রবীন্দ্রনাথ কোনো কোনো তত্ত্বনাটকে ট্র্যাজিক জীবন-চেতনার উপাদান সন্নিবেশ করেছেন। ‘মুক্তধারা’ সেক্ষেত্রে একখানি স্মরণীয় নাটক। এ নাটকে মানবজীবনের দুঃখ-ভোগ ও ভাগ্য-বিড়ম্বনার একটা লৌকিক রূপ লক্ষিত হয়। ‘মুক্তধারা’ নাটকে তত্ত্ব সার্থক ও আদর্শ শিল্পরূপ লাভ করায় এর ট্র্যাজেডির উপাদানগুলি বিশেষভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে। যন্ত্রশক্তির অহংকারে অন্ধ উত্তরকূটের শাসকশ্রেণি কীভাবে প্রতিবেশী রাজ্য শিবতরাই-এর ওপর নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে নিজেদেরই ক্ষতিসাধন করল রাজাকে পেতে হল মর্মান্তিক আঘাত— সেই ট্র্যাজেডিই ‘মুক্তধারা’ নাটকের কাহিনিতে রূপায়িত।
দেবতা কর্তৃক প্রদত্ত যে জল, উত্তরকূটের শাসকবর্গ আপন সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শিবতরাই-এর লোকেদের সেই জল থেকে বঞ্চিত রাখতে চায়; মুক্তিধারার জলপ্রবাহকে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে বাঁধ দিয়ে কেবল নিজেদের অন্ন সংস্থান করতে চায়। উত্তরকূটের ট্র্যাজিক বিভ্রান্তি এইখানেই যে, তারা যন্ত্রশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ভাবছে জলের প্রতি একমাত্র অধিকার তাদেরই। মঙ্গলময় দেবশক্তির যথার্থ বিষয়কে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে বিকৃত করার মৃঢ় অপচেষ্টা হওয়ার ফলে উত্তরকূটের শাসক সম্প্রদায় ও মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। মুক্তধারা নষ্টকের ট্র্যাজেডি এখানেই নিহিত।
“সমালোচক প্রমথনাথ বিশী মন্তব্য করেছেন—“উত্তরকূটের লোক আপনার দেশের লোককে সন্দেহ করিয়া থাকে, কিন্তু সন্দেহটা এমনই বাতিক যে তাহার সীমানা নিশ্চয় সম্ভব নয়। শিবতরাইকে সন্দেহ করিতে করিতে অবশেষে তাহারা বিভূতি, অভিজিৎ, রণজিৎ, মন্ত্রী সকলকেই সন্দেহ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। সন্দেহের পরিধি যতই বাড়িয়াছে আত্মীয়ের পরিধি তত সংকীর্ণ হইয়াছে শেষ পর্যন্ত সে পরিধি সংকীর্ণতম হইয়া নিজেতে মাত্র আসিয়া ঠেকিয়াছে—ব্যক্তিত্ববাদের ইহা অনির্বাণ ট্র্যাজেডি।”
তবে এখানে শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ট্র্যাজেডি বা শ্রেণিগত ট্র্যাজেডির কথাই বলা হয়নি, এখানে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির পরিচয়ও দুর্লক্ষ্য নয়। রাজা রণজিৎ ভৈরব মন্দিরে পূজার আয়োজন করেছেন। উত্তর ভৈরবের ভক্ত রাজা রণজিতের ধারণা যে শিবতরাই-এর মানুষকে তৃষ্ণার শূলে বিদ্ধ করে তাদের সিংহাসনের তলায় ফেলে রাখা যাবে। এই অহমিকাবোধ থেকে উত্তর ভৈরবের পূজার আয়োজন এক অর্থে দেবতাকে উৎকোচ দান, এ পূজা যথার্থ পূজার্ঘ্য প্রদান নয়। আসলে উত্তরকূটের মানুষ শাসনবর্গের প্ররোচনায় ধর্মের নামে, ভক্তির নামে ব্যভিচারে রত হয়। একথা বিশ্বাস করে বিশ্বজিৎ আর শিবতরাই-এর জননেতা ধনঞ্জয় বৈরাগী। বিশ্বজিৎ এ ব্যাপারে রাজা রণজিৎকে সাবধান করে দেয়। আর ধনঞ্জয় রাজাকে সাহস করে জানিয়ে দেয় উত্তরকূটের প্রশাসনের অন্তঃসারশূন্যতা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নেয় অভিজিৎ, সে আপন জীবন দান করে বাঁধ ভেঙে দেয়।
অভিজিং স্বীয় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যে শিবতরাই-এর মানুষকে মুক্ত করল তাই নয় উত্তর কূটের মানুষকেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মূঢ়তা, মদান্ধতা থেকে মুক্ত করল। দেবতা মুক্ত হল দাসিত্ব থেকে, পূজার্ঘ্য মুক্ত হল চেতনার অসম্মান থেকে আর উত্তরকূটের মানুষ মুক্ত হল শূন্য আস্ফালন, আত্মম্ভরিতা হীনম্মন্যতা ও অপৌরুষ গর্বান্ধতা থেকে। স্বীয় প্রাণ দিয়ে অভিজিতের এই যে সামগ্রিক মুক্তি সাধন তার মধ্যে তারই ট্র্যাজেডি নিহিত। অভিজিৎ উত্তরকূটের মানুষ, অথচ উত্তরকূট যন্ত্রশক্তির গর্বার্ধতায় সাম্রাজ্যবাদী এবং মানবতা বিরোধী। তার ভালোবাসায় উত্তরকৃ টের এই ভূমিকায় তিনি বেদনার্ত ও মর্মাহত। শোষক, অত্যাচারী, মদাদ্ধ দেশের মানুষ হিসেবে অভিজিতের এই যে আত্মিক লাঞ্ছনা তা তার ট্র্যাজেডি।
মানুষের জীবনধারণের সহায়ক শক্তিরূপে যে যন্ত্রের আবির্ভাব সে যদি মানুষের ওপর আধিপত্য শুরু করে সংহার শক্তিরূপে আবির্ভূত হয় তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেই হয়। মানুষের জীবনের মমতার তখন শুভশক্তি আপন প্রাণ বিসর্জনে দ্বিধাবোধ করে না। জীবন বিসর্জনের বিনিময়ে সে মানবতা বিরোধী যন্ত্রকে ধ্বংস করে। সেই পটভূমিকায় মুক্তধারার বাঁধ ভাঙতে গিয়ে অভিজিতের প্রাণ বিসর্জন মহত্বপূর্ণ ঘটনা। চিরযাত্রী তরুণ অভিজিতের কবিপ্রাণ বিনষ্ট হওয়াও তো মর্মভুদ ট্র্যাজেডি করুণ। অভিজিৎ সহ্য করতে পারেনি যন্ত্রের ভয়াবহতাকে – “সইতে পারছিনে ওই বীভৎসটাকে যা ধরণির সংগীত রোধ করে দিয়ে আকাশে লোহার দাঁত মেলে অট্টহাস্য করছে।” অভিজিতের অপরূপ কবিপ্রাণতা তার মৃত্যুকে পাঠক দর্শনের কাছে ট্র্যাজেডির কারুণ্যে মথিত করে তোলে—“আমার বুক কান্নায় ভরে রয়েছে। আমি কঠোরতার অভিমান রাখিনে। চেয়ে দ্যাখো ওই পাখি দেবদারু গাছের চূড়ার ডালটির ওপর একলা বসে আছে। ওকি নীড়ে যাবে, না অন্ধকারের ভেতরে দিয়ে দূর প্রবাসের অরণ্যে যাত্রা করবে জানিনে। কিন্তু ওই যে এই সূর্যাস্তের আকাশের দিকে চূপ করে চেয়ে বসে আছে সেই চেয়ে থাকার সুরটি আমার হৃদয়ে এসে বাজছে।”
অবশ্য অভিজিতের ট্র্যাজেডি কেবল একা তারই ট্র্যাজেডি নয়; রণজিতেরও ট্র্যাজেডি। কেননা অভিজিতের জীবনদর্শন ও কার্যকলাপ তাঁর দ্বারা সমর্থিত না হলেও, রণজিতের ভালোবাসা ছিল অভিজিতের প্রতি উদার, অকৃপণ। যেহেতু অভিজিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শত্রুতার নয়, ফলে সে মৃত্যুও রণজিতের মনের গহনে ট্র্যাজিক সংবিদ রচনা করে। মানুষের ও দেবতার প্রিয় অভিজিৎকে রণজিৎ রক্ষা করতে চেয়েও পারে নি বলে তাঁর ট্র্যাজেডি আরও বেদনাবহ। উদার মুক্ত প্রাণ চিরসবুজ প্রাণের অধিকারী অভিজিৎ, শোষণ পীড়নের চির বিরোধী অভিজিৎ, মানবপ্রেমের পূজারি অভিজিৎ, মদান্ধ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর মানবতা বিরোধী মৃঢ়তার দ্বারা যেভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তা রণজিতের পক্ষেও ট্র্যাজেডির মর্মচ্ছেদী পরিবেশ রচনা করেছে।
Leave a comment