁরা দেশীয় অভিনয় বন্ধ হোক, তা মনে প্রাণে চাইছিলেন। তাছাড়া দেশীয় আমলা অভিজাত ও ইংরাজের আশ্রিত বশংবদশ্রেণী তৎকালীন প্রহসনগুলিতে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁরাও নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে সমর্থন করেছিলেন। ফলে এই দেশীয় সমর্থনকে ব্যবহার করে ইংরাজ সরকার কার্যসিদ্ধি করেছিলেন।

অভিনয় নিয়ন্ত্রণ বা নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন বাংলা অভিনয় ও রঙ্গমঞ্চের স্বাভাবিক অগ্রগতিকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল সন্দেহ নেই। জাতীয় নাট্যশালার প্রচেষ্টা ও দেশাত্মবোধের প্রচার এই আইনের ফলে প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হল। নাট্যকারগণ উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী নাটক রচনায় অথবা সরকারী ক্রিয়াকলাপের বিরোধিতা করে নাটক সৃষ্টিতে আর সাহসী হলেন না। রঙ্গমঞ্চ কর্তৃপক্ষও সে ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করার অধিকার হারালেন। ফলে বাংলা নাটক ও নাট্যাভিনয়ে একটি বিশেষ ধারা প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল।

নাট্যজগতের এক বিরাট অংশ রাজশক্তিকে ভয় পেয়ে শাসক ইংরাজের তোষণ করে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইল। ফলে সাংস্কৃতিক জগতে একটা মেরুদণ্ডহীন তাঁবেদার শ্রেণী তৈরি হল। রাজভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার ‘রয়াল’ উপাধি লাভ করেন ‘শকুন্তলা’, অভিনয় করে।

ব্যবসায়িক নিরাপত্তার প্রয়োজনে বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চে এরপর গার্হস্থ জীবনমূলক নাটক, পৌরাণিক ভক্তিমূলক নাটক, গীতিনাট্য, অপেরা, লঘু প্রহসন ও কিছু ঐতিহাসিক নাটকের জোয়ার দেখা দিল। গিরিশচন্দ্রের এ সময়কার নাট্যরচনার দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। বাঙালীর ভক্তিপ্রাণতা ও ধর্মভাবকে অবলম্বন করে পৌরাণিক নাটকের বাহুল্য যে এসময় দেখা দিয়েছিল তার পিছনে অন্যতম প্রধান বাস্তব কারণ ছিল অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন। যদিও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী উত্তাল দেশাত্মবোধের প্রেরণায় গিরিশচন্দ্র থেকে শুরু করে অন্যান্য বহু নাট্যকার দেশপ্রেম মূলক ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছিলেন, বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে সেই সব উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী অভিনয় আইনকে উপেক্ষা করে। অবশ্য বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেলে বাংলা রঙ্গমঞ্চও পুনর্বার তার শক্তি, সাহস ও উদ্দীপনা হারায়।

বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চ র ওপর এই সরকারী নিয়ন্ত্রণ যে স্বাধীন সৃষ্টিশীলতার পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক হয়েছিল, সে সম্পর্কে গিরিশচন্দ্র আক্ষেপ করে লিখেছিলেন— ‘দেশের কি দুর্ভাগ্য যে নাটকের বিচারকর্তা ও সমালোচক পুলিশ, সাহিত্যিক সম্প্রদায়ের কোনো প্রতিবাদ নেই। পুলিশের নির্দেশমত চরিত্র, dialogue ও scenes বদলাতে হয়। দুঃখের বিষয় ব্রিটিশ সরকার আরোপিত এই অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনটি স্বাধীন ভারতেও দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত আকারে অস্তিত্বরক্ষা করেছিল। ১৯৬২ সালেও সংশোধিত আকারে আইনটিকে বলবৎ রাখার চেষ্টা হয়, নাম হয় – “ওয়েষ্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরমেন্স বিল’। এ নিয়ে স্বাধীন ভারতের বুদ্ধিজীবী মহলে প্রবল বিক্ষোভ জেগে ওঠে। অবশেষে ১৯৬৩ তে তদানীত্তন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্ল সেন বিলটিকে প্রত্যাহার করে নেন। তথাপি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাফাই দিয়ে সরকারী তরফে আইনটি সংশোধিত আকারে হলেও আজও অস্তিত্ব রক্ষা করছে।