বৈষ্ণব কবিতার সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অভিনব দৃষ্টির উল্লেখ করতে গিয়ে সর্বপ্রথম তাঁর রচিত ছিন্নপত্রের ৪৮ সংখ্যক পত্রে তিনি লিখেছেন, “বৈষ্ণব কবিরা গভীর রাত্রে ঝড়ের সময় রাধিকার অকাতর অভিসার সম্বন্ধে অনেক ভালা মিষ্টি মিষ্টি কবিতা লিখেছেন; কিন্তু একটা কথা ভাবেননি, এরকম ঝড়ে কৃষ্ণের কাছে তিনি কী মূর্তি নিয়ে উপস্থিত হতেন। এ সব কথা কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের লেখা পড়বার সময় মনে হয় না। কেবল মানসচক্ষে ছবির মতো দেখতে পাওয়া যায় একজন সুন্দরী শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি বিকশিত কদম্ববনের ছায়া দিয়ে, যমুনার তীরপথে, প্রেমের আকর্ষণে, ঝড়-বৃষ্টির মাঝে আত্মবিহ্বল হয়ে স্বপ্নগতার মতো চলেছেন। হায়, আবশ্যক জিনিসগুলো আবশ্যকের সময় এত বেশি দরকার, অথচ কবিত্বের বেলায় এত উপেক্ষিত ! আবশ্যকের শত লক্ষ দাসত্ববন্ধন থেকে আমাদের মুক্তি দেবার জন্য কবিতা মিথ্যে ভান করছে।”

১১৮ নং পত্রে তিনি পুনরায় লিখেছেন, “বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষার যমুনার বর্ণনা মনে পড়ে। প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈব কবির ছন্দোঝংকার এনে দেয়। তার প্রধান কারণ এই, প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য নয়; এর মধ্যে একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্ছে, এর মধ্যে অনন্ত বৃন্দাবন। বৈষ্ণব পদাবলীর মর্মের ভিতর যে প্রবেশ করেছে, সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে সে বৈব কবিতার ধ্বনি শুনতে পায়।”

রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব-কবিতার যে অভিনব মূল্যায়ন করেছেন তা অবিস্মরণীয়। তিনি বৈব পদাবলীর রসধারাকে মর্ত্যবাসী নরনারীদের তৃপ্ত প্রেমতৃথা মেটাবার পথ দেখিয়েছেন তা অভিনবত্বের ছোঁয়া দেয়। তাই তাঁর কবিতায় তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন—

দেবতারে যাহা দিতে পারি দিই তাই প্রিয়জনে-প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই

তাই দিই দেবতারে ; আর পাব কোথা ! 

দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।

এখানে নর-নারীর প্রেমলীলার মধ্যে বিশ্বস্রষ্টার চিরন্তন প্রেমলীলা যেভাবে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন তা কবির অভিনব দৃষ্টিতেই সম্ভব হয়েছে, কারণ তৃতীয় চক্ষু কেবল তাঁরই রয়েছে।