একজন মানুষ অন্যকোনো মানুষের কাছে তার নিজের বক্তব্য কিংবা মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য পত্রলেখার প্রয়োজন হয়। এই পত্র সাধারণত মানুষের মনে আনন্দের সঞ্চার ঘটায়। পত্র একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন মানুষের মনে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা ও আনন্দ দান করে। তখন সেই পত্র ব্যক্তিগত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সাহিত্য মহলে সমাদর প্রাপ্তি ঘটে। এমন পত্রকে পত্রকাব্য বলতে পারি।

পত্রাকাব্যের বৈশিষ্ট্য :

(ক) পত্রগুলি কাল্পনিক হলেও বাস্তব রঙে রঞ্জিত হবে।

(খ) নায়িকা যেন নায়কের কাছে সত্য সত্যই পত্র লিখেছে। এমন ধরনের এক বিশ্বাসযোগ্যতা পত্রের মধ্যে সৃষ্টি করা থাকে।

(গ) পত্রগুলিতে সমকাল চেতনা ও বিষয় চেতনার সমসাময়িক ছাপ লেগে থাকে।

(ঘ) বাস্তব প্রসঙ্গের সাহায্যে পত্রের বিষয়বস্তুকে যথাসম্ভব বাস্তবতার দিকে সঞ্চারিত করে গড়ে তোলা হয়। 

(ঙ) নায়ক-নায়িকার মনে যে ভাব সঞ্চার হয় তাদের অন্তরের বেদনা প্রকাশ করা হয় এই পত্রে।

(চ) এই পত্রগুলিকে আধুনিকতার ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়।

সাধারণত বাংলা ভাষায় পত্রকাব্যটি এসেছে পাশ্চত্যের ‘Epistle’ থেকে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং সার্থক পত্রকাব্য মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। তবে প্রাচ্য সাহিত্যে নায়কের কাছে নায়িকা বিশেষ কারণে পত্র লিখন রীতি অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছিল।

এই নায়িকা অর্থাৎ ভারতীয় নারীগণের প্রেম প্রকাশের কতগুলি রীতি আছে। যথা— ১। স্নিগ্ধ ও সমুধুর দৃষ্টিভঙ্গি ২ । প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি, ৩ । সুমধুর কণ্ঠস্বর ভঙ্গি, ৪। মৃদুভাষা দূতী প্রেরণ এবং (ঙ) পত্রপ্রেরণ।

মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নারীরা সাধারণত পত্র প্রেরকের দ্বারা নায়কের কাছে প্রেমের কথা প্রকাশ করত। এই পত্র প্রেরণের বিষয়টি আমরা লক্ষ্য করে থাকি, শকুন্তলায় (কালিদাসের) বিক্রমবর্ষীয় বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’তেও। এছাড়া আমরা দেখি মহাভারতে নলরাজা হংসের পায়ে দড়ি বেঁধে দময়ন্তির কাছে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। সেইরূপ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন তাঁর ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যটি রচনা করেছিলেন প্রাচীন ধারা অনুসরণ করে। যা ইতালিয় কবি ওভিদের পত্রকাব্যকে অতিক্রম করে গেছে।

মধুসূদন পাশ্চাত্যের Epistolary Style-এর ওপর ভর করে তাঁর পত্রগুলি রচনা করেছিলেন। এইপত্রগুলির মুখ্য উদ্দেশ্যগুলি হল পত্র প্রাপকের অন্তরকে স্পর্শ করে তোলে।

বীরাঙ্গনা কাব্যের মোট এগারোটি পূর্ণাঙ্গপত্রের নায়িকাদের মানসিকতা অনুসারে পত্রগুলি মোট তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা— (১) আদর্শ প্রেমপত্র (২) প্রোষিতভর্তৃকা প্রেম পত্র (৩) অভিযোগ পত্র ।

(১) আদর্শ প্রেমপত্র : প্রেম যখন নতুন করে প্রথম জন্ম নেয় তখন পূর্বরাগবশত লজ্জা বিনয় ভঙ্গিময় এবং বিভিন্ন হাব-ভাব লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্ত বিষয়কে অবলম্বন করে লেখা পত্রকে বলে আদর্শ প্রেমপত্র। যেমন—(ক) সোমের প্রতি তারা (খ) দ্বারাকানাথের প্রতি রুক্ষিণী (গ) লক্ষ্মণের প্রতি শূর্পণখা (ঘ) পুরুরবার প্রতি উর্ব্বশী। এই চারটি নারী যে প্রেমপত্র নায়কের কাছে প্রেরণ করেছিল তা হল আদর্শ প্রেমপত্র। 

(২) প্রোষিতভর্তৃকা প্রেমপত্র : যে নারীর স্বামী বিদেশে থাকে তাকে বলে প্রোষিত ভর্তৃকা। এই নারী স্বামীর জন্য উৎকণ্ঠা হয়ে থাকে। ফলে তার প্রেম ব্যাকুলতা প্রকাশ পায়। এই সুগভীর প্রেম স্বামীর প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসার রূপান্তর ঘটে। তখন সেই নারী স্বামীর প্রতি পত্র প্রেরণ করে তার হৃদয়ের অন্তর জ্বালা নির্বাপণের জন্য। এইরূপ পত্র হল প্রোষিতভর্তৃকা প্রেমপত্র। যেমন—’অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী’ পত্রটি প্রোষিতভর্তৃকা প্রেমপত্র।

(৩) অভিযোগ পত্র : এই পত্রে স্বামীর কাছে কিছু না পেয়ে স্ত্রী খেদ প্রকাশ করে। স্বামীর প্রতি রাগবশত আত্মহননের পথে যেতে থাকে। তখন ঘটনার ঠিক পূর্বমুহূর্ত অবস্থায় যে পত্র প্রেরণ করে সেই পত্রই হল অভিযোগ পত্র এই পত্র স্বামীর কাছে কোনো কিছুর অভিযোগ করে লেখা ৷

এখানে ‘দশরথের প্রতি কৈকেয়ী’ আর ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রটি অভিযোগ পত্রের মধ্যে পড়ে। কেকয়ী এখানে স্বামীকে তার কৃতকার্যের জন্য সবার কাছে উপহাস্য করে তোলে। আর জনা স্বামীকে পরিত্যাগ করায় গঙ্গাবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে তাঁর মনের তীব্র আঘাত করার চেষ্টা করেছেন।

গঠনরীতি : বিষয়ের ক্ষেত্রে গাম্ভীর্য রক্ষিত হয়েছে পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উনিশ শতকীয় নারী মুক্তির চেতনা। তাই ওভিদের কাব্যের নায়িকাদের মতো এই কাব্যের নায়িকারা ভয়ংকরী হয়ে উঠেছে।

আঙ্গিক গত গঠনের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় বীরাঙ্গনা কাব্যের কাঠামো পত্রের কাঠামো, আদর্শ পত্রের লক্ষণ যা হওয়া উচিত তা হয়েছে। Epistolery রীতিতে রচিত হয়েছে পত্রগুলি। তাই এই কাব্যের উপস্থাপনে নাটকীয়তা এবং কাব্যধর্মীতা বিশেষভাবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, যা নায়িকাদের হৃদয়ের অন্তর্বেদনা যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

ছন্দ অলংকারের দিক থেকে বিচার করলে দেখাতে পাওয়া যায়, Blank verse-এর অনুসরণে পয়ারের কাঠামোয় অমিত্রাক্ষর ছন্দে এই পত্রগুলি রচিত। যা মধুসূদন তার পত্রে এক চরম উৎকর্ষতা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। অতএব নিঃসংকোচে বলা যায় যে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম এবং সার্থক পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ যা মধুসূদনের মৌলিক সৃষ্টি।