সমালোচক প্রমথনাথ বিশী বলেছেন—“রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নাটকেই একাধিক জনতা আছে। কিন্তু মুক্তধারার জনতা অনেক ইহার প্রায় অর্ধাংশই জনতার কথোপকথন । নাটকটি পথের কাহিনি, স্বভাবতই ইহার যোগ্য পাত্রপাত্রী পথিক, মুক্তধারার জনতা পথিক জনতা…মুক্তধারার জনতার ব্যক্ত পরিচয় নাই, কিন্তু চমৎকার সমষ্টি পরিচয় আছে।” অর্থাৎ নাট্যকাহিনির প্রয়োজনে তাদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ জনতা চরিত্র অঙ্কনে জনজীবনের সাধারণ কথাবার্তা, তাদের স্থূল রঙ্গরসিকতার প্রতি অনুরাগ এবং অনতিভীরু জীবনের আনন্দ ও দুঃখকে গ্রহণ ও অঙ্কনের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। জনজীবনের বাস্তবচরিত্র নাটকে উপস্থাপিত করার জন্য তাঁর নাটকে পরিপূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যতার ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

‘মুক্তধারা’ নাটকে জনতার যে চরিত্র অঙ্কিত সেখানে দ্বান্দ্বিক দিকটি অভিব্যক্ত। ‘মুক্তধারার’ পূর্ববর্তী কোনো নাটকে ঠিক এইভাবে জনতা চরিত্র অঙ্কিত হয়নি যেখানে রবীন্দ্রনাথ নাটকের দ্বান্দ্বিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে জনতার চরিত্র আশ্রয় করেছেন। আলোচ্য নাটকের মূল সমস্যা হল একটি জনপদের জীবন ও জীবিকার সমস্যাকে রূপায়িত করা। কেননা জনতার জীবন ও জীবিকার সমস্যাকে কেন্দ্র করেই নাটকের মূলবক্তব্য ঘনীভূত হয়েছে।

উত্তরকূট শব্দের অর্থ হল শ্রেষ্ঠ, পার্বত্য প্রদেশ; নাট্যকারও বলেছেন—রাষ্ট্রীয় তাৎপর্যের দিক থেকে উত্তরকূট পার্বত্য প্রদেশ ও শিবতরাই-এর তুলনা করলে দেখা যাবে— উত্তরকূটই শ্রেষ্ঠ। কেননা এ প্রদেশের লোক রাজানুগ্রহ লাভে গর্বিত এবং এ কারণেই তারা গর্বোদ্ধত । শিবতরাই-এর অভিধাগত অর্থ শিব বা মঙ্গলময় যাদের ত্রাণ করেন। এ রাজ্যের জনগণের মূল সমস্যা হল জ্বল সমস্যা। জ্বল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ জীবনধারণের ক্ষেত্রে। মুক্তধারার জলের ধারা যে শিবতরাই-এর জনপদবাসীদের জীবন ও জীবিকার অপরিহার্য কল্যাণকর সম্পদ, এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করাই নাটকের মৌল বক্তব্য।

রবীন্দ্রনাথ উত্তরকূটবাসীদের চরিত্রগত আত্মকেন্দ্রিকতার, পরশ্রীকাতরতা ও উন্নাসিকতার দিকটি উদ্ঘাটিত করার মাধ্যমে ব্যক্তিত্ববাদের অনিবার্য পরিণামের অন্তিম দিকটি প্রকাশিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। অবশ্য এর মূল কারণ নিহিত রয়েছে উত্তরকূটে প্রচলিত এক বিশেষ ধরনের শিক্ষানীতিতে। গুরুমশাই-এর সংলাপে উত্তরকূটের শিক্ষানীতির স্বরূপ ও আদর্শ ব্যক্ত হয়েছে—“উত্তরকূটের বাইরে যে হতাভাগারা মাতৃগর্ভে জন্মায়, একদিন এইসব ছেলেরাই তাদের বিভীষিকা হয়ে উঠবে।” কিন্তু শেষপর্যন্ত ইতিহাসের অমোঘ অনিবার্য পরিণতিতে এই আদর্শ চিরন্তন হয় না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য যাদের তৈরি করা হয় তারাই একদিন শাসনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা পোষণ করে, এমনকি শাসকের আসন টলিয়ে দেবার ক্ষমতাও রাখে। রবীন্দ্রনাথ জনতা চরিত্রের মাধ্যমে ইতিহাসের এই মোড় ঘোরবার কথাও উচ্চারণ করেছেন।

উত্তরকূটের জনতা আসলে কানমলার দল, আর শিবতরাই-এর জনগণ হল কানঢাকার দল। উত্তরকূটের অর্থাৎ কানমলার দলের দ্বারা শিবতরাই এ অর্থাৎ কানঢাকার লোকেরা অত্যাচারিত, নিপীড়িত । উত্তরকূটবাসীদের সম্বন্ধে শিবতরাই-এর লোকেরা মনে করে—“ওদের অন্তর দিয়ে মারে প্রাণটাকে, আর শাস্তর দিয়ে মারে মনটাকে, অর্থাৎ উত্তর কূটবাসীরা শাস্ত্রেও শস্ত্রের কাজে সুচতুর। তুলনামূলক বিচারে উত্তরকূটবাসীদের একতরফা সমৃদ্ধির পথটি অবরুদ্ধ থাকবে না।

শিবতরাই-এ জনগণ উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে বিভ্রান্ত হয়ে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল যুবরাজকে মুক্ত করে দেশের রাজা করতে চায়। দেখা যায় যে, ধনঞ্জয়ের শিক্ষা এখানে ‘ব্যর্থতায়’ পর্যবসিত। শিবতরাইবাসীরা নেতার অভাবে নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে সক্রিয় বিপ্লবে নেমে পড়ে, আপন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সংগ্রামে রত হয়।

সমালোচ্য নাটকে সংঘাত সংকুল অবস্থায় পরস্পর বিরুদ্ধ দুটি জনতাকে ধ্বংসাত্মক ও সৃজনাত্মক শক্তির প্রতীকরূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। ফলে দর্শক—পাঠকমনে এক অনিশ্চিত উৎকণ্ঠা সঞ্চারিত হয়েছে ? বাঁধ ভাঙতে গিয়ে অভিজিতের এর আত্মোৎসর্গে উত্তরকূট ও শিবতরাই এ জনগণের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির দৃশ্য নাটকে অঙ্কিত হয়নি। তবে নাট্যমধ্যে গণনেতৃত্বের দ্বারা গণবিপ্লব সফল হওয়ায় সম্ভাবনাও ছিল। কেননা, অত্যাচারিত, নিপীড়িত অবহেলিত জনগণের মনে প্রতিশোধ গ্রহণের দুর্বার আকর্ষণ ছিল। অভিজিতের যথার্থ নেতৃত্বে বিপুল সংঘশক্তি গড়ে উঠলে যন্ত্র, শাস্ত্র ও শস্ত্র-সর্বস্ব বণিক ও অভিজাত গোষ্ঠী উপলব্ধি করতে পারতো যে, অসহায় দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর চিরকাল অত্যাচার চালানো যায় না। গণমানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো নেতার আবির্ভাব ঘটলে ইতিহাস কালান্তরের লগ্ন পার হতে পারবে।

সর্বোপরি, মুক্তধারা নাটকের জনগণ একটি বিশেষ দেশকালের বৃত্তে আবদ্ধ হলেও তারা কিছু বিশেষ দেশকালের নয়। তারা চিরকালের জনগণ। যারা বঞ্ঝিত, লাঞ্ছিত, পরপদানত, অবহেলিত, উৎপীড়িত, অত্যাচারিত, আবার একইসঙ্গে উদ্ধৃত, স্বার্থকেন্দ্রিক, অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানহীন, জাতীয়তাবাদে উদগ্র, প্রতিবেশী রাজ্যের কল্যাণে ভ্রুক্ষেপহীন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালীন ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় সংঘ শক্তির যেরূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আত্মস্থ করেছিলেন তাকেই ‘মুক্তধারা’ নাটকে উত্তরকূট ও শিবতরাই-এ জনগণের মাধ্যমে রূপায়িত করেছেন।