ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নব্য কবিকুল তাঁদের রচনার নতুন জীবনবোধ নিয়ে আসবার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দী শুরু থেকেই ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়েছিল এবং ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে এদেশের তরুণদের ঘনিষ্ঠ যোগোযোগ ঘটেছিল। এর ফলে মধ্য যুগের চিন্তা, ভাবনার কুসংস্কার এবং সামাজিক পারিবারিক প্রথাগত বন্ধনের সীমা সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছিল। মধ্য যুগের ধর্ম ছিল সর্বব্যাপী মানুষের মন ধর্মীয় সংস্কারের দ্বারা আবদ্ধ। প্রথাযুগ সংস্কারের মানুষ মেনে চলত। মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কোনো মুক্তি ছিল না। মানবতা ধর্মী আচার আচরণের পায়ে মাথা খুঁড়তো। নব্যশিক্ষা এবং পশ্চিমের জীবনবোধ ঘটাল এক ধরনের নব জাগরণ। ফলে চিন্তা ভাবনায় এল নতুনত্ব। ধর্ম বর্জিত হল না, কিন্তু মানবিক সত্যের দৃষ্টিকোণে তার মূল্যায়ন ঘটতে লাগল নবযুগের চিন্তাধারার মূল সত্যটিকে তাই বলা হয়, মানবতাবাদ মানুষের মূল্যকে স্বীকার করা ধর্মীয় আচার, সামাজিক প্রথা, পারিবারিক বন্ধন,— এগুলির জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য এগুলি, এই ভাবনাটি নব্য শিক্ষিতদের মনের আকাশকে করে বসল অধিকার। এই মানবতার মধ্যে একটি বিশেষ প্রসঙ্গ হল নারী প্রসঙ্গ। নব্য বাংলা লেখকশ্রেণি এই নারীকে করলেন তাঁদের লেখনীর হাতিয়ার। বাংলার প্রথম নব্য কবি মধুসূদন দত্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন তার কাব্য সৃষ্টির আধারে।

‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ নব্য যুগের প্রথম নারী হিসাবে প্রমীলা, সীতা, সরমা, মন্দোদরী, চিত্রাঙ্গদা, এই চরিত্রগুলি দৃষ্ট হয়। এদের মধ্যে অন্তত তিনটি পারিবারিক এবং দেশীয় আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে সীতার আহচর্য করেছে। চিত্রাঙ্গদা স্বামী বিরুদ্ধে প্রায় বিদ্রোহী হয়েছে, এ শুধু স্বামীস্ত্রীর কলহ নয়, স্বামীর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সে সরব হয়ে উঠেছে। অন্য পক্ষে রোমান্টিক নায়িকা প্রমীলা সামাজিক লজ্জা সংকোচকে অনায়াসে অতিক্রম করে বীরবেশে স্বামী মিলনের জন্য যাত্রা করেছে। তার মধ্যে প্রণয় ব্যাপারে নারীর অনবদ্য স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় যেমন মেলে, তেমনি নারীর বীরাঙ্গনার রূপটি দেখেও মুগ্ধ হতে হয়। নারী শুধু গৃহকোণ আশ্রয়ী বধূই নয়। প্রয়োজনে শত্রুর সম্মুখীন হওয়ার সাহসও রাখে। এই বোধ থেকেই মধুসূদন প্রমীলা সৃষ্টি করেছিলেন, প্রাচীন কাব্যের যোদ্ধা নারীদের ওপরে অসুবিধা ভাবনার বস্তু আরোপ করেন তিনি।

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যে মধুসূদন সম্পূর্ণতই নারী চরিত্রের কথা ভেবেছেন। লক্ষ্য করবার মতো বাংলা সমাজে নারী মুক্তির প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তিনি এই কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলেন। অর্থাৎ মধুসূদন সচেতন ছিলেন যে, বিশেষভাবে নারী ভাবনার কাব্যই তিনি লিখেছেন এবং এর নারী ভাবনার নতুন যুগ অনুমোদিত না হলে বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করতে যেতেন না। এই কাব্যের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এখানে কবি সম্পূর্ণত একটি নারী জগৎ গড়ে তুলেছেন। এর এগারোটি চরিত্রই পুরুষ থেকে সংগৃহীত নারী চরিত্র। এই নারীদের মনকেই কবি সামনে রেখেছেন। তাদের দৃষ্টিকোণে সংশ্লিষ্ট গল্পটির প্রয়োজনীয় অংশ বিবৃত করেছেন। নারীর দুঃখ, সুখ, কামনা বাসনা, আবেগ উত্তাপ, হিংসা ঈর্ষাই এই পত্রগুলিতে মুখ্যত রক্ষিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঘটনাতো বটেই। পুরুষ চরিত্রগুলিও নারীর মনের মুকুরে প্রতিফলিত।

আলোচ্য চরিত্রগুলি রামায়ণ মহাভারত, ভাগবত পুরাণ, কাশীদাসী মহাভারত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, এবং কালিদাসের নাটক থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। কথায় বার্তায় ভাবে-ভঙ্গিতে ঘটনার পটভূমিকে অতীত চারণা নিপুণভাবে জমিয়ে তোলা হয়েছে। এ যে অতীত কালের কাহিনি, এই মানবীরা যে প্রকাশ ভারতের রমণী সে বিষয়ে পাঠক মনে কোনো সংশয় দেখা দেয় না। কিন্তু এখানেই মধুসূদনের অসামান্য কৃতিত্ব যে অতীত বাতাবরণটি পুরোপুরি রক্ষা করেও তিনি প্রাণের মধ্যে আধুনিকতার বীজটি বপন করেছেন, এত স্বাভাবিকভাবে এই আধুনিকতাকে প্রাচীনতার সঙ্গে মিলিয়েছেন যে, কখনও পাঠকের মনে আরোপ ঘটেছে বলে সন্দেহ জাগে না । মধুসূদন তাঁর পত্রগুলোর মধ্যে যেসব দিক দিয়ে আধুনিক নারী চিত্তের মুক্তির সুর বাজিয়েছেন তা হল—সুতীব্র কামনাকে এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যেন গোটা পৃথিবীর বাধা তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। বীরঙ্গনার প্রত্যেক পত্রের ছত্রে ছত্রে এমনভাবে নারী স্বাধীনতা ব্যক্ত হয়েছে, যা আধুনিকতার লক্ষণকে সূচিত করে।

তাই বলা যায়, মধুসূদন এগারোটি নারী চরিত্রে ভালোমন্দের কথা না ভেবে, সামাজিক ও নৈতিক আর্দশের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বিচিত্র মানবীকে পরম যত্নে রূপায়িত করেছেন, প্রতিটি নারীই অপরের থেকে পৃথক। কেউ দেহ কামনায় উজ্জ্বল, কেউ রোমান্টিক অনুভবে ব্যাকুল, কেউ সাহসিনী, কেউ ভীরু, কেউ বিদ্রোহিনী, কেউ অভিমানিনী। এই বিচিত্র স্বভাব নারী বিপুল নারী জগতের অংশরূপে পাঠকের সামনে এসেছে এবং মধ্যযুগীয় ভাবনার পরিবর্তে আধুনিক নারী ভাবনার প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছেন।