মূলত টিনের তলোয়ার উৎপল দত্তের বিপ্লবী থিয়েটার চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য নাটক। ‘নীলদর্পণ’ নাটকখানি জাতীয়তাবোধের প্রতীক রূপে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইংরাজ সরকার ১৮৭২ সালের পর থেকে বাংলা থিয়েটারের প্রতি নজর দিতে শুরু করেন। পরে ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কিছু রচনা করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। কাজেই নাট্যকাররা পৌরাণিক, ভক্তিমূলক, রোমান্স জাতীয় নাট্যরচনায় আত্মনিয়োগ করলেন, কিন্তু দীর্ঘদিন একই জিনিস চলতে পারে না। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জাগে। উৎপল দত্ত ‘টিনের তলোয়ার’ লিখে সেই প্রতিবাদের নাট্যরূপ দিলেন। এ নাটকে একটি থিয়েটারের কথা আছে, যার নাম— ‘দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা’। এর মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ একজন মুৎসুদ্দি। একাধিক রক্ষিতার প্রতিপালনে তার সামাজিক আভিজাত্য প্রকাশ পায়। তার থিয়েটারের কাপ্তেন বেণীমাধব চাটুজ্যে। থিয়েটার চালিয়ে যাবার স্বার্থে বেণীমাধব ঐতিহাসিক রোমান্স নিয়ে লেখা নাটক, সামাজিক নকশা ও প্রহসনের অভিনয় চালিয়ে যাবার চিন্তায় সচেতন থাকে। রাস্তা থেকে, বেশ্যাপল্লি থেকে সে মেয়ে নিয়ে এসে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নামকরা অভিনেত্রীতে রূপান্তরিত করে। তার থিয়েটারে টিকিট বিক্রি আশানুরূপ, মালিক তাতেই খুশি।

‘The great Bengal opera’-তে একদিন এসে হাজির হয় এক নবীন নাট্যকার প্রিয়নাথ মল্লিক। সে হিন্দু কলেজের ডিরোজিওর আদর্শে বিশ্বাসী নবীন বঙ্গীয় যুবক। সে মুক্ত পুরুষ, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তার পিতা মদ্যপান করে, রক্ষিতা পালন করে বলে সে পিতার সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকে। ডিরোজিওর দেশপ্রেমের কবিতা পাঠ করে প্রিয়নাথ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখে দেশপ্রেমের নাটক। ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নামে একটি নাটক লিখে সে তাতে জালিয়াৎ ক্লাইভের প্রতি প্রয়োগ করেছেন ব্যঙ্গ। এই নাটক প্রিয়নাথ দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরায় অভিনয়ের জন্য জমা দেয়। উগ্র ইংরাজ বিরোধী নাটকের প্রতি বেণীমাধবের কোনো দুর্বলতা ছিল না। ওই নাটক গৃহীত হয়নি। প্রিয়নাথ তাতে মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়। কিন্তু তাতেও সে দমিত হয়নি। সে পুনরায় লেখে আর একটি নাটক, নাম ‘তিতুমীর’। এ নাটক থিয়েটারে গৃহীত হয়। কিন্তু থিয়েটারের মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁর ইচ্ছা নয় ‘তিতুমীর’ নাটক মঞ্চায়ন হোক। তার নির্দেশে মঞ্চস্থ হয়—দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এই নাটক অভিনয়ের দিন বক্সে বসে অভিনয় দেখছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ। তার পাশে বসা ছিল এই থিয়েটারের নতুন নায়িকা ময়না, সে এখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রক্ষিতা, পুলিশ অফিসার ল্যাম্বার্ট অভিনয় দেখতে এসেছিল। সেও আসন নিয়েছিল বক্সে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পাশাপাশি আসনে।

নাটক চলাকালীন নিমচাঁদবেশী বেণীমাধব অভিনয়ের সময় দেখতে পায় ল্যাম্বার্টকে। তখনই তার যাবতীয় ক্রোধ ও দেশাভিমান প্রকাশ পায়। তিতুমীর নাটকের তিতুমীরের সংলাপ সে আওড়াতে থাকে। অন্যতম নায়িকা বসুন্ধরা তখনই বেণীমাধবের হাতে ধরিয়ে দেয়—‘টিনের তলোয়ার। বেণীমাধব সেই তলোয়ার ঘুরিয়ে প্রবল দেশ প্রেমের প্রকাশ ঘটায় সংলাপের উচ্চারণে। ‘তিতুমীর’ নাটক পড়ে বেণীমাধব মন্তব্য করেছিল—“শালা রক্তের মধ্যে ঢুকে যায় এমন সব চোখা চোখা কথা। লেখে ভালো।” কিন্তু থিয়েটারের সকল কিছু রক্ষার স্বার্থে বেণীমাধব তিতুমীর নাটকের অভিনয়ের কথা ভাবতে পারেনি। কিন্তু তার মনে গভীর দাগ রেখে গিয়েছিল এই নাটক। তিতুমীরের বিপ্লবী মনোভাব বেণীমাধবকেও আকৃষ্ট করেছিল। প্রিয়নাথ মল্লিকের দেশপ্রেম মূলক নাটককে একদিন বেণীমাধব ব্যঙ্গ করেছিল, কিন্তু ব্রিটিশের দমন পীড়নের ভয়াবহতায় অতিষ্ঠ হয়ে বেণীমাধব একদিন সিদ্ধান্ত নেয়, তার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হবে ‘তিতুমীর’। বেণীমাধবের এই সিদ্ধান্তে থিয়েটারের সবাই সচকিত হয়ে উঠল। প্রতিবাদী নাটক তিতুমীর এর অভিনয়-সংবাদে চারিদিকে চাঞ্চল্য জাগল। বেণীমাধব জানত, গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার ইংরাজ বিদ্বেষমূলক নাটক ও প্রহসন অভিনয় করে বিপন্ন হয়েছে। সেই থিয়েটারের অস্তিত্ব বজায় রাখাই সমস্যা হয়ে উঠেছিল।

অর্থাৎ দেশপ্রেম মূলক ও ইংরাজ বিরোধী নাটকের অভিনয় করে বেণীমাধব তার থিয়েটারকে বিপদের দিকে ঠেলে দেবে না। পক্ষান্তরে তার থিয়েটারে টিকিট বিক্রি খুব আশাপ্রদ। এ অবস্থায় বেণীমাধব প্রিয়নাথের দেশপ্রেমমূলক নাটককে গ্রহণ করতে চায়নি; তাছাড়া থিয়েটারের মালিক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ দাঁ থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সে চায় তার থিয়েটারে ‘ময়ূর বাহন’ নাটক, ‘সধবার একাদশী’ দিনের পর দিন অভিনীত হোক। তাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের থিয়েটারি ব্যবসা জমে উঠবে ভালোভাবেই। থিয়েটারের স্বার্থে বেণীমাধব বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মতের বিরুদ্ধে যায়নি। কিছু আপত্তি দৃষ্টিতে বেণীমাধব নির্বিকার হলেও গভীর দৃষ্টিতে সে একজন দেশপ্রেমিক নাট্যকর্মী। থিয়েটার নিছক বিনোদন নয়। থিয়েটারও প্রয়োজনে গর্জে উঠতে পারে। ব্যবসায়ী থিয়েটারকে রূপান্তরিত করতে হবে রাজনৈতিক থিয়েটারে। টিনের তলোয়ারে যে রাজনৈতিক থিয়েটারের স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে তা প্রতিবাদী থিয়েটার। শাসক ইংরাজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। উৎপল দত্তের কাছে প্রতিবাদী থিয়েটারই বিপ্লবী থিয়েটার। বেণীমাধব তিতুমীর বেশে ল্যাম্বার্টের দিকে তলোয়ার নাচিয়ে বলেছেন—“এই নাও দুষমন। এই নাও নারী ধর্ষক ইংরাজ হার্মাদ। আজ বছরের পর বছর আমার দেশেরে যা দিয়েছো, এই নাও তার খানিক ফেরৎ নাও।”

এই সংলাপ উচ্চারণের পর বেণীমাধব জয়ের হাসি মুখে নিয়ে হেসেছে। অভিনেত্রী বসুন্ধরা বেণীমাধবকে ভক্তিভরে নমস্কার করেছে। আর যদু গেয়ে উঠেছে মধুসূদনের রচিত দেশপ্রেমের গান—

“শুন গো ভারতভূমি, কত নিদ্রা যাবে তুমি

ওঠ ত্যজ ঘুম ঘোর, হইল হইল ভোর

দিনকর প্রাচীতে উদয়।”

ফলত ‘The great Bengal opera’ আর এরপর ব্যবসায়ী থিয়েটার থাকে না। পরিণত হয় বিপ্লবী থিয়েটারে। নাট্যকার উৎপল দত্ত বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনার আলোকে যে বিপ্লবী থিয়েটারের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘টিনের তলোয়ার’ নাটক যেই বিপ্লবী থিয়েটারের স্বরূপ উপহার দিয়েছে।